ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

রুদ্ধশ্বাস অভিযান শেষে শিখর জয়ের গল্প

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৬, ২৬ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৯:৫৮, ২৬ জানুয়ারি ২০২১
রুদ্ধশ্বাস অভিযান শেষে শিখর জয়ের গল্প

হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: শেষ পর্ব

ঝড়ের তাণ্ডবে সারারাত এক মুহূর্তের জন্যও ঘুম এলো না চোখে। ঘুম আসবেই বা কীভাবে? সরু এক বরফের রিজে বরফ কেটে তাবুর জায়গা করে সেখানেই তাবু লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে একপাশের নিচে কার্নিশ। নড়বরে জায়গা। যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। দুপুরের পর থেকেই প্রচণ্ড তুষার ঝড়। একটুও থামার লক্ষণ নাই। তাবুর ভেতরে আমরা চারজন। ড্যান্ডি শেরপা, ঠুন্ডু শেরপা, মুহিত ভাই ও আমি। তাবুর ভেতরেই বরফ গলিয়ে গরম এক মগ স্যুপ খেয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে শুয়ে আছি। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ৩০ ডিগ্রি। ঘণ্টায় প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার বেগে তুষার ঝড় হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমাদেরসহ তাবু উড়িয়ে নেবে। সিদ্ধান্ত হলো রাত ২টার দিকে আমরা সামিটের উদ্দেশ্যে বের হবো। অথচ ঝড় থামছেই না। প্রতিমুহূর্ত রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় কাটছে- এই বুঝি তাবু উড়ে গেলো!

অক্টোবরের ২০ তারিখ। হিমলুং বেসক্যাম্প থেকে চূড়ান্ত আরোহণের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি আমরা চারজন। প্রায় দেড় ঘণ্টায় কঠিন ও ভয়ানক পাথুরে মোরেন গ্লেসিয়ার অতিক্রম করে খাড়া এক পাথুরে দেয়াল বেয়ে উঠে এলাম। এরপর ধীরে ধীরে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে উঠে চলে আসি ক্যাম্প-১-এ। এর উচ্চতা ১৭ হাজার ৮৮০ ফুট। বিকেলের দিকে আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করলো। চারপাশ হোয়াইট আউট হয়ে গেলো। উপর থেকে ক্যাম্প-১-এ নেমে এলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের আর্মি টিমের সদস্যরা। তারা আঠারো জনের টিমে মাত্র দু’জন হিমলুং চূড়া আরোহণ করতে পেরেছেন। উপরের আবহাওয়া ভালো না।

২১ অক্টোবর। সকালে তাবু থেকে বেরিয়ে বেশ আনন্দ হলো আবহাওয়া ভালো দেখে। রোদও জানান দিলো তোমরা উপরে যেতে পারো। তাই আমরাও দেরী না করে ১৯ হাজার ৬৮৫ ফুট উচ্চতার ক্যাম্প-২-এর উদ্দ্যেশে রওনা হলাম। এখান থেকেই শুরু হলো আমাদের টেকনিক্যাল ক্লাইম্বিং। ছোট-বড় আলগা পাথরের খাড়া চড়াই। যত উপরের দিকে উঠছি তত পথ আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। কোথাও পাথর ধরে ধরে, আবার কোথাও দড়ি ধরে উপরে উঠছি। উপর থেকে পাথরের টুকরো পড়ছে। পায়ের নিচের পাথরও সরে যাচ্ছে। খুবই সাবধানে পাথুরে পথটা পেরিয়ে উঠে এলাম বরফের গ্লেসিয়ারে। পুরো গ্লেসিয়ারেই ছোট-বড় অসংখ্য ক্রেভাস। ক্রেভাস হলো বরফের ফাটল। তাই খুবই সতর্কতার সঙ্গে জিগজ্যাগ করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। দুপুরের মধ্যে আমরা ক্যাম্প-২-তে চলে এলাম। এখানে আবহাওয়া বেশ ভালো। এখানে আমাদের দুটি তাবু লাগানো হয়েছে। এক তাবুতে দুই শেরপা, এবং অন্য তাবুতে আমরা দুজন। এখান থেকে হিমলুং পর্বত শিখরটা ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। পর্বতে যতো উপরের দিকে ওঠা যায় ঘুম তত কমে যায়।

আজ সকালেই রোদে চারপাশ বরফে চিকচিক করছে। তবে হিমলুং-এর ছায়ায় এখনো আমাদের এখানে রোদ এসে পৌঁছায়নি। চা, স্যুপ খেয়ে আমরা ক্যাম্প-৩-এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আজকের পুরোটা পথ বরফের গ্লেসিয়ারের উপর দিয়ে। ভীষণ সুন্দর পথ, তবে যতটা সুন্দর তারচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। বরফের ক্রেভাস ও গভীর খাদের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। কখনো আইস অ্যাক্স, কখনো দড়ির সাহায্যে যেতে হচ্ছে। প্রায় চলে এসেছি ক্যাম্প-৩-এ। এখন একটা চড়াই উঠতে পারলেই ক্যাম্প-৩। এই চড়াইটা একদম খাড়া। প্রায় ১৫০ মিটার দড়িতে ঝুলে জুমারিং করে উঠতে হবে। এদিকে আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করছে। বাতাস বেড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই আমরা ক্যাম্প-৩-এ উঠে এলাম। এই ক্যাম্প-৩-এর উচ্চতা প্রায় ২১ হাজার ফুট।

আমাদের আগেই পরিকল্পনা ছিল সামিট পুশ রাত ২ টায় করার। কিন্তু প্রচণ্ড তুষার ঝড়ের কারণে আর বের হতে পারলাম না। তাই একটু গরম চা, স্যুপ দিয়ে গলা ভিজিয়ে রাত ৪টার দিকে হিমলুং চূড়া আরোহণের উদ্দেশ্যে বের হলাম সাজ-সরঞ্জাম পরে।  এ যেন এক যুদ্ধের প্রস্তুতি। এদিকে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। অপরদিকে চূড়া আরোহণের উত্তেজনা। এখান থেকে চূড়া পর্যন্তই খাড়া চড়াই। তাই প্রায় পুরোটা পথ দড়ি লাগানো আছে। তাবু থেকে বেরিয়েই দড়ির সঙ্গে সেফটি ক্যারাবিনার লাগিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। প্রচণ্ড তুষার ঝড় হচ্ছে। তুষারের ঝাপটা এসে যখন মুখে লাগে তখন মনে হয় যেন কাঁটা এসে বিঁধছে। তখন হাত দিয়ে তুষারের সেই আঘাত ফেরাচ্ছি। সবার আগে প্রধান শেরপা ড্যান্ডি, মুহিত ভাই, আমি ও পেছনে ঠুন্ডু শেরপা। হেড লাইটের আলোয় আমরা এগিয়ে চলছি ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে। ভোর হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। এমন সময় হঠাৎ তুষার ঝড়ে প্রচণ্ড বেগে বরফের কণা মুহিত ভাইয়ের চোখে ঢুকে যায়। মুহিত ভাইয়ের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তিনি চোখে ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন না। এরপরেও তিনি সামনে এগোতে লাগলেন। একটা সময় তিনি থেমে গেলেন। চোখ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিচে নেমে যাওয়ার। আমাকে তার ব্যাগ থেকে লাল-সবুজের পতাকা, ক্লাব পতাকা এবং পৃষ্ঠপোষকদের লোগো দিয়ে চূড়া আরোহণে এগিয়ে যেতে বললেন।

চূড়া থেকে মাত্র ৩০০ মিটার নিচ থেকে মুহিত ভাই ঠুন্ডু শেরপাকে নিয়ে নিচে নেমে গেলেন। আর আমার হাতে তুলে দিয়ে গেলেন হিমলুং চূড়া আরোহণের দায়িত্ব। মুহিত ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে সাহস দিলেন। কানের কাছে মুখ নিয়ে ভাঙা গলায় বললেন- আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন। মন্ত্রপাঠের মতো ভাইয়ার কথাটা মনে গেঁথে ড্যান্ডি শেরপাকে নিয়ে চূড়ার আরোহণে এগিয়ে চললাম। এতো তুষার ঝড় হচ্ছে, তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ৩৫। তখনও একবারের জন্যও মনে হয়নি সামনে আমার জন্য কতটা ভয়ঙ্কর সময় আসছে। আমি পারবো না বা ফিরে আসবো কি আসবো না এসব কিছুই ভাবিনি। শুধু একটাই লক্ষ্য আমাকে চূড়ায় যেতে হবে। দেশের জন্য, দেশের মানুয়ের জন্য যেতে হবে।

