ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

হো চি মিনের সমাধিতে একদিন

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩১, ২ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৬:০৪, ২৫ মে ২০২১
হো চি মিনের সমাধিতে একদিন

বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: ৮ম পর্ব

আমার হোটেল হোয়ান কিয়েম এলাকায়। বিমানবন্দর থেকে দূরত্ব প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার। টিনের ঠিকানাও একই পথে হওয়ায় একসঙ্গে রওনা হলাম। ফাঁকা রাস্তা, চল্লিশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। হোটেলের রিসেপশনে অগ্রিম বুকিং দেওয়া আছে বলতেই তারা কম্পিউটার চেক করতে শুরু করলো। তাদের গলদঘর্ম অবস্থা দেখে বুঝতে পালাম কোনো একটা অব্যবস্থাপনা হয়ে গেছে! হ্যাঁ, ঠিক তাই, আমার জায়গা অন্যজনকে দেওয়া সারা! শুধু তাই নয়, পর দিন সকালের বাসে ‘সা পা’ যাওয়ার বাস টিকিটও নিশ্চিত করা হয়নি। অথচ বুকিং পেপারে এসব স্পষ্টাক্ষরে উল্লেখ আছে।

অনেক ঘাটাঘাটির পর নিকটেই অপর একটা হোটেলে রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলো ওরা। তবে বাসের টিকিটের ব্যবস্থা করতে পারলো না। এমন চরম দায়িত্বহীনতার কারণে রীতিমত একটা বচসা বাঁধিয়ে ফেলা যেত, কিন্তু আমি তা করলাম না। প্রথমত সাহসে কুলালো না। দ্বিতীয়ত অনুধাবন করলাম ভুলটা আসলে আমারই। বুকিং দেওয়ার আগে আরও যাচাই-বাছাই করা উচিত ছিল। সা পা যাওয়ার জন্য পরের দিন ছয় অক্টোবরের পরিবর্তে সাত তারিখের টিকিট পাওয়া গেল। আমার সার্বিক ভ্রমণ পরিকল্পনা থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন নষ্ট হয়ে গেল ভেবে খুব খারাপ লাগল। পরিস্থিতি অনুধাবনপূর্বক রিসেপশন থেকে ওরা একটা মানচিত্র বের করে আমাকে হ্যানয় ভ্রমণের আদ্যপান্ত বুঝানোর চেষ্ট করলো। একটা অব্যবস্থাপনা যেহেতু হয়ে গেছে সেহেতু কিছুই করার নেই। আমি ভাবলাম, তার চেয়ে বরং হ্যানয়ের দিনটা কীভাবে অর্থবহ করে তোলা যায় সেই পরিকল্পনাতেই মনোযোগী হওয়া ভালো।

যাই হোক, মোটর সাইকেলে বিকল্প হোটেলে পৌঁছে দেওয়া হলো। মাত্র দেড় মিনিটের পথ! সামান্য পথ মোটর সাইকেলে করে পৌঁছে দেওয়ার কী কারণ বুঝলাম না! ফ্রেশ হয়ে মানচিত্র নিয়ে বসে পড়লাম। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে মোটামুটি একটা পরিকল্পনাও করে ফেললাম। একটা সংক্ষিপ্ত পায়চারীর উদ্দেশ্যে বাইরে না গেলেই নয়। তাছাড়া রাতের খাবারটাও খেতে হবে। হ্যানয়ের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচিতির পর হোটেলে ফিরেই দিলাম লম্বা একটা ঘুম।

কোনো মতে রাত পার করে সকালে ফিরে এলাম আগের হোটেলে। উপরতলার ডরমেটরিতে বিছানা পরিষ্কারের কাজ চলছে। এর মধ্যে পরিবেশিত হলো কমপ্লিমেন্টারি নাস্তা। বিছানা পরিষ্কারের পর একজন আমাকে উপরে নিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। এক ঘরে আটজন থাকার ব্যবস্থা। দুইতলা বিছানা, জায়গা মিললো একটার উপরতলায়। কারও ঘুম তখনও ভাঙেনি। শুধু একটা বিছানায় বাতি জ্বলছে এবং চারপাশের পর্দা টেনে দেওয়া। হোটেলের সার্বিক আয়োজন ভালো নয়। ঘররর শব্দ তুলে এসি চলছে। বারান্দায় তার পানি জমে ঘরের মধ্যে চলে এসেছে। বাথরুম এবং টয়লেটের অবস্থাও ভালো নয়। এত কিছুর পরও আমার মতো পর্যটকের জন্য এই ঢের বলে মনে হলো।

