ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন সেই জিনিয়ার

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ২৩ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৩:১১, ২৩ অক্টোবর ২০২০
ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন সেই জিনিয়ার

মজার স্কুলের মিষ্টি মেয়ে জিনিয়া। সে যেন সবার চেয়ে আলাদা। ৯ বছরের এই মেয়েটি হাসি দিয়ে সবার মন জয় করে নেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ের ক্যাম্পাসে, বিশেষ করে টিএসসিতে যাদের আনাগোনা- তারা এই মিষ্টি হাসির সঙ্গে পরিচিত। স্কুল আঙ্গিনা আর টিএসসিতেই সীমাবদ্ধ ছিলো তার পরিচিতি।

জীবিকার তাগিদে ফুলের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক জিনিয়ার। ফুল বিক্রির টাকায় চলে তাদের সংসার। ছোট্ট এ জিনিয়াকে ভালোবেসে অনেকেই আগ বাড়িয়ে তার কাছ থেকে ফুল কেনে। আবার কেউ স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয়।

এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী তার নাম দিয়েছে পুষ্পকন্যা। কথায়ও বেশ পটু। তার কথায় মুগ্ধ হয়ে অনেক শিক্ষার্থী তাকে ছোটো বোনের মতো ভালোবাসে। ফুল না কিনলেও বিভিন্নভাবে সাহায্যে এগিয়ে আসে।

সম্প্রতি দেখা গেছে নিষ্পাপ এই শিশুটির ওপর নজর পড়ে দুষ্ট চক্রের। অপহরণ করা হয়। এ ঘটনায় বদলে গেছে জিনিয়ার জীবন। আগের মত আর ছুটে বেড়ানোর চাঞ্চল্যতা তার মাঝে নেই। ভয়ে আতঙ্কে থাকে সব সময়। প্রায়ই আঁতকে ওঠে। মায়ের চোখের আড়াল হতে চায় না। মাও সব সময় তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন।

জিনিয়ারা একেবারেই অসহায়। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। কোনো রকমে জীবন চলে। কখনও একবেলা, আবার কখনো না খেয়েই দিন কাটাতে হয়। পথের পাশেই কাটে দিনরাত। ঝড়-বৃষ্টি, রোদ সব কিছুই তাদের কাছে সমান। তবুও স্বপ্ন মাঝে মধ্যে উঁকি দেয়। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে জিনিয়ার মজার স্কুলে ভর্তি হওয়া।

বছর পাঁচেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান জিনিয়ার বাবা। এরপর অসহায় তিন বাচ্চাকে নিয়ে গ্রাম ছাড়েন জিনিয়ার মা। ঢাকায় এসে টিএসটি এলাকায় আশ্রয় নেন। জিনিয়ার ছুটে চলা, দুরন্তপনা সবকিছুই স্কুল, ফুল আর মাকে নিয়ে। কিন্তু সেই সামান্য ভালোবাসা জায়গা দখল করে নিয়েছে এখন আতঙ্ক। কখন কী ঘটে যায়।

জিনিয়া এখন স্কুল যেতেও ভয় পায়। সেই ভয়েই আবার গ্রামে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে তারা। কিন্তু সহায়-সম্বলহীন হওয়ায় অনিশ্চিত জীবন এখন তাদের সামনে। জিনিয়ার বড় ভাই পলাশ পানি বিক্রি করে। ছোট বোন সিনথিয়ার বয়স মাত্র পাঁচ বছর।

মায়ের স্বপ্ন জিনিয়া বড় হয়ে ডাক্তার হবে। পড়ালেখায়ও বেশ ভালো সে। পুষ্পকন্যাকে সবাই তাই ভালোবাসে। সমাজের বৃত্তবানরা যদি এগিয়ে আসে তাহলে তার মায়ের সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে পারে।

অপহরণের সেই ঘটনা সম্পর্কে জিনিয়া বলে, ‘দুজন আমাকে ডেকে নিয়ে ফুসকা খাওয়ায়। আগে অনেক ভাইয়া-আপু আমাকে ফুসকা খাইয়েছে। তাই আমি গিয়েছিলাম। এরপর তারা আমাকে ২০০ টাকা দিয়ে একটি বাসায় নিয়ে যায়। আমি মায়ের কাছে ফিরে আসতে চাই। কিন্তু তারা আমাকে আসতে দেয়নি।’

এ সম্পর্কে জিনিয়ার মা সেনুরা বেগম বলেন, ‘‘ফুল বিক্রি করার সময় জিনিয়া কিছুক্ষণ পরপরই আমার কাছে আসে বিভিন্ন বায়না নিয়ে। ফুল বিক্রির টাকা দিয়ে আবার নতুন ফুল নিয়ে যায়। কিন্তু অপহরণের দিন সন্ধ্যার পর থেকে সে আর আসেনি। কোথাও তার কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না। জিনিয়ার ভাগ্য ভালো যে তাকে সবাই চিনতো এবং ভালোবাসতো।

‘সন্ধ্যার পর যখন আমি সবাইকে জানালাম জিনিয়াকে খুঁজে পাচ্ছি না। তখন তার খোঁজে সবাই তৎপর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা ফেসবুক, ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয় জিনিয়ার নিখোঁজের খবর। পরদিন সব পত্রিকা এবং টেলিভিশনে প্রচার হয়। এরপর পুলিশও তৎপর হয়ে ওঠে। পাঁচদিন পর মেয়েকে ফিরে পাই আমি।”

তিনি বলেন, ‘সিনথিয়া পেটে থাকা অবস্থায় ওদের বাবা মারা যায়। এরপর জীবিকার তাগিদে ঢাকা আসি। ফুল বিক্রি শুরু করি। মেয়েরা মজার স্কুলে পড়াশোনা শেষে ফুল বিক্রি করে। চলেই যাচ্ছিলো কোনোমতে। কিন্তু অপহরণের ভয় এখনও কাটেনি জিনিয়ার। এখন সে একা থাকতে ভয় পায়। আমিও চোখে চোখে রাখি। লোপার মেয়ে তো গ্রেপ্তার হয়নি। মনে ভয় কাজ করে- কোনোদিন যদি সে আবার জিনিয়াকে নিয়ে যায়!’

সেনুরা বেগম বলেন, ‘মেয়েদের নিয়ে গ্রামে চলে যাবো। সেখানে ওদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো। কিছু সাহায্য সহযোগিতা পেলে এলাকায় একটা দোকান করতে চাই। যা আয় হয়, তা দিয়ে ওদের লেখাপড়া শেখাবো। জিনিয়া পড়ালেখায় ভালো। ও বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায়।’ 

জিনিয়া অপহরণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা জোনাল টিমের এসআই মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘মামলাটির তদন্ত চলছে। লোপার নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। জিনিয়া ২২ ধারার জবানবন্দিতে লোপার মেয়ে নদীর নাম বলেছে। সে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। সে এখন পলাতক। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য প্রমাণ নিচ্ছি। সবকিছু যাচাই বাছাই শেষ হলে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।’

এদিকে গ্রেপ্তারের পর যখন লোপাকে আদালতে নেওয়া হয় তখন তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। লোপা বলেন, ‘মেয়েটির শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। সে আমার কাছে সাহায্য চায়। মেয়েটিকে দেখে আমার মায়া লাগে। দরদ দেখাতে গিয়ে ফেঁসে গেলাম।’

ঢাকা/সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়