ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

অনন্য রশীদ হায়দার

আহমদ বশীর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ১৯ অক্টোবর ২০২০  
অনন্য রশীদ হায়দার

রশীদ হায়দার (১৯৪১-২০২০), আলোকচিত্রী: শাকুর মজিদ

রশীদ হায়দার ছিলেন ষাট দশকের কথাশিল্পী, চলচ্চিত্র সাংবাদিক, প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। একাত্তরের পর ঢাকা নগরীতে অন্তরীণ জীবন নিয়ে লেখা তাঁর উপন্যাস ‘খাঁচায়’ তাঁকে টেনে নিয়ে আসে পাদ-প্রদীপের আলোয়। মুক্তিযুদ্ধের পর যখন আমাদের কথাসাহিত্য নতুন জীবনদর্শনকে ছুঁতে চাচ্ছে, তখন প্রকাশিত হয় রশীদ হায়দারের এই উপন্যাস। এর আগে রশীদের একটা ছোটগল্প সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছিল ‘নানকুর বোধি’।

ষাটের গল্পকার হলেও রশীদ হায়দারের গল্প বর্ণনার ঢং ছিল ভিন্ন। নানকুর বোধিতে তিনি সরল গদ্যে জীবনভাষ্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘খাঁচায়’ উপন্যাসটি সেই সময় কয়েকটি কারণে বিশেষ গৌরবের ভাগীদার হয়েছিল। যদিও এটা ঠিক প্রথাগত উপন্যাস ছিল না। উনিশ শ একাত্তরে নয় মাসে ঢাকা শহরে অবরুদ্ধ দিনগুলোতে একজন মধ্যবিত্ত শিল্পী মানুষের দুঃসহ জীবনস্মৃতি ছিল এর মূল উপজীব্য।

রশীদ হায়দারের পরবর্তী কাজটি ছিল একটু ভিন্নধর্মী। তিনি ১৯৭৪ সালে নাট্যকার এবং নাট্যকর্মী হিসেবে আবির্ভূত হলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তখন নাট্যকার বিকাশে এগিয়ে এসেছিলেন কিছু তরুণ প্রাণ। এদের অগ্রণী সংগঠন ‘নাগরিক’ -এর সঙ্গে জড়িত হলেন তিনি। তারপর তাঁর রচিত ‘তৈল সংকট’ নাটকটি মঞ্চস্থ হলো বিপুল উৎসাহে। রশীদ এই সময় আরও দুটি নাটক নিয়ে কাজ করেছেন। একটি হলো কাফকার ট্রায়ালের বাংলা নাট্যরূপ। তারপর তিনি লিখলেন শেক্সপিয়ার দ্য সেকেন্ড। এক যুবকের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। রশীদের আরেকটি অনবদ্য নাটক কিশোরদের জন্য লেখা ‘গোলাপ গোলাপ’। শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত এই নাটকটি বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীরা অনেক স্থানে মঞ্চস্থ করেছে।

রশীদ হায়দারের সংবাদ জগতের পেশাগত জীবন ছিল তিন ভাগে বিভক্ত- জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের ‘বই’ পত্রিকায় সম্পাদনা, সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা ‘চিত্রালী’র সম্পাদনা পরিষদের কর্মকাণ্ড এবং সর্বশেষ জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকার সম্পাদনা। গৌরবময় এই তিন পর্যায়ে সম্পাদনা কর্মে তার অংশগ্রহণ এক ধরনের ইতিহাস হয়ে রয়েছে।

বাংলা একাডেমির একুশে ফেব্রুয়ারির বইমেলার আয়োজন এবং অনুষ্ঠান ঘোষণা ও পরিচালনায় রশীদ হায়দারের কণ্ঠ সৌকর্য আজও গুণীজনের কাছে স্মৃতি আস্বাদনের বিষয়। বাংলা একাডেমি থেকে অবসর গ্রহণ করে তিনি বেশ কিছুকাল নজরুল একাডেমির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু রশীদ হায়দারের এসব কৃতিত্বের ওপর আরেকটি মহান দায়িত্ব পালন তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর করে রাখবে। এই দায়িত্বটিই হলো মুক্তিযুদ্ধের অব্যক্ত ইতিহাসের সংকলন সংগ্র স্মৃতি-১৯৭১। বহুমূল্য সংকলনটিতে নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণাপদ্ধতি অনুসরণ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন-অংশগ্রহণের প্রামাণ্য দলিল তৈরি করা হয়েছে। ব্যক্তি-মানুষের জীবনে ও পরিবারের ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি পরম যত্নে তিনি চয়ন করেছিলেন। একটি একটি করে এসব ঘটনার বিবরণ তার হাতে ইতিহাসের পর্যায়ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংগৃহীত এই কাহিনীগুলো জাতীয় আত্মত্যাগের বাস্তবচিত্র।

জীবনে এত কৃতকর্মের পরও রশীদ হায়দার হয়তো শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে কথাসাহিত্যিক হিসেবেই অমর হয়ে থাকবেন। তার নানকুর বোধি, খাঁচায়, অন্ধ কথামালা, নষ্ট জ্যোৎস্নায় এ কোন অরণ্য- এগুলোর সঙ্গে মনে পড়ছে তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত জাতীয় ব্যক্তিত্ব, ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন, ১৯৮৭ সালে হুমায়ুন কাদির সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এবং তিনি একজন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক যিনি সাধারণ জনগণের কাছ থেকে ইতিহাসের উপকরণ খুঁজেছেন-কথাসাহিত্যিকের পক্ষেই যা ছিল একান্ত দক্ষতা।

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়