ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘আমি আমার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করবো’

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:২৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০  
‘আমি আমার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করবো’

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি কি ইংরেজিতে আপনার বক্তৃতা উপস্থাপন করবেন?’ 

জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করবো। কারণ এই ভাষার অধিকার আদায়ে বাংলার দামাল ছেলেরা শহীদ হয়েছেন।’ 

জাতিসংঘে সেদিন মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে এক অনন্য ইতিহাস তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বলতে গেলে ওই দিনই তিনি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের সূচনা করে ছিলেন, যা বহু বছর পর জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়।

১৯৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে ১৩৬তম সদস্য দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহন করা হয়। এই ঘোষণাটি শোনার অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আমি সুখী হয়েছি যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন লাভ করেছে। জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে, যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন; সেই শহীদদের কথা জাতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।’ 

সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে ২৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৭টায় বাংলাদেশ বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে বঙ্গবন্ধু ২৪ জন সফরসঙ্গী নিয়ে রওয়ানা হন। এই দলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদসহ পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. নূরুল ইসলাম, গ্যাস ও অয়েল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. হাবিবুর রহমান, এমআর সিদ্দিকী এমপি, আসাদুজ্জামান খান এমপি, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ছিলেন।

জাতিসংঘের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তরের গুরুদায়িত্বটি পড়েছিল ফারুক চৌধুরীর ওপর। তিনি ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার। ছুটিতে দেশে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তার ছুটি বাতিল করা হয়। তাকে কতগুলো জরুরি দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

বঙ্গবন্ধু তাকে বললেন,‘তুমি আমার সঙ্গে নিউইয়র্ক যাবে এবং জাতিসংঘে আমি বাংলায় যে বক্তৃতাটি করব, তাৎক্ষণিকভাবে তুমি সেই বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করবে।’ 

বঙ্গবন্ধুর কথায় ফারুক চৌধুরী প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। পরিস্থিতি সহজ করতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রিহার্সাল দাও। বক্তৃতা ভাষান্তরের সময় ভাববে, যেন তুমিই প্রধানমন্ত্রী। তবে পরে কিন্তু তা ভুলে যেও।’

মাতৃভাষায় বক্তৃতার পর যুক্তরাষ্ট্রে বহুল পঠিত জাতিসংঘের ‘ডেলিগেট বুলেটিন’ বঙ্গবন্ধুকে ‘কিংবদন্তির নায়ক মুজিব’ বলে আখ্যায়িত করে। বুলেটিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের মন্তব্য-প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়। বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল,‘এ যাবৎ আমরা কিংবদন্তির নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছি। এখন আমরা তাঁকে কাজের মধ্যে দেখতে পাব।’

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে বলা হয়,‘বক্তৃতায় ধ্বনিত হয়েছে মুজিবের মহৎ কণ্ঠ।’ জাতিসংঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন,‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় আমি আনন্দিত ও গর্বিত। বক্তৃতাটি ছিল সহজ, গঠনমূলক ও অর্থবহ।’

জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদান প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুর সম্মানে নিউইয়র্ক সিটি হলে আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় নিউইয়র্কের মেয়র বঙ্গবন্ধুকে নগরীর চাবি উপহার দেন এবং বলেন,‘এই উপহার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জনগণের প্রতি আমেরিকার জনগণের শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের নিদর্শন।’ 

প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা আত্মদান করেছেন সেই সব শহীদদের আর সাড়ে সাত কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে এই চাবি গ্রহণ করে আমি সম্মানিত বোধ করছি।’ 

তোফায়েল আহমদ লিখেছেন, ‘‘মনে পড়ে হোটেল ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া’র রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছি। আমার সামনেই উপবিষ্ট একটি পরিবার। পরিচয়ের শুরুতেই তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ?’ আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকে। আমাকে অবাক করে দিয়ে তখন তাদের মুখে স্বতঃস্ফুর্তভাবে একটি কথাই উচ্চারিত হয়- ‘ও! শেখ মুজিব, শেখ মুজিব! তিনি একজন মহান নেতা।’ পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি তাঁর পলিটিক্যাল সেক্রেটারি। কিন্তু তারা বিশ্বাস করতে পারলেন না। আমার মতো অল্পবয়সী একজন কী করে বিশ্বখ্যাত নেতা শেখ মুজিবের পলিটিক্যাল সেক্রেটারি হতে পারে! কেবল বললেন, ‘আর ইউ শিওর?’ আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম।’’

হাসনাত/শাহেদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়