ওই তো চূড়া দেখা যাচ্ছে। আর মাত্র ২৫ মিনিটের পথ। বাতাসের গতিবেগ আরো বেড়ে গেছে। বাতাসের ধাক্কা আমি সামাল দিতে পারছি না। আমাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে, তাই সামনে এগিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। হাতের আঙুল, নাক ও ঠোট ঠান্ডায় অসার হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ, মনে হচ্ছিল একটু পানি পেলে হয়তো বেঁচে যাবো। ড্যান্ডিকে বললাম, আমার পানি খেতে হবে। আমি আর এগোতে পারছি না। ড্যান্ডি জানালো, এই ঝড়ের মধ্যে সময় নষ্ট করা যাবে না। যেভাবেই হোক আমাদের তাড়াতাড়ি চূড়ায় উঠতে হবে এবং নেমে আসতে হবে। নাহলে আমরা দুজনই মারা যাবো। তিনদিন ধরে কোনো ভারী খাবার খাই না, শুধু চা, স্যুপ আর চকলেট। শরীরে কোনো শক্তি নেই, মনের জোরেই এগিয়ে চলছি।

প্রায় ১০ ফুটের একটি খাড়া দেয়াল বেয়ে ২৩ অক্টোবর নেপাল সময় সকাল ১০:১০ মিনেটে উঠে এলাম ২৩ হাজার ৩৮০ ফুট উঁচু স্বপ্নের চূড়া হিমলুং শিখরে। চোখের পানি আটকে রাখতে পারলাম না। ড্যান্ডিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে লাগলাম। আমি পেরেছি, মুহিত ভাইর বিশ্বাস রাখতে। আমি পেরেছি আমার প্রিয় বাংলাদেশকে সম্মান দিতে, পাতাকার অহঙ্কার তুলে ধরতে।

হিমলুং শিখরে প্রায় ৭ মিনিট সময় ছিলাম। প্রচণ্ড তুষার ঝড়ের কারণে বেশি সময় সেখানে থাকতে পারিনি। তাই দ্রুত নামতে লাগলাম। আমরা দুজন দুজনের সঙ্গে ছোট একটি দড়িতে বাঁধা। চূড়ার সেই দেয়াল থেকে নামছি। ড্যান্ডি আমার আগে নামছে। আমি নামার জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ ড্যান্ডি স্লিপ করে নিচের দিকে পড়তে থাকে। দঁড়ির টানে আমিও পড়ে যাই। তবে আমার মাথাটা আগে পড়ে, ফলে আমি গড়াতে থাকি নিচের দিকে। খাদের কিনারায় এসে ড্যান্ডি নিজেকে আটকিয়ে আমাকে পা দিয়ে ঠেকালেন। তার ক্রাম্পনের কাঁটা আমার মাংসপেশিতে বিঁধে গেল। আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেন তিনি।

দম নেওয়ার চেষ্টা করলাম। বেঁচে থাকার আনন্দ উপভোগ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই বুকের কাঁপুনি কমছিল না। সেখানে কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। এদিকে এক মুহূর্ত জিড়িয়ে নেওয়ার উপায় নেই। সাঁই সাঁই বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে হাজার ফিট নিচে। খুব সাবধানে আস্তে আস্তে ক্যাম্প-৩-এ নেমে এলাম। দৌড়ে গিয়ে মুহিত ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম। শিখর জয়ের আনন্দে দুজনেই শিশুর মতো কাঁদতে লাগলাম। দেশের জন্য জীবনের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে সফলতার প্রাপ্তির কোনো পরিমাপ হয় না।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়