ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

৮ ফসলের জাত উন্নয়নে আফতাব বহুমুখী ফার্ম

কিশোরগঞ্জ থেকে ফিরে, হাসিবুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ২০ জানুয়ারি ২০২২  
৮ ফসলের জাত উন্নয়নে আফতাব বহুমুখী ফার্ম

কৃষি গবেষণা, সম্প্রসারণ, জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে আফতাব বহুমুখী ফার্ম লিমিটেড। দেশের ঐতিহ্যবাহী ও শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ইসলাম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানটি ৮টি ফসলের মোট ৪১০ প্রজাতির জাত উন্নয়নে গবেষণা করছে। 

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর ছাড়াও তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রথমিক পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিকট অনুমোদনের মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করবে আফতাব বহুমূখী ফার্ম।

গবেষণাকৃত ৮টি ফসলের মধ্যে ৮০ প্রজাতির ধান, ৯ প্রজাতির ভুট্টা, ১১২ প্রজাতির টমেটো, ৯ প্রজাতির করলা, ৫ প্রজাতির লাউ, ৮ প্রজাতির শসা, ৩১ প্রজাতির পেঁয়াজ ও ১৫৬ প্রজাতির পেঁপে রয়েছে। 

এসব জাত উন্নয়নের জন্য ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইআরআরআই), বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই) বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চীনা গবেষণা ভিত্তিক কোম্পানি, থাইল্যান্ড ভিত্তিক কোম্পানি ও ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

সম্প্রতি গবেষণা কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করে দেখা গেছে, এসব গবেষণায় অভূতপূর্ব সফলতা এসেছে। সফলতার ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটি কিছু মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসব জাত অনুমোদন পেলে বাংলাদেশের কৃষিতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে আফতাব বহুমুখী ফার্ম লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপক (বীজ) মো. ফজলুল হক বলেন, ‘আমরা লবণ ও জলবায়ু সহিষ্ণু বিভিন্ন ফসলের জাত উন্নয়নে কাজ করছি। এটি দেশের খাদ্য উৎপাদনকে সমৃদ্ধ করবে একই সঙ্গে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখবে।’ 

শীত কিংবা গ্রীষ্ম সব সময়ই বাজারে পাওয়া যায় গুণে মানে সমৃদ্ধ ফল পেঁপে। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করে যথার্থ ফলন পাচ্ছে না কৃষক। হাইব্রিড পেঁপের ফলন বেশি হলেও তাতে মিষ্টির পরিমাণ কম। এছাড়া দ্রুত পচনশীল ফল হওয়ার কারণে বেশিক্ষণ সংরক্ষণ করা যায় না। ফলে চাষীদের ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য পেঁপের জাত উন্নয়নে কাজ করছে আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড। পেঁপের ফলন ও মিষ্টির তিব্রতা বৃদ্ধি এবং পচনশীলতা রোধ করতে ১৫৬টি পেঁপের জাত উন্নয়নে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

আফতাব বহুমুখী ফার্ম লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপক (বীজ) মো. ফজলুল হক বলেন, ‘পেঁপেকে আমাদের দেশে অর্থকরী ফসল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে যেসব পেঁপে চাষাবাদ হচ্ছে সেগুলোর ফলন আশানুরূপ হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হলো নারী ও পুরুষ বীজের সংমিশ্রণ না হওয়া। বীজের মধ্যে যদি কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পুরুষজাতীয় বীজ না থাকে তাহলে কোনো কৃষক পেঁপে চাষ করে লাভবান হবে না। আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। আমাদের পেঁপের বীজের মধ্যে নারী-পুরুষ বীজের সংমিশ্রণ সঠিক পরিমাণে থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘বিদেশি জাতের পেঁপের ফলন বেশি হলেও দেশি পেঁপের তুলনায় মিষ্টির পরিমাণ খুবই কম। আমরা এটি নিয়েও কাজ করছি। আমাদের পেঁপের ফলন অনেক বেশি হবে একইসঙ্গে দেশি পেঁপের মতো মিষ্টি হবে।’

