ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

টাকার হাটে ৩০ মিনিট

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৭, ২৪ এপ্রিল ২০২২   আপডেট: ১৯:২৬, ২৪ এপ্রিল ২০২২

রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রবিন্দু গুলিস্তান। একসময় এখান থেকে সারা দেশের বাস চলতো। এমনকি, বর্তমান কমলাপুর রেল স্টেশন চালুর আগে এখান থেকে রেল ছেড়ে যেতো। সেই রেল স্টেশনের নাম ছিল ফুলবাড়িয়া। এক সময়কার ১৯ জেলার বাস ছাড়তো এখান থেকে। বর্তমানে হাতে গোনা দু’তিনটি জেলার বাস ছেড়ে যায় এখান থেকে। 

এই গুলিস্তানে চলে বারোয়ারি জিনিসের বেচাকিনি। এহেন জিনিস নেই, যা এখানে পাওয়া যায় না। তবে সেসব জিনিসের মান নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর অসন্তোষ। এখানকার বেশিরভাগ দোকানি সাধারণ ক্রেতাদের পণ্যের মান এবং দামের ক্ষেত্রে ঠকায়- এটা সর্বজন স্বীকৃত। তারপরও এই এলাকায় প্রতিদিন হাজারো মানুষের চলাফেরা। বেচাকিনি চলে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। এখানে মাটির নিচেও রয়েছে একটি বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স মার্কেট।

গুলিস্তান সিনেমা হল মার্কেটটি বর্তমানে বিশাল আকার পেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের নিয়ন্ত্রণাধীন এই মার্কেটে রয়েছে কয়েক শত দোকান। যদিও গুলিস্তান সিনেমা হলটি বর্তমানে আর সচল নেই। এই গুলিস্তান মার্কেটের ভেতর-বাহির এবং চারপাশ ঘিরে অসংখ্য ব্যবসায়ীরা তাদের পসরা সাজিয়েছেন। ঈদকে কেন্দ্র করে এখানকার অবস্থা বেশ জমজমাট।

এই মার্কেটের ঠিক সামনে অন্যরকম এক ব্যবসার পসরা সাজিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রায় একশ অস্থায়ী দোকান রয়েছে এখানে। এখানকার ব্যবসায়ীদের বিকিকিনির পণ্য হচ্ছে- নগদ টাকা। এখানে টাকা বেচাকেনা হয় বলে এটাকে টাকার হাটও বলেন তাদের কেউ। ছেঁড়া বা পুরোনো টাকার বদলে এখান থেকে ইচ্ছে করলেই আপনি কচকচে নতুন টাকা কিনতে বা বদলে নিতে পারবেন। সারা বছর ধরে চলে এই নতুন টাকার বেচাকিনি। তবে ঈদ বা পূজা পার্বণে এখানকার বেচাকিনির পরিমাণ বাড়ে বলে জানালেন বিক্রমপুরের রাহিম উল্লাহ।

ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে টাকার বেচাকিনি করেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এসব নতুন টাকা বিভিন্ন মাধ্যমে সংগ্রহ করেন। মানুষের চাহিদা মতো নতুন টাকার যোগান দেন। বিনিময়ে নির্দিষ্ট একটা কমিশন পান তারা। তবে ঈদ বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় যখন নতুন টাকার চাহিদা বাড়ে, তখন তাদের বিনিময় মূল্যও বাড়ে বলে জানান তারা।

একেকটা দোকানে লাখ লাখ নতুন ৫০০, ২০০, ১০০, ৫০, ২০, ১০, ৫ ও ২ টাকার নোট সাজানো। বিভিন্ন মানুষ আসছেন, তাদের চাহিদা মতো টাকা বদলে নিয়ে যাচ্ছেন। এই যে দোকানে লাখ লাখ টাকা সাজিয়ে রাখেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত- এতে চুরি, ছিনতাই বা এই জাতীয় কোনো সমস্যায় পড়েন না? উত্তরে সালমান, সোহেলসহ আরো দু’তিন জন জানান, কখনই না। এই এলাকায় প্রচুর মানুষের ছিনতাই-পকেটমার হলেও এসব দোকানিদের জন্য একদম সেইফ জোন। তাছাড়া এক ধরণের ‘বোঝাপড়ার’ কারণে এখানকার দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারও সঙ্গে কখনো কোনো ঝামেলা হয়নি বলেও জানান তারা। 

পাঁচ বছর থেকে ৪০ বছর যাবত এখানে ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের একজন আসলাম মিয়া জানান, আজকাল মানুষ অনেক সৌখিন হয়েছে। ঈদ-পূজা ছাড়াও বারো মাসই মানুষজন এখান থেকে টাকা বদলে নিতে আসেন। সাধারণত ব্যাংকে ঝামেলার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ছেঁড়া-কাটা-পোড়া টাকা এখান থেকে পাল্টে নিতে পারেন তারা। যদিও ব্যাংকের চেয়ে এখানে টাকা পাল্টালে একটু কমই মূল্য পান, তারপরও মানুষজন সময় নষ্ট করে ব্যাংকে যেতে চান না।

স্বাভাবিক সময়ে প্রতি এক শ’ নতুন নোট পাল্টানোর জন্য এসব ব্যবসায়ীদের ৭০ থেকে ৮০ টাকা বেশি দিতে হয়। তবে ঈদ উপলক্ষে আজকের টাকার বিনিময় মূল্য হিসেবে ব্যবসায়ীদেরকে একটু বেশিই দিতে হচ্ছে। এখন এক বান্ডিলের জন্য ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। তারা বলেন, ব্যাংকের লোকজনের কাছ থেকে নতুন টাকা সংগ্রহ করতে ঈদের কারণে তাদেরকেও বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। তাই একটু বেশি মূল্যে পাল্টাপাল্টি করছে। নাহলে পরিবার নিয়ে চলবে কীভাবে?

আজকের টাকার বিনিময় মূল্য: ২ টাকার বান্ডিলের জন্য- ৩০০ টাকা, ৫ টাকার বান্ডিল- ৬২০ টাকা, ১০ টাকার বান্ডিল- ১ হাজার ১৪০ টাকা, ২০ টাকার বান্ডিল- ২ হাজার ১৫০টাকা, ৫০ টাকা, ১০০ টাকা ও ২০০ টাকার বান্ডিলের জন্য- ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা বেশি প্রদান করতে হচ্ছে। তাতেও ক্রেতারা খুশি মনে পুরোনো টাকার বিনিময়ে নতুন টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। প্রিয়জনদের ঈদ উপহার দেওয়ার পাশাপাশি ঈদের সেলামি দেওয়ার জন্য। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই টাকার হাটের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানকার ব্যবসায়ীরা যেমন টাকার বিনিময়ে নতুন টাকা দিয়ে খুশি; তেমনি যারা নতুন টাকা নিচ্ছেন, তারাও খুশি।

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়