নিঃস্ব থেকে ঘরের মালিক বীরাঙ্গনা শীলা গুহ
এসকে রেজা পারভেজ, শ্রীমঙ্গল থেকে || রাইজিংবিডি.কম
মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতেন বীরাঙ্গনা শীলা গুহ। একবেলা খেতেন তো আরেক বেলা থাকতেন উপোস। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। মাস পেরোলে বাড়িভাড়া দেওয়াটাই বড় চিন্তার কারণ। সময়মতো টাকা দিতে না পারায় শুনতেন গালাগাল। সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করতেন আর কাঁদতেন। এবার দুঃখের বদলে সুখের দিন গণনা শুরু করেছেন শীলা গুহ।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে ‘শেখ হাসিনা মডেল আশ্রয়ন’ প্রকল্পের আওতায় ঘর পেয়েছেন সবহারা এ মানুষটি। ঘর পেয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত শীলা গুহ এখন স্বপ্ন দেখেন সুন্দর ভবিষ্যতের।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আশ্রয়ন প্রকল্পের’ মাধ্যমে জমির সঙ্গে স্থায়ী পাকা ঘরের মালিকানা দেওয়ার যে কর্মসূচি শুরু করেছেন, তার অংশ হিসেবে রোববার ৫৩ হাজার ৩৪০টি পরিবার পেয়েছে নতুন ঘর। এসব ভূমিহীন পরিবারকে শুধু নতুন ঘরের চাবিই দেননি বঙ্গবন্ধুকন্যা, সেই সঙ্গে দিয়েছেন জমি ও ঘরের স্থায়ী মালিকানা।
সকাল সাড়ে ১০টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঘর ও জমি প্রদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের মাইজদিহি গ্রামে উপকারভোগী ১১৮ জনের ঘরের চাবি ও জমির দলিল তুলে দিতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী ওই এলাকার একজন উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলতে চান। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন বীরাঙ্গনা শীলা গুহ।
অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিঃস্ব ওই মানুষটি। প্রধানমন্ত্রীও অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। বীরাঙ্গনা শীলা গুহ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কান্না সবাইকে আবেগময় করে তোলে।
শিলা গুহ বলেন, ‘যুদ্ধের সময়েও বুঝিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেষ বয়সে আমাদের দেখে রাখবেন। স্বর্গ থেকে বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গমাতা আজ এই খুশির মুহূর্তটি দেখছেন এবং তাদের আত্মা শান্তিতে ভরে উঠছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেন করোনাভাইরাস কিংবা কোনো বিপদ আক্রান্ত করতে না পারে, এজন্য তিনি প্রতিদিন দুই টাকার মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করে আসছেন বলেও জানান শীলা গুহ।
প্রধানমন্ত্রীকে শ্রীমঙ্গলে তার দেওয়া ঘর দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান শীলা গুহ। তিনি আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী সেখানে গেলে তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সাতকরা দিয়ে তাকে তরকারি রান্না করে খাওয়াবেন।
শীলা গুহ রাইজিংবিডিকে শোনান তার জীবনকাহিনী। একাত্তরে বীরাঙ্গনা হয়ে কিভাবে পরিবার ও সমাজবিচ্যুত হয়ে জীবনসংগ্রাম করেছেন, তা তুলে ধরেন তিনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি কি ইচ্ছে করে বীরাঙ্গনা হয়েছি? তাহলে কেন সমাজ আমাকে সমাজে থাকতে দিলো না।’
বীরাঙ্গনা হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা তাদের সঙ্গে শীলা গুহকে রাখেনি। তাকে বলা হয়েছিল, ‘তোমাকে সাথে রাখলে সমাজ আমাদের একঘরে করে রাখবে। তোমার ছোট্ট বোনের বিয়ে হবে না।’
পরিবার সে আঘাত ক্ষত-বিক্ষত করে শীলার জীবন। তার কাছে মনে হয়েছিল, বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকুও বোধ হয় হারিয়ে গেলো। তবুও জীবনের কাছে হেরে যাননি শীলা।
শীলা গুহ জানান, বেঁচে থাকতে সংগ্রামের পথ বেছে নেন তিনি। যাত্রাদলে কাজ শুরু করেন। ঘুরে বেড়ান এখানে-সেখানে। সেখানেই পরিচয় থেকে হয় প্রণয়। ভালোই কাটছিলো শীলার সাংসারিক জীবন। কিন্তু দুই বছরের মাথায় ছেদ পরে সুখের সংসারে। স্বামী জানতে পারেন, তিনি বীরাঙ্গনা। স্বামীও তাকে ছেড়ে চলে যায়। ছোট্ট দুই মেয়েকে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখেন শীলা গুহ। আবারও যোগ দেন যাত্রাদলে। এরপর শুধুই সংগ্রাম আর লড়াইয়ের গল্প।
বাগেরহাটের মেয়ে শীলা ঘুরতে ঘুরতে চলে আসেন শ্রীমঙ্গলে। কখনো ছোটখাটো কাজ করে, কখনো ভিক্ষা করে জীবন চালাচ্ছিলেন তিনি। এরই মধ্যে স্বপ্নের উপহার হয়ে আসে ‘শেখ হাসিনা মডেল আশ্রয়ন প্রকল্প’। এই প্রকল্পের আওতায় আশিরদ্রোন ইউনিয়নের মহাজিরাবাদ গ্রামের ঘর পান শীলা গুহ।
শীলা গুহ এখন স্বপ্ন দেখেন স্বচ্ছল জীবনের। কিন্তু এই বীরাঙ্গনা এখনও স্বীকৃতি পাননি। এ নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও তিনি বিশ্বাস করে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকলে তিনি সব পাবেন।
শীলা জানান, ঘরের চারপাশে শাকসবজির গাছ লাগাতে চান তিনি। হাস-মুরগি পালন করতে চান।
জীবনের বাঁকে বাঁকে দুঃখ-দুর্দশা আর সংগ্রাম করতে করতে শেষ বয়সে এখন বড় ক্লান্ত তিনি। জীবন সায়াহ্নে একটু শান্তি আর সুখের স্বপ্ন দেখাচ্ছে শেখ হাসিনার দেওয়া এই ঘর!
পারভেজ/রফিক
আরো পড়ুন