ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পদ্মা সেতু নির্মাণে যত কাঁটা

ইবনুল কাইয়ুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪৩, ১০ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৮:৫৬, ১০ ডিসেম্বর ২০২০
পদ্মা সেতু নির্মাণে যত কাঁটা

পদ্মা সেতু

অবশেষে দৃশ‌্যমান হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এ সেতুর সর্বশেষ ৪১ নম্বর স্প‌্যানটি বসেছে বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর)। এর ফলে ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পুরো সেতুটি এখন বাস্তব রূপ পেয়েছে। 

তবে সেতু নির্মাণের পথটি মসৃণ ছিল না। কাঁটায় ভরা পথ পেরিয়ে তবেই বাস্তবে রূপ পেয়েছে পদ্মা সেতু। নানান প্রতিবন্ধকতা পেরুতে হয়েছে প্রকল্পটিকে। কী ছিল সেসব প্রতিবন্ধকতা? চলুন জেনে নেওয়া যাক।

কথিত দুর্নীতির অভিযোগ  
নবম সংসদ নির্বাচনের (২০০৮) আগে ‘দিন বদলের সনদ’ নামে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ছিল। ক্ষমতায় আসার পর সে অনুযায়ী কাজও শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। তবে কাজ শুরুর আগেই ওঠে দুর্নীতির কথিত অভিযোগ। একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। বিদেশি অর্থায়ন নিয়ে চলে নানা জটিলতা। এক পর্যায়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। পিছিয়ে পড়ে প্রকল্প।

দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র
শুরুতেই পদ্মা সেতু নির্মাণে হোঁচট খাওয়ার কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে দায়ী করা হয়। এক্ষেত্রে সব থেকে বেশি দোষারোপ করা হয় দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা বিশ্বকে। এছাড়া দেশীয় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বলে সরকারি দল থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ এসেছে। 

মুখ ফিরিয়ে নেয় বিশ্বব্যাংক
পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংক। ঋণচুক্তির পাঁচ মাসের মাথায় দুর্নীতির অভিযোগ এনে ২০১১ সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করে। দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিষয়ে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম আসে। 

দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ওপরও। অন্য দাতা সংস্থাগুলোও বিশ্বব্যাংকের পথে হাঁটে। ঋণচুক্তি স্থগিতের সময় ঋণ পুনর্বিবেচনার জন্য দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ চারটি শর্ত জুড়ে দেয় বিশ্বব্যাংক। এসময় দুই দফায় বিশ্বব্যাংক ‘দুর্নীতি’র কিছু তথ্য-প্রমাণও দেয় বাংলাদেশকে। 

সরকারের পক্ষ থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে নানা দেন-দরবার চলতে থাকে। চুক্তি বাতিল এড়াতে এসময় যোগাযোগ সচিবকে সরিয়ে দেওয়াসহ কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপও নেয় সরকার। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেগুলো সন্তোষজনক ব্যবস্থা ছিল না। ফলে ২০১২ সালের ২৯ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয় আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি।

তবে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুললেও কানাডার আদালতে তার কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি বিশ্বব্যাংক। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কানাডার আদালত জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গ ড. ইউনূস 
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল হওয়ার পেছনে নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের হাত ছিল বলে সরকারের পক্ষ থেকে বার বার অভিযোগ তোলা হয়েছে। দলটির দাবি, বয়সের কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থাকতে না পেরে ড. ইউনূস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে ঋণ চুক্তি বাতিলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। 

রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি
পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করতে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিও নানা অপতৎপরতা চালিয়েছে বলে বার বার অভিযোগ তুলেছে আওয়ামী লীগ। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশি প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঋণচুক্তি যাতে পুনর্বিবেচনা না হয় সেই তদবির চালায় বিরোধীরা। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। তারা অপপ্রচারসহ নানা গুজব ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

বার বার পিছিয়েছে
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে বার বার পিছিয়েছে এর কার্যক্রম। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। ২২টি খুঁটির (পিলার) পাইলিংসংক্রান্ত নকশা সংশোধন, নদীশাসন কাজে বিলম্ব এবং নদীভাঙন ও প্রবল স্রোতের কারণেও কাজ পিছিয়েছে। 