মানচিত্রটা পকেটে ঢুকিয়ে আগের রাতের পরিকল্পনা মতো বেরিয়ে পড়লাম। পথের ফুটপাথগুলোতে জমে উঠেছে সকালের নাস্তার আয়োজন। প্লাস্টিকের টেবিল এবং টুল পাতা দোকান। প্রায় প্রতিটি দোকানের প্রধান পদ নুডুলস জাতীয় খাবার। শহরের প্রধান সড়কে পা রাখার পর যে বিষয়টি আমার সবচেয়ে ভালো লাগল তা হলো- ফুটপাত। অর্থাৎ সড়কের চেয়ে ফুটপাতে জায়গা বেশি। ফুটপাতের বুক চিড়ে বেরিয়ে এসেছে একেকটা আকাশচুম্বি বৃক্ষ। ডালপালার ফাঁক দিয়ে নেমে এসেছে সকালের স্নিগ্ধ রোদ। এমন একটা মনোরম ফুটপাত ধরে অনেক দূর হাঁটা হলো। আমার লক্ষ্য ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা হো চি মিন-এর সমাধিস্থল। পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম আরও দুই কিলোমিটার যেতে হবে। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। এমন সুন্দর পথ পেলে আমি সারাদিন হাঁটতে রাজি আছি।

পথের একটা পর্যায়ে বাম পাশে দাঁড়িয়ে আছে বেটে ও দৈত্যাকৃতির একটা স্থাপনা। শ্যাওলা জমে কেথাও কোথাও গাছপালা জন্মে গেছে। ছাদের চারধারে ফুলগাছ ঘেরা রেলিং এবং তার মাঝখানে চৈনিক নির্মাণশৈলীর আদলে অতিরিক্ত দুই তলা না থাকলে একে কদাকার বলা যেত। কোনো দুর্গ নগরীর সদর দরজার হয়ে থাকবে। একদল তরুণী হাতে এক গোছা ফুল নিয়ে দরজার সামনে নানা ভঙ্গিমায় পোজ দিয়ে ছবি তুলছে। সকাল সকাল এমন সুন্দর একটা দৃশ্য দেখে খুব ভালো লাগল। ইচ্ছা হলো কয়েকটা ছবি তুলি! অনুমতি চাইলে সহাস্য সম্মতিতে কার্পণ্য করল না। সামনের চার রাস্তার মোড়ে লাল রঙের ব্যানার ও ফেস্টুনসহ কিছু মানুষ সার ধরে অবস্থান নিয়েছে। তাদের দেখেও কয়েকটা ছবি তুলতে ইচ্ছা হলো। কিসের দাবিতে অবস্থান তার কিছুই জানা হলো না। ব্যানার-ফেস্টুনের লেখা বুঝতে পারা- সে তো সাধ্যের অতীত। সেখান থেকে বাম দিকে মোড় নিতে হলো। হাঁটতে হাঁটতে পরবর্তী মোড়টার আগ থেকেই দৃশ্যমান হলো সুবিশাল একটি মাঠ। মাঠজুড়ে সবুজ ঘাসের মিহি গালিচা। আরও নিকটে গেলে দেখা গেল মাঠের অপর প্রান্তে একটা স্থাপনা। দেখে অনুমান করা যায় তা শুধু একটা স্থাপনাই নয় বিশেষও বটে। অনুচ্চ এবং সুদৃশ্য নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে মাঠ ঘেরা। স্থাপনার কপালে স্পষ্টাক্ষরে লেখা ছোট্ট দুটি লাইন। দুই শব্দের উপরের লাইনটা বোধগম্য না হলেও নিচের লাইনে আপেক্ষাকৃত বড় অক্ষরে লেখা মাত্র তিনটি শব্দ ‘হো চি মিন’। নিচে প্রশস্ত দরজায় ঠায় দাঁড়ানো ধবধবে সাদা পোশাকের রক্ষীদের দেখে মনে হলো কয়েকটা ম্যাচের কাঠি। এক পাশে মাঠ এবং আরেক পাশে প্রশস্ত রাস্তা। ঠিক তার মাঝখান দিয়ে ফুটপাত। এই ফুটপাতই আমাকে পৌঁছে দিলো হো চি মিন-এর সমাধি ক্ষেত্রে প্রবেশের মূল দরজায়।

