ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা: নজরদারি ও সঠিক পরিকল্পনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

নাজমুল ইসলাম ফারুক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ২৯ জুলাই ২০২২   আপডেট: ১১:০৮, ২৯ জুলাই ২০২২
মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা: নজরদারি ও সঠিক পরিকল্পনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, আহসান এইচ মনসুর ও মো. আইনুল ইসলাম। গ্রাফিক : রাইজিংবিডি

যত দিন যাচ্ছে ডলারের দাম তত বাড়ছে। এদিকে কমছে টাকার মান। মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। তবে এই সংকট নিরসনে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাজারে নজরদারি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

আরও পড়ুন: ডলার মজুতের তথ্য পেলে অভিযান চালাবে ডিবি

তারা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত। বিভিন্ন দেশ তা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে ডলারের দাম বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। এছাড়া দেশে রফতানি আয়ের তুলনায় দিন দিন আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে। তাতে ডলারের চাহিদা বাড়তে থাকে। এছাড়া রেমিট্যান্স আয়ও কমেছে। তাতে ডলারের সরবরাহ কমে সংকট দেখা দেয়। শুধু ডলার নয় মাঝে অন্য দেশের মুদ্রার দামও কিছুটা বেড়েছে। এতে মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। আর ডলার সংকট কাটাতে সরকার প্রথমে বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ সফর বন্ধে প্রজ্ঞাপন জারি করে। 

তবুও কাটছে না সংকট, তবে সরকারের এই ভালো সিদ্ধান্তে সংকট তরান্বিত হয়নি। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপ সময়োপযোগী হলেও বাস্তবায়নে নজরদারি বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে সেগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমদানি ব্যয় ও রফতানির আয়ের মধ্যে ঘাটতি থাকা, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় ডলার সরবরাহ কমে গেছে। রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক থাকায় রিজার্ভও কমে যাচ্ছে। তবে আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি ভালো। কিন্তু রফতানির আয়ের সব অর্থ ফেরত আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব অর্থ ফেরত আনার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। রফতানি আয় পুরোটা আসলে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাবে। তাতে মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা অনেকটা কমবে।

তিনি আরও বলেন, এই সংকট থেকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য বেরিয়ে আসতে হলে রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। পণ্যের গুণগত মান বাড়াতে হবে। দক্ষ জনবল বিদেশে পাঠাতে হবে। আর তাতে ডলার সরবরাহ বাড়বে। অর্থাৎ মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এসব কাজ বাস্তবায়ন করতে হবে। তাতে সংকট নিরসন হবে বলে আশা করছেন তিনি।

গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ ডলারের দাম বেড়েছে। ছবি সংগৃহীত

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মুদ্রাবাজারে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে তার একমাত্র কারণ হচ্ছে আস্থাহীনতা। কেউ জানে না ডলারের রেট কোথায় যাবে। ফলে ডলারের রেট কোথায় যাবে সেটা নিয়ে সবাই চিন্তিত। আর এ কারণে সংকট থেকে উত্তরণে সরকারের পলিসি ঠিক করতে হবে। বিশেষ করে কো অর্ডিনেটেড পলিসি থাকতে হবে। পলিসি, পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সংকট উত্তরণ সম্ভব, তবে সময় লাগবে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, আমাদের আমদানি ও রফতানির মধ্যে একটা ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ববাজারে অস্থিরতার কারণে আমাদের দেশে সংকট দেখা দেয়। দেশে মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা কমাতে আমদানির বিষয়ে যে নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। তা অনুসরণ করা হয় কিনা তাতে নজরদারিও বাড়াতে হবে। বিপরীতে দিকে রফতানি বাড়াতে হবে। ডলার সরবরাহ বাড়াতে যেসব ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলো স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে বাস্তবায়ন করতে হবে।

তিনি বলেন, বাজারে পেনিক তৈরি হয়েছে বলে খোলাবাজারে ডলার রেট খুবই অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ ডলার কিনে রেখে দিয়েছে দাম বাড়লে বিক্রি করবে। কারও কাছে ডলার থাকলেও সরবরাহ করছে না আরও দাম বাড়বে বলে। এসব কারণে খোলাবাজারে ডলারের অস্থিরতা। এখানে নজরদারি বাড়াতে হবে। তাহলে এই অস্থিরতা কেটে যাবে বলে আশা করছি।

ডলারের দাম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২১ সালের আগষ্টের শুরুতে আন্ত:ব্যাংক ডলারের মূল্য স্থিতিশীল ছিল। ওই বছর ৩ আগস্ট থেকে দু-এক পয়সা করে বাড়তে বাড়তে ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতো ডলারের দাম ৮৫ টাকা ছাড়ায়।

এদিকে, চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কেনাবেচা হয়েছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। যা ৯ জানুয়ারি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ টাকা। গত ২৩ মার্চ তা বেড়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় বেচাকেনা হয়। গত ২৭ এপ্রিল ডলার প্রতি ২৫ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে। গত ১০ মে ডলার প্রতি আরও ২৫ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে। গত ১৬ মে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কেনাবেচা ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ২৩ মে ফের ৪০ পয়সা বাড়িয়ে ডলারের দাম ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করে। এরপরও বাজার স্থিতিশীল হয়নি। পরে সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশের (এবিবি) দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ মে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির জন্য বিসি সেলিং রেট নির্ধারণ করা হয় ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা। যদিও ব্যাংকগুলো আন্তব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৯ টাকা ৮০ পয়সার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু তাতেও বাজার স্থিতিশীল না হওয়ায় ডলারের এক রেট উঠিয়ে দিয়ে গত ২ জুন আরও ৯০ পয়সা বাড়িয়ে ডলার দাম ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। এরপর বেশ কয়েক দফা বেড়ে গত সোমবার আন্ত:ব্যাংকে ডলার লেনদেন হয়েছে ৯৪.৭০ টাকায়। যা ডলারের দামের সর্বোচ্চ রেকর্ড। আর খোলাবাজারে ডলার মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) ১১২ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হলেও সর্বশেষ ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

শুধু ডলারের বাজার অস্থির তা নয়, গত মার্চেই ইউরো, পাউন্ড, অস্ট্রেলিয়ান ডলারের বিনিময় মূল্য ৩টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করেছে। মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা বিশেষ করে ডলার সংকট মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে রিজার্ভ কমে এখন ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এছাড়াও সংকট নিরসণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।

বাংলাদেশে ডলারের দাম রেকর্ড ছুঁয়েছে। ছবি সংগৃহীত

ব্যাংকের ডলার ধারণের সীমা কমানো:
ব্যাংকগুলো তাদের রেগুলেটরি ক্যাপিটালের ২০ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ করতে পারে। এই সