ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘সেদিন মরে গেলেই ভালো হতো’

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১১, ২১ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১২:১৫, ২১ আগস্ট ২০২১
‘সেদিন মরে গেলেই ভালো হতো’

রাশিদা আক্তার রুমা

১৭ বছর আগে আজকের দিনে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন রাশিদা আক্তার রুমা। বছরের পর বছর ধরে শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গে লড়তে লড়তে তিনি এখন ক্লান্ত। শরীরের ভেতরে থাকা স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা বোঝাতে গিয়ে বলেন, ‘সেদিন মরে গেলে ভালো হতো। তাহলে আমার বাচ্চারা আর পরিবারকে এত কষ্ট করতে হতো না।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর থেকে প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন, জানিয়ে রুমা বলেন, ‘এখন শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপের দিকে। মাঝে মাঝে প্রস্রাবে রক্ত যায়। শরীর ফুলে যায়। ডাক্তাররা বলছেন, কিডনিতে সমস্যা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল, করোনার কারণে ভর্তি হইনি।’

উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কয়েকজন ভুক্তভোগী মিলে অনুরোধ জানিয়েছি, উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠাতে। দুই-চারটি অপারেশন আছে। এগুলো করা না হলে আমার শরীরে ইনফেকশন হবে। আমার শরীরের ভেতর যে রডগুলো আছে, তা বের করা হয়নি। গ্রেনেডের স্প্লিন্টার বের করতে হলে জার্মানি যেতে হবে।’

‘বাংলাদেশে এর যথাযথ চিকিৎসা নেই। ওষুধ খেয়ে খেয়ে স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ন্ত্রণে রাখছি। অপারেশন না হওয়ায় কিছুদিন আগে সেলিম ভাই (২১ আগস্টে আহতদের অন্যতম) মারা গেছেন...। এভাবে আমাদের ৭-৮ জন মারা গেছেন, যারা ২১ আগস্টের ভুক্তভোগী।’

সেদিন অন্য নেতাকর্মীদের মতো রাশিদা আক্তার রুমাও গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় যোগ দিতে।

সে দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই দিন সমাবেশে জয় বাংলা বলে আপা (শেখ হাসিনা) নামতে যাবেন, এমন সময় বিকট শব্দ। এরপর কোথায় যেন উড়ে গিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ পড়ে ছিলাম, জানি না। সন্ধ্যার দিকে আমার কানে কোলাহলের শব্দ এলো। তখন আমি চোখ খুলে দেখি রক্ত আর রক্ত। আমার আঙুল, বাম হাত, দুটো পা ভেঙে গিয়েছিল। পা ভেঙে হাড় বাইরে বেড়িয়ে গিয়েছিল। হাতির পায়ের মতো ফুলে গিয়েছিল আমার পা দুটো। 

‘পরে আমি আমার বাম হাতের ওপর ভর দিয়ে কোনোরকমে উঠে দেখি, আইভি আন্টি ওখানে পড়ে আছেন। আমি ওনার পাশেই ছিলাম। আমি উঠে যে কাউকে কিছু বলব, তা পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর মাথা ঘুরে পড়ে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। পরে কেউ একজন আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।’

প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা ২১ আগস্টে আহতদের খোঁজ-খবর নিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রাখলেও দলীয় অন্য নেতারা এ বিষয়ে নীরব বলে অভিযোগ করেন রাশিদা আক্তার রুমা।

‘আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে যখন, তখন আমরা সার্বিক ট্রিটমেন্ট পেলাম। আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে দেশের বাইরে পাঠানো হলো। কিন্তু এখন দল ক্ষমতায়… যখন রুহুল হক স্যার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন, তার কাছে আবেদন দিলাম, স্যার আমাদের বাইরে পাঠান। আমাদের নেত্রী টাকা দেবেন কোনো মন্ত্রী তো টাকা দেবের না, কিন্তু রুহুল হক স্যার পাঠাননি তখন। তারপর নাসিম ভাইয়ের (সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম) কাছে আবেদন দিলাম, তিনিও সেটা করেননি। এখনও যিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী আছেন, তার কাছেও গিয়েছিলাম। তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন, দেখি। পর পর তিন বার আমরা ক্ষমতায়, কিন্তু আমরা তেমন ট্রিটমেন্ট পাচ্ছি না। দেশে চিকিৎসা পাচ্ছি, কিন্তু উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হচ্ছে না। সেটাই আমাদের দুঃখ।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের নেত্রী, উনি একা কত দিক দেখবেন। আপা নিজেও তো সেই ঘটনায় আহত হয়েছেন। তিনি আমাদের খেয়াল করেছেন, চিকিৎসা দিয়েছেন। যেমন আমাদের ট্রিটমেন্ট দিচ্ছেন। ওষুদের জন্য ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের ওষুধ লাগছে ১০-১২ হাজার টাকার। যে এফডিআর করে দেওয়া হয়েছিল, তা থেকে আমরা মাসে পেতাম ১০ হাজার ৬০০ টাকা। এখন পাই ৮ হাজার ৬০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে আমাদের সবার চলে না। ৫ হাজার টাকা দিয়ে সব ওষুধ কেনা যায় না। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বোঝাতে পারছি না যে, এটা আপনার দায়িত্ব।’

‘নেত্রী আমার জন্য অনেক করেছেন। এরপরও নিজের প্রায় ২০-২৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ১৭টি অপারেশন আমার নেত্রী করিয়েছেন। বাকিগুলা আমি নিজের খরচে করেছি। বাংলাদেশে এমন কোনো হাসপাতাল নেই, আমি ছিলাম না। ট্রমাতে আমার তিনটি অপারেশন হয়েছে। বাংলাদেশ হসপিটালে একটি, শিকদার মেডিক্যালে একটি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যালে তিনটি, সিএমইএচে একটি অপারেশন হয়েছে। কিছু টাকা আপা দিচ্ছেন, কিছুটা আমাদের বহন করতে হচ্ছে। আমার বাচ্চাদের কষ্ট হচ্ছে। ট্রিটমেন্টের জন্য দেশের বাইরে যাওয়াটা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।’

রুমা বলেন, ‘২৪ ঘণ্টা ওষুধ খেয়ে থাকতে হয়। প্রতিটা দিন ৩০-৩৫টা ট্যাবলেট খেতে হয়। স্প্লিন্টার শরীরে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া করে। দিনে ৪-৫ বার গরম পানি করে শরীরে ঢালতে হয়। না ঢাললে পোকার মতো হাঁটতে শুরু করে। চুলকাতে চুলকাতে রক্ত বের হয়ে যায়। গরমের দিন আসলে এটা হয়। রাতে যন্ত্রণা করে খুব বেশি। পা অবশ হয়ে যায়।’

‘আমরা সেদিন মরে গেলে ভালো হতো। তাহলে আমার বাচ্চাদের এত কষ্ট করতে হতো না। যে বয়সে বাচ্চারা পড়াশোনা করে, সেই বয়সে আমি বাচ্চা দুটোর বিয়ে দিয়েছি। কারণ, বাই চান্স আমার কিছু হয়ে গেলে…। চাচা, ফুপু আছে, তারা কতদিন দেখবে। তারা নিজেদের দেখবে নাকি বাচ্চাদের দেখবে। সেজন্য আমি আমার বাচ্চাদের বিয়ে দিয়েছি। এজন্য আমার নেত্রী আমাকে বকাও দিলেন যে, তোমার বিরুদ্ধে বাল্যবিবাহ মামলা করব। আমি বললাম, আপা আমি যদি মারা যাই, আমার বাচ্চাদের দেখবে কে? সেজন্য বিয়ে দিয়েছি।’

দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘অনেক নেতাই তো সেদিন আহত হয়েছেন, তারা কি বোঝেন না? আমরা যারা সেদিন আহত হয়েছি, আমাদের প্রত্যেকেরই এলাকায় এমপি আছেন, তারা কখনো কোনো সহায়তা করেননি। তাহলে এই যে ত্যাগ স্বীকার করলাম, কাদের জন্য বলেন? আমাদের অসুখের সময় যদি কোনো এমপি না আসে, আমাদের বলার কিছুই নেই।’

 

আরও পড়ুন: ‘সবাই ভেবেছিলেন, আমি মারা গেছি’

রক্তে ভেজা বর্বরোচিত ২১ আগস্ট আজ

পারভেজ/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়