প্রিয় নেতার সমাধি দেখার জন্য শত শত দর্শনার্থীর ভিড়। কত সকাল থেকে তারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে জানি না। দীর্ঘ লাইনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকলাম, কখন দরজা খুলে দেওয়া হবে! সুব্যবস্থাপনার নমুনা মিললো শুরুতেই। প্রত্যেকের ব্যাগ, কোমরের বেল্টসহ ধাতব জাতীয় জিনিসপত্র রেখে দেওয়া হলো। এরপর সারি ধরে প্রত্যেকেই ধীর কদমে এগিয়ে চলা। পরিপাটি সরু পথ, উপরে কাঁচের ছাদ। এতটাই পরিপাটি আর পরিচ্ছন্ন যে ভুল করেও একটা পাতা বা অন্যান্য কিছু পড়ে নেই। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় রেখে দেওয়া হলো ক্যামেরা, ফোনসেট, হাতঘরিসহ দামি অন্যান্য জিনিসপত্র। এত দর্শনার্থীর সমাগম অথচ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত নেই। ধীরে ধীরে লাইন গিয়ে প্রবেশ করল দূর থেকে দেখা সেই স্থাপনা বা ভবনের ভেতরে। এতক্ষণ ভেবেছিলাম হো চি মিন-এর কবর বা অনুরূপ কিছু দেখতে পাবো। কক্ষের অভ্যন্তরে মৃদু অথচ স্পষ্ট আলোর ব্যবস্থা। ঠিক মাঝখানে গর্তের মতো জায়গা থেকে উঁচু করে তোলা একটা বেদি। বেদির উপর স্থাপন করা কাঁচের বাক্স। বাক্সের ভেতরে প্রিয় নেতার চিরাচরিত পোশাক পরা পরিপাটি মৃতদেহ সাজিয়ে রাখা। মাথার পাতলা চুলগুলো নিখুঁত করে আাঁচড়ানো। দেখে মনে হলো তিনি এই মাত্র ঘুমিয়েছেন। দুই ধারে দুই দুই চারজন নিরাপত্তা রক্ষাকারী সদস্য মূর্তির মতো নিস্পলক দাঁড়িয়ে আছে। বেদি থেকে খানিক ব্যবধানে দর্শনার্থীদের চলার পথ। শুধু চলতেই হলো। এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়ানোর নিয়ম নেই।

ভবন থেকে বের হবার পর পদার্পণ করলাম অত্র এলাকার আরেক অংশে। যেখানে ছিল ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন হো চি মিন-এর বাসস্থান এবং বিভিন্ন কার্যালয়। এখানে ক্যামেরা বা অন্যান্য ডিভাইস অনুমোদিত। এরই মধ্যে চলে এসেছে দর্শনার্থীদের রেখে দেওয়া ক্যামেরা, ফোনসেট ইত্যাদি। টোকেন উপস্থাপন করে যে যারটা ফেরত নিলাম। এই অংশে প্রবেশের জন্য চল্লিশ হাজার ডং মূল্যের টিকিট ক্রয় করতে হলো। বেশ বড় এলাকা। নির্দিষ্ট পথ ধরে এগিয়ে উপস্থিত হলাম হো চি মিন-এর ছোট্ট বাসভবনে। এর আগে অতিক্রম করতে হলো একটা ভবন, যেখানকার একটা কক্ষে টেবিল-চেয়ার এখনও সাজানো আছে। প্রেসিডেন্টের সভাপতিত্বে পলিটব্যুরো মিটিংগুলো সাধারণত সেখানে অনুষ্ঠিত হতো। অপর একটা কক্ষ বোধহয় তিনি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতেন। তার ব্যবহৃত চেয়ার-টেবিল, কিছু বই ও অন্যান্য জিনিস সংরক্ষিত আছে। টেবিলের সামনের দেয়ালে ঝুলছে কার্ল মার্ক্স ও মহান নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ছবি।

একই ভবনের অপর কক্ষে সাজানে তিনটি প্রাইভেট কার। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি এগুলো ব্যবহার করতেন। এর মধ্যে দুটি গাড়ি পরপর ১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার কর্তৃক উপহার দেওয়া। মূল্যবান এই নিদর্শন সমৃদ্ধ প্রতিটি ঘরের দরজা ও জানালার চিরাচরিত পাল্লা হটিয়ে কাঁচ দিয়ে আটকানো। নিবাস বলতে চার চালা বিশিষ্ট সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে নির্মিত দুই তলা একটা বাড়ি। ছোট্ট বাড়ির নিচতলা ফাঁকা। তিনি থাকতেন উপর তলায়। এখানে সাজানো আছে তার ব্যবহার্য হাতে গোনা কিছু জিনিসপত্র। এসব দেখে বোঝা যায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার জীবন ছিল সাদাসিধে। বাস ভবনের সামনে একটা পুকুর। এই পুকুর পাড়ে পরিচয় হয় দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাদের সঙ্গ আমার এখানকার বাকি সময়টা আরও অর্থবহ ও উপভোগ্য করে তুললো। যাবতীয় বিষয়গুলো গাইডের মতো করে বুঝিয়ে দিতে এতটুকুও কার্পণ্য করল না। এখন মনে হলো সা পা যাওয়ার বাস টিকিট না পাওয়ায় ভালোই হয়েছে। তা না হলে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা হয়তো সারা জীবনের জন্য অদেখাই থেকে যেতো। (চলবে)

সপ্তম পর্ব: হো চি মিন থেকে হ্যানয়ের পথে

 

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়