জলবায়ু সহিষ্ণু উচ্চফলনশীল পুষ্টিসমৃদ্ধ চিকন ধানের জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্য নিয়ে ৮০ প্রজাতির ধানের জাত উন্নয়নে কাজ করছে আফতাব বহুমুখী ফার্ম লিমিটেড। এছাড়া সুগন্ধী ধানের জাত উন্নয়নেও কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

ধানের জাত উন্নয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড সহকারী ব্যবস্থাপক (বীজ) মো. ফজলুল হক বলেন, ‘আগের থেকে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক ভালো হয়েছে। মানুষ এখন আর মোটা ধানের ভাত খেতে চায় না। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আমরা উচ্চফলনশীল মাঝারি চিকন থেকে চিকন জাতের উদ্ভাবনে কাজ করছি। আমাদের উদ্ভাবিত মাঝারি চিকন ধানের উৎপাদন অন্য সকল চিকন ধানের তুলনাই অনেক বেশি ফলন হবে। সেই সাথে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হবে।’

তিনি বলেন, ‘চিকন ধানের চাহিদা থাকলেও ফলন কম হওয়ার কারণে কৃষকরা চিকন ধান চাষ করতে আগ্রহী হয় না। এজন্য আমাদের লক্ষ্য চিকন ধানের জাতগুলোর ফলন বাড়ানো। চিকন ধানগুলো হেক্টরপ্রতি ১০টন বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণে উৎপাদন করাই আমাদের লক্ষ্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘‘আমাদের আরেকটি লক্ষ্য লবণ, জলবায়ু ও খরা সহিষ্ণু বিভিন্ন ধানের জাত উদ্ভাবন করা। কেননা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, শীতকালে পড়ছে না শীত এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে জমিতে লবনাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে।

‘এছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলের জন্য আমরা খরা সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করার উদ্যেগ নিয়েছি। বৃষ্টি না হলেও যেন ধানের ফলন কমে না যায় এমন জাত উদ্ভাবন করার লক্ষ্যে কাজ করছি।

‘অন্যদিকে আমরা সুগন্ধী জাতের ধান নিয়েও কাজ করছি। সুগন্ধী জাতের ধান সাধারণত হেক্টরপ্রতি ৩ টন উৎপাদন হয়। এজন্য এখন আর মানুষ সুগন্ধী ধান চাষ করতে চাই না। আমরা এই ধানের জাত নিয়ে আগে থেকেই কাজ করছি। ইতোমধ্যেই আমরা একটি সুগন্ধী ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি যেটার উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ৪.৯ টন। এটাকে আমরা আরও বেশি পরিমাণে উৎপাদনের জন্য কাজ করছি।”
১১২ প্রজাতির টমেটোর জাত উন্নয়নে কাজ করছে আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড। তাদের লক্ষ্য জলুবায়ু সঞিষ্ণু টমেটোর জাত উদ্ভাবন করা। একইসঙ্গে গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে চাষকৃত টমেটোর ফলনের পরিমাণ ঠিক রাখা।

টমেটোর জাত উন্নয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড সহকারী ব্যবস্থাপক (বীজ) মো. ফজলুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে বছরে দুইবার টমেটোর চাষ হয়। কৃষি গবেষণা কেন্দ্রর উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন টমেটো ক্ষেত্রে আমরা যেটা দেখতে পেয়েছি সেটির ফলন তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। বেশি তাপমাত্রা হলে এ টমেটোর ফুল আসে না। এজন্য ফলন কমে যায়। এতে কৃষকরা ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আমাদের টমেটো আকারে ও গুণমানে হবে অনন্য। এছাড়া অন্য টমেটোর চেয়ে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের টমেটোর বৈশিষ্ট্য হবে যেটি সেটি হলো, এই টমেটোগুলো গ্রীষ্মকাল ও শিতকাল দুই মৌসুমেই চাষযোগ্য হবে। একইসাথে দুই মৌসুমেই ফলনের পরিমাণ একই থাকবে। আমরা টমেটোর জলবায়ু সহিষ্ণু জাতের উদ্ভাবনে কাজ করছি। যেন জলবায়ু পরিবর্তন হলেও এর ওপর কোনো প্রভাব না পড়ে।’

