রান্না ঘরে গৃহকর্মীর নীরব কান্না
নিপা’র বয়স ১১। বাবা মানসিক প্রতিবন্ধী। মা দুই বছর আগে অন্যত্র বিয়ে করেন। দুইবোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে নিপা মেঝো। অভাব অনটনের কারণে নিপা কাজ নেন এক চিকিৎসক দম্পতির বাসায়। কথা ছিলো নিজ সন্তানের মতো নিপাকে দেখে রাখবেন তারা। কিন্তু সেই কথা রাখেননি।
কাজে সামান্য ভুল করলে তার ওপর চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন। গরম খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো। ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না। বাসার মধ্যে আটকে রেখে প্রতিদিনই তাকে মারধর করা হতো। গলা টিপে ধরতো। নির্যাতনে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হয়। নির্যাতনের কারণে গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে অভিযুক্ত চিকিৎসক দম্পতিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চলতি বছরের শুরুর দিকে গৃহকর্মীর নিপা বাড়ৈ’র ওপর নির্যাতনের এই ঘটনা নাড়িয়ে দেয় সমাজের বিবেকবান মানুষের অন্তরাত্মা।
নিপা বাড়ৈ’র ওপর নির্যাতনকারীর বিচার হলেও বাসায় বাসায় গৃহকর্তাদের নির্যাতন সহ্য করে এমন অসংখ্য নিপা দিনের পর দিন টিকে থাকেন। অবিচার সহ্য করেই সংসারের পুরো দায়িত্ব নিয়ে সারাদিনই ব্যস্ত থাকতে হয় তাদের। তবুও একটু এদিক-সেদিক হলেই বাসায় চলে মালিকের বকাঝকা, নির্যাতন। নির্যাতনের প্রায় ৯০ ভাগ ঘটনা নানাভাবে চাপা পড়ে যায়। হত্যাকাণ্ড ঘটলে বা মুমূর্ষু অবস্থায় কোনো গৃহকর্মী হাসপাতালে ভর্তি হলেই কেবল তা প্রকাশ পায়। নির্যাতনকারীদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার করা হলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
সারা দেশে গৃহকর্মীর সংখ্যা ঠিক কত, এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে আইন ও সালিশ কেন্দ্র মনে করে, এই সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশি। তবে অন্যান্য সংগঠনের মতে, সংখ্যাটি ২০ লাখের মতো হবে।
দেশের জিডিপিতে অদৃশ্যভাবে অর্থনৈতিক অবদান রাখলে নিপাদের এই বিরাট অংশের গৃহশ্রমকে সেভাবে মুল্যায়ন করা হয় না। স্বীকৃতি তো দুরের কথা উল্টো এই শ্রমিকরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হন। তারা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন, কিন্তু তাদের সঙ্গে অন্যায় কিছু হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নীরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। নীতিমালা থাকলেও আইন না থাকায় এবং তাদের শ্রমের মুল্যায়ণ না থাকার কারণে দিনের পর দিন ‘ক্রীতদাস’ হয়ে থাকেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করলেও মজুরি হিসেবে যা পান তা উল্লেখ করার মতো না। ঘুমানোরও জায়গা নেই, রান্না ঘরই তার ঘর। খাবারও জোটে সবার পরে। একপ্রকার অবহেলিত ঝূঁকিপূর্ণ জীবন তাদের।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের বয়সভিত্তিক গৃহশ্রমিক দুর্ঘটনা ও নির্যাতনের চিত্রে দেখা গেছে, নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীদের প্রায় ৮০ শতাংশই শিশু। গত এক বছরে ৬০টি গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় ৪৭ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এর মধ্যে ২৩টি ঘটনায় আক্রান্তের বয়স ৫ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। ২৬ জন গৃহকর্মী গৃহকর্মে নিয়োজিত অবস্থায় মারা গেছেন। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪২ জন। এ ছাড়া ১৫ জন গৃহকর্মী এই সময়ে আত্মহত্যা করেছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, প্রতি বছর গড়ে ৩০ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের কারণে মারা যাচ্ছেন। বিভিন্নভাবে নির্যাতিত কর্মীদের সংখ্যা কয়েকগুণ।
