ভারী শিল্পে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম
মো. রায়হান (৯)। জীবনের মানে বুঝে উঠার সময় হয়নি। তবে কাঁধে পড়েছে পরিবারের বোঝা। শিশু হলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওয়ার্কশপে কাজ করে। সারা বছর ঘাম ঝরানো শ্রম দিয়ে আসলেও মে দিবস কি তা তার জানা নেই বলে রাইজিংবিডিকে জানিয়েছে সে।
রায়হান বলে, সদরঘাটে মা দুই ভাই-বোনকে নিয়ে থাকি। মা বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। মা যায় পায়, আর নবাবপুরের একটি ওয়ার্কশপে কাজ করে পাওয়া মাসিক ৩ হাজার টাকা বেতন নিয়ে কোনভাবে চলে যাচ্ছে আমাদের পরিবার। সকাল থেকে বিকেল ৫টা কিংবা কোন কোন দিন রাত ১০টাও বেজে যায় মেশিন কাজ শেষ করতে।
ওয়াইজঘাটে ৩ বছর ধরে জাহাজ শিল্প নির্মাণে কাজ করছে হেমায়েত হোসেন নামে ১০ বছরের এক শিশু। সে বলে, ‘৪ হাজার টাকা মাসে মাইনে পাই। এ টাকা নিয়ে মায়ের কাছে দিয়া দিই। মায়ের ঘর ভাড়া থেকে সবকিছুই করে’।
তোমার তো এ বয়সে স্কুলে যাওয়ার কথা-এ প্রশ্নে হেমায়েত বলে, ‘পড়ালেখা করতে অনেক টাকা দরকার, কে দিবো, বাবা রিকশা চালায়’।
শুধু এই দুই শিশু নয় পুরান ঢাকার অনেক স্থানে কর্মরত আরও অনেক শিশু শ্রমিককে শ্রমিক দিবসের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা এর কোনো উত্তর দিতে পারেনি।
সরেজমিন নবাবপুর, লালমোহন সাহা দাস লেন, টিপু সুলতান রোড, বলধা গার্ডেন সংলগ্ন এলাকাসহ আশেপাশের বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে ৮ থেকে ১০ বছরের শিশুরা ভারি যন্ত্রপাতি নিয়ে ঝালাই কিংবা মেটালের মতো বস্তু তৈরির কাজ করছে। এছাড়া শিশুদের দিয়ে জাহাজশিল্প থেকে শুরু করে ওয়েল্ডিং, টিভি, ফ্রিজ, এসির কাজ, শিল্প কারখানা, মোটরসাইকেলের গ্যারেজে, ট্যানারি, কৃষি খাত, রেস্টুরেন্ট অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, ব্যাটারি কারখানা, ইটভাটা কামারের দোকান, মুদ্রণ কারখানা, রিকশা-ভ্যান অটো চালানোসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। বাস-লেগুনা থেকে শুরু করে ঘোড়ার গাড়ি, নসিমন, টমটমেও শিশুরা হেলপার ও কন্টাক্টরের কাজ করছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, শিশুশ্রম অন্যায় এবং আইন বিরোধী। কিন্তু তারপরও মানবিক কারণে এসব শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হয়। যে পয়সা তারা পায়, তা দিয়ে পরিবারের কাজে লাগে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিপু সুলতান রোডের একজন ওয়ার্কশপ মালিক রাইজিংবিডিকে বলেন, এলাকায় দেড় থেকে দুই শতাধিক ছোট-বড় ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়াকশপ রয়েছে। যেখানে প্রায় ৫ শতাধিক শিশু শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। পাশাপাশি তাদের অনেকেই এ পেশায় না থাকলে বিপথগামীও হতে পারতো। অনেকেই মাদকাসক্ত কিংবা ভবঘুরে হয়ে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যেত। সেক্ষেত্রে এ পেশা তাদের ঝুঁকি হলেও বেঁচে থাকার অবলম্বনও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অল্প পয়সায় অধিক লাভের আশায় একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা শিশুদের দিয়ে ভারি শিল্পে প্রতিনিয়ত কাজ করাচ্ছেন। বিনিময়ে তাদের নামমাত্র মজুরি দেওয়া হচ্ছে। শিশু শ্রম আইনে সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হলেও ব্যবসায়ীরা সার্বক্ষণিক তাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন ভারি শিল্প থেকে বাসাবাড়ি, এমন কোন জায়গা নেই যেখানে শিশু শ্রমিক পাওয়া যাবে না। আর ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজ করতে গিয়ে শিশুরা আহত, বিকলাঙ্গ, পুড়ে যাওয়াসহ নানা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকার বা প্রশাসনকে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, দেশে যেন শিশুশ্রম বন্ধ হয় সেজন্য ২০১৬ সালের শিশুশ্রম নিরসনে একটি একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সাফল্য অর্জিত না হওয়ায় এখনো শিশুশ্রম অব্যাহত আছে। যা সমাজকে বিপথে ঠেলে দেওয়ার সামিল।
শিশুশ্রম নিয়ে কাজ করা সৈয়দ সুলতান আহমেদ বলেন, শিশুশ্রম বন্ধ করতে না পারলে আগামী প্রজন্ম যথাযথভাবে গড়ে উঠবে না। তারপরও তাদের দিয়ে যদি ভারী শিল্পে ব্যবহার করা হয় সেক্ষেত্রে তাদের শুধু মানসিক বিকাশে নয় এবং শারীরিকভাবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। এজন্য শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার এখনই সময় বলে তিনি মনে করেন।
মাকসুদ/সাইফ
আরো পড়ুন