পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ‘শক্তিশালী সিন্ডিকেট’
প্রতি বছরের মতো রমজানের দুই মাস আগেই বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিজেদের ইচ্ছেমতো করার ব্যাপারে ‘শক্তিশালী সিন্ডিকেট’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। অতি মুনাফার আশায় এই অশুভ চক্র রোজায় বেশি বেশি ব্যবহৃত পেঁয়াজ, তেল, চিনির মতো পণ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।
বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) রাজধানীর মৌলভী বাজার, মোহাস্মদপুর, কারওয়ান বাজার, নিউমার্কেট, শান্তিনগর, হাতিরপুল বাজারের পাইকারি ও খুচরো বিক্রেতাদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
এসব বাজারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, সুষ্ঠুভাবে বাজার মনিটরিং এবং এসব চিহ্নিত সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী-কোম্পানির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোন শাস্তি না হওয়ায় বার বার এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
সে কারণে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আয় কমে যাওয়া নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত বেশিরভাগ মানুষদের সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার লক্ষে ভোক্তা অধিকার, টিসিবি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে কঠোরভাবে বাজার তদারকি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলেও জানান এসব ব্যবসায়ীরা।
গত মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সরকারি সংস্থা টিসিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের পরিসংখ্যান বলছে গত বছর একই সময়ের তুলনায় এখন চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, পেঁয়াজ, ছোলা, চিনি এমনকি লবণসহ অন্তত ২০টি নিত্যপণ্য ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে উল্লেখিত পণ্যে কেজি/লিটারে সর্বনিম্ন ২ দশমিক ১৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে’।
বাজার মনিটরিং করা সরকারি সংস্থার এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গত বছর একই সময়ের তুলনায় এখন প্রতি কেজি চাল অন্তত পাঁচ থেকে আট টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে আটা-ময়দার দাম ১০-১২ টাকা বেড়েছে। এছাড়াও প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ৩৬ টাকা, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ২৫ টাকা ও পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৪৫ টাকা বেড়েছে। প্রতি লিটার খোলা পাম অয়েল ও পাম অয়েল সুপার ৩৫-৩৬ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে।’
টিসিবির হিসাব মতে, গত বছর এই সময়ের তুলনায় এখন প্রতি কেজি বড় দানার মসুর ডাল ৩০ টাকা, মাঝারি দানার মসুর ডাল ২০ টাকা ও ছোট দানার মসুর ডাল ১০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি অ্যাঙ্কর ডাল ও ছোলা পাঁচ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এখন প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১৫ টাকা, হলুদ ৭০ টাকা, আদা ২০ টাকা, গরুর মাংস ২০ টাকা, খাসির মাংস ৫০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ২০/২৫ টাকা, গুঁড়া দুধ ৪০-৫০ টাকা, চিনি ১০/১৫ টাকা, লবণ পাঁচ টাকা এবং প্রতি ডজন ফার্মের ডিম ১২ থেকে ১৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
আরও পড়ুন: তেলের দাম নিয়ে তেলেসমাতি
বাজারে ইচ্ছেমতো মূল্য বাড়ানো-কমানো চলছেই। আর এতে জীবন চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষদের। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে বাজারের এই অরাজক অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘অসাধু এবং শক্তিশালী একশ্রেণী ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণেই মূলত বাজারে দ্রব্যমূল্যের এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। অনেকবার সিন্ডিকেট চিহ্নিত হলেও এরা এতটাই শক্তিশালী যে এদের শাস্তির আওতায় আনা যায়নি। ফলে নানা ইস্যুতে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে রেখেছে এরা।’
তিনি বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে দেশে বেশ কিছু আইন আছে। সেসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। পাশাপাশি এসব ব্যাপারে ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। করোনা সংক্রমণ বাড়াসহ যেকোন শর্ট ক্রাইসিসে ১০ দিনের পণ্য একদিনে কেনা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস’র সাবেক মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরিয়া বলেন, ‘যেকোন ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে গেলে ভোক্তার স্বার্থ সবসময় ক্ষুণ্ণ হয়। ভোক্তাকে সুরক্ষা দিতে হলে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’
সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, ‘আমাদের কিছু অসাধু ব্যক্তি এবং শক্তিশালী গোষ্ঠীর হাতেই নিত্যপণ্যের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এরা কারসাজি করলে তখন সরকারের আর কিছুই করার থাকে না। মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকবে। কিন্তু তার মানে এই নয়, এর মাধ্যমে এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা যা খুশি তাই করবে। বিশ্বের অনেক দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকলেও সরকারের হাতেই কিন্তু মূল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশেও একইভাবে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর জন্য দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং সক্ষমতা আরও অনেক বেশি বাড়ানো জরুরি।’
ঢাকা/এনএইচ/
আরো পড়ুন