মূল সেতুর কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। নদীশাসনের কাজ করেছে চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। 

তাদেরকে কাজ শুরুর চিঠি দেওয়া হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। পরবর্তী চার বছরে ২০১৮ সালে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কাজ পিছিয়ে ২০২০ সালে তা সম্পন্ন হলো। 

ব‌্যয় বেড়েছে তিনগুণ
পদ্মা সেতু নির্মাণে শুরুতে ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও সর্বশেষ তা তিনগুণ বেড়ে ব্যয় আপাতত দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায়। ২০০৭ সালে একনেক ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কয়েক দফা নকশা পরিবর্তনে এর দৈর্ঘ্য ও ব্যয় বাড়তে থাকে। 

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার উন্নীত করে এর সংশোধিত প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে আবারও ৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ে। এর ফলে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সর্বশেষ আরও ১৪শ কোটি টাকা বেড়ে তা ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

সেতু বিভাগ জানিয়েছে, প্রকল্পের মূল ডিপিপি’তে ১ হাজার ৫৩০ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ধরা ছিল ১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। কিন্তু মোট ভূমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে ২ হাজার ৬৯৮ হেক্টর। অতিরিক্ত জমি বাবদ মোট ব্যয় প্রয়োজন হয়েছে ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। এসব কারণেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে ভূমিসহ অধিগ্রহণ বাবদ আরও এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হয়েছিল।

আরও যেসব খাতে ব্যয় বাড়তে পারে
সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় তাদের লোকবল বসিয়ে রাখার জন্য খরচ চাইছে মূল সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এটাকে ম্যানেজমেন্ট কস্ট বলে। 

এ ক্ষেত্রে মূল সেতুর ঠিকাদার দিনে ৩৯ লাখ টাকা দাবি করছে। কিন্তু সেতু বিভাগ বলছে, তারা ২৮ লাখ টাকা দেবে। এখনও দর-কষাকষি চলছে। দৈনিক ৩০ লাখ টাকায় রফা হলেও ঠিকাদারকে ২৮৫ কোটি টাকা বাড়তি দিতে হবে।

এছাড়া বাড়তি সময় ভারী যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে পড়ে থাকার কারণে বাড়তি খরচ চাইছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এমন তিন শতাধিক দাবি (ক্লেইম) আছে ঠিকাদারের। এগুলো নিষ্পত্তি করতে হবে। একইভাবে নদীশাসন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারকেও নদীর তলদেশে ৩০ লাখ বালুর বস্তা ফেলার খরচ দিতে হবে। নদীভাঙন মেরামতেরও খরচ চাইছে তারা।

বছর বছর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেলে ঠিকাদারকে বাড়তি টাকা দিতে হয়। এ জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা ধরা আছে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ যেভাবে বাড়ছে, তাতে এ টাকায় কুলাবে না বলে মনে করছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।

এছাড়া ঠিকাদারের ভ্যাট ও আয়কর ৪ শতাংশ বেড়েছে। বিদেশি পরামর্শকদের ভ্যাট ও কর বেড়েছে ১০ শতাংশ। দেশীয় পরামর্শকদের ভ্যাট ও কর বেড়েছে ২ শতাংশ। এ তিন খাতে ভ্যাট ও কর বাবদ ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ৬৮৬ কোটি টাকা। এগুলো সামনে যোগ করতে হবে।

গ্যাসলাইন বসানো বাবদ যে খরচ ধরা হয়েছে, তা থেকে কিছু টাকা বেঁচে যাবে। তবে ৪০০ কেভি বিদ্যুতের লাইন বসানোর কাজে ব্যয় বাড়বে। ইতোমধ্যে যেসব খরচ বেড়েছে, সামনে যা বাড়বে, সব মিলিয়ে আরেক দফা প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করতে হবে।

এত কিছুর পরও অবশেষে আলোর মুখে দেখেছে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এখন নির্বিঘ্নে সেতুটি চালু হওয়ার অপেক্ষা।

পড়ুন : যেভাবে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে পদ্মা সেতু

ঢাকা/সনি/সাইফ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়