পেঁয়াজ ছাড়া মসলা জাতীয় খাদ্য তৈরি কল্পনাই করা যায় না। ফলে বিভিন্ন অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে পেঁয়াজের দাম। মাঝেমধ্যেই সাধারণ ক্রেতাদের হাতের নাগালের বাইরে থাকে এই মসলা জাতীয় খাদ্যটি। এসব চিন্তা থেকে ৩১ প্রজাতির পেঁয়াজের জাত উন্নয়নের কাজ করছে আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড। 

প্রতিষ্ঠানটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে উৎপাদন করা এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে এমন পেঁয়াজ উদ্ভাবনে কাজ করছে।

পেঁয়াজের জাত উন্নয়নের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী ব্যবস্থাপক (বীজ) মো. ফজলুল হক বলেন, ‘পেঁয়াজ মসলাজাতীয় ফসল হওয়ায় দেশে এর ব‌্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশে শুধুমাত্র শীতকালে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে উৎপাদন করা যায় এমন জনপ্রিয় কোনো পেঁয়াজ এ পর্যন্ত উদ্ভাবন করা যায়নি। আমাদের দেশে যে পেঁয়াজ উৎপাদন করা হয় এর ফলন খুব কম হয়। আমাদের দেশে বর্তমানে হেক্টরপ্রতি পেঁয়াজের উৎপাদন হচ্ছে ৫ থেকে ৭ টন। এজন্য আমরা এমন জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি যেটি গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে উৎপাদন করা যাবে। এছাড়া দুই মৌসুমেই উৎপাদনের পরিমাণ হবে হেক্টরপ্রতি ৯ থেকে ১১ টন। যা বর্তমানে যেসব পেঁয়াজ চাষ হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ খুবই পচনশীল। এক মণ পেঁয়াজ যদি ঘরে রাখা হয় ৫ মাস পরে সেটি শুকিয়ে ২৫ কেজি হয়ে যায়। আমরা বাংলাদেশে পেঁয়াজের হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করতে চাই যেটি উৎপাদনের পরিমাণও বেশি হবে একইসাথে সাধারণ তাপমাত্রাতেও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে।’

রবি মৌসুম ও খরিপ মৌসুমে ভুট্টার উৎপাদন হবে সমানে সমান। সেই লক্ষ্যেই ৯ প্রজাতির ভুট্টার জাত উন্নয়নে কাজ করছে আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড।

ভুট্টার জাত উন্নয়নের বিষয়ে আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড সহকারী ব্যবস্থাপক (বীজ) মো. ফজলুল হক বলেন, ‘‘বাংলাদেশে রবি ও খরিপ এই দুই মৌসুমে ভুট্টার চাষ করা হয়। রবি মৌসুমে যে ভুট্টার উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ১০ থেকে ১০.৫ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিছু কিছু ভুট্টা ১১টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। অন্যদিকে খরিপ মৌসুমে উৎপাদিত ভুট্টার ফলন হেক্টরপ্রতি ৬ থেকে ৭ টন হয়ে থাকে।

আমাদের উদ্ভাবিত একটি ভুট্টা রয়েছে রবি মৌসুমে যার উৎপাদন সাড়ে ১১ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। পাশাপাশি আমরা কাজ করছি ভুট্টা শীত কালেও হবে গ্রীষ্মকালেও হবে এবং দুই মৌসুমের ফলনই কমপক্ষে ৯ টন হবে। এজন্য ৯টি ভ্যারাইটি নিয়ে আমরা কাজ করছি।’’

আফতাব বহুমুখী ফার্ম লিমিটেড লাউ ও করলার লবণাক্ত ও খরা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এছাড়া বছরব্যাপী লাউ এবং করলার উৎপাদন নিশ্চিতকরণ ও ফলন বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

ঢাকা/সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়