বিলসের যুগ্ম মহাসচিব মো. জাফরুল হাসান মনে করেন, গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ণ হলেও এখনো আগের মতো হত্যা, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় নীতিমালায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, আইন দরকার।
এ সম্পর্কে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যালএইড ইউনিটের পরিচালক অ্যাডভোকেট মাকসুদা আক্তার বলেন, ‘যারা আমাদের ঘরে কাজ করেন, তারা কিন্তু একপ্রকার আমাদের পরিবারের একজন হয়ে যান। কিন্তু আমরা সেইভাবে ভাবি না। তাদের ওপর নির্যাতন হয় অথচ তাদের ছাড়া আমাদের চলে না। এই যে তারা অন্যায়-অবিচারের শিকার হন এটি মূলত আইনের অভাবে। গৃহকর্মীদের নিরাপত্তায় আইন থাকলে এগুলো হতো না।’
‘সকাল থেকে রাত অবধি তারা কাজ করেন অথচ তাদের নিরাপত্তা নেই, ভালো বেতন নেই, অধিকার নেই, নীরবে নির্যাতন সয়ে যান, কাউকে বলতেও পারেন না। গৃহকর্মীরা যেভাবে কাজ করেন তাতে এ কথা বলা যায় আমাদের দেশে এখনো সেই দাসপ্রথা রয়ে গেছে। সময় হয়েছে তাদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার। তাদের মানবিক সুরক্ষা, নিরাপত্তা, অধিকার দেওয়া। নীতিমালা থাকলেই আইনের প্রয়োগ হয় না। এজন্য সুষ্পষ্ট আইন থাকতে হয়।’ -এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ডিরেক্টর প্রোগ্রাম নিনা গোস্বামী বলেন, ‘বেশিরভাগক্ষেত্রে বাসায় ২৪ ঘন্টা একজন গৃহকর্মীকে কাজ করতে হয়। এই সময়ে কিন্তু তার কোনো অবসর সময় বা বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে না। কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে যায়, কিন্তু পেমেন্ট সেভাবে পায় না। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকার কারণে এই পরিস্থিতি।’
‘শুধু তাই না তারা কিন্তু বাসায়ও সুরক্ষিত থাকছে না। আমরা যখন গৃহকর্মীকে অন্য দেশে পাঠাচ্ছি তারা কিন্তু অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতার কারণে ফেরত আসছে। কখনো কখনো লাশ হয়ে ফিরছে। ওখানেও যেমন নিরাপত্তা নেই, আবার আমাদের দেশে যখন এই কাজ করেন তখনও কিন্তু নিরাপত্তা থাকে না। দেখা যায় তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ছ্যাঁকা দেওয়া, গরম পানি দেওয়া, চুল কেটে দেওয়া- তো অহরহ হচ্ছে।’ -গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় একটি সুনির্দিষ্ট ওয়েলফেয়ার ফোরাম দরকার বলেও মনে করেন নিনা গোস্বামী।
তিনি বলেন, ‘একটি আইনও দরকার। অর্থাৎ বাড়ি বাড়ি গিয়ে একটা সার্ভে করা দরকার। স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের রিপোর্ট হওয়া দরকার। শ্রম আইনে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি থাকলেও নানা সমস্যার কারণে সেটি হয়নি। তবে ওয়েলফেয়ার করার সম্ভব। গৃহশ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম থেকে এটা করা হলে তাদের জন্য ভালো হবে।’
২০১১ থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে ৯ বছরে ২৬৯ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন। আর নির্যাতিতের সংখ্যা ৪৯১ জন। এর মধ্যে ৫ থেকে ১২ এবং ১২ থেকে ১৮ বয়সের গৃহকর্মীর নির্যাতনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ।
বিলসের তথ্যে, ২০১১ সালে মারা গেছেন ৩৮ জন। নির্যাতিত ২০ জন। ২০১২ সালে নিহত ৪৬ জন, নির্যাতিত ৩২ জন, ২০১৩ সালে নিহত ৩২ জন, নির্যাতিত ২৪ জন, ২০১৪ সালে নিহত ২৭ জন, নির্যাতিত ২৮ জন; ২০১৫ সালে নিহত ৩৯ জন, নির্যাতিত ৩৯ জন, ২০১৬ সালে নিহত ৩৮ জন, নির্যাতিত ২৩ জন, ২০১৭ সালে নিহত ২৭ জন, নির্যাতিত ২৩ জন, ২০১৮ সালে নিহত ১৭ জন, নির্যাতিত ২৪ জন এবং ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত ৫ জন ও নির্যাতিত ৯ জন। এর মধ্যে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সের গৃহকর্মী মারা গেছে সবচেয়ে বেশি ৭২ জন।
বিলস বলছে, এটা উদ্বেগজনক চিত্র। সার্বিক চিত্র এই সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। অনেক নির্যাতনের ঘটনা পত্রিকার পাতায় স্থান পায় না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে বিভিন্নভাবে ২৮৬ জন গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার শিকার হন। তাদের মধ্যে ১৮৩ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ২৮৬টি ঘটনার মধ্যে থানায় মামলা হয় মাত্র ১২২টি। শারীরিক নির্যাতনে ৩২ জন এবং অজ্ঞাত কারণে ১১৭ জন সহ মোট ১৪৯ জন গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়।
গৃহকর্মীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে উল্লেখ করে শ্রমিক নেতা মোশারেফা মিশু বলেন, ‘গত এক বছরের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে নির্যাতন কমেনি। এজন্য গৃহশ্রমিক সুরক্ষা আইন দরকার। সেই সঙ্গে আইনের বাস্তবায়ন দরকার। তদারকি এবং নিরাপত্তা না থাকায় একের পর এক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। বেশিরভাগ ঘটনার কোনো বিচার হয় না। আবার অনেক ঘটনা অজানাই থেকে যায়। এই বিষয়ে সরকারের নজর দিতে হবে।’
গার্মেন্ট শ্রমিকদের থেকেও গৃহকর্মীদের অর্থনৈতিক অবদান বেশি উল্লেখ করে নারী অধিকার কর্মী মার্জিয়া প্রভা বলেন, ‘গৃহশ্রমকে কিন্তু আমাদের দেশে ইনফরমাল পেশা হিসেবে দেখা হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর জিডিপিতে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার অবদান থাকলেও সেটি অদৃশ্য। বাংলাদেশে একটি বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি ইনফরমাল হচ্ছেন গৃহশ্রমিকরা। গার্মেন্ট শ্রমিকরা যে কাজ করেন তার চেয়ে কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে বেশি কাজ করেন গৃহকর্মীরা। ধীরে ধীরে সেটি আরো বাড়ছে। কিন্তু তাদের কোনো স্বাস্থ্যগত পলিসি নেই, মজুরিগত পলিসি নেই। যৌন হয়রানি হলে বা নির্যাতনের শিকার হলে তারা কোথায় যাবে, সেই পলিসি নাই। এই অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারের এই দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘নারী ক্ষমতায়নের কথা যদি আমি বলি তাহলে এই বড় একটি ইন্ডাস্ট্রিকে বাদ দিয়ে সেটি দাবি করতে পারবো না। এজন্য আলাদাভাবে গৃহকর্মী নীতিমালা তৈরি করতে হবে। পৃথকভাবে আইন রাখতে হবে। বর্তমানে কোনো প্রচলিত আইনের মধ্যেও যদিও এটা করা যায়, তাহলে সেটি উল্লেখ থাকতে হবে। কিন্তু একটি পলিসি থাকতে হবে। যত বাসায় গৃহকর্মীরা কাজ করেন সব বাসায় যাতে পলিসিগুলো যাতে মেইনটেইন করতে হয় সেজন্য একটি মনিটরিং সেল থাকতে পারে।’
## ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের তথ্যে গড়মিল, বাস্তবায়নে কচ্ছপ গতি
## শাকিবের ছোট কাঁধে বড় দায়িত্ব
## করোনায় বিপাকে শিশু শ্রমিকরা
## মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষ, মুজিববর্ষে গড়বো দেশ: মহান মে দিবস আজ
## করোনায় শ্রমজীবী মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান রাষ্ট্রপতির
##‘সরকার শ্রমজীবী মানুষের জন্য সর্বাত্মক কার্যক্রম চালাচ্ছে’
ঢাকা/টিপু
আরো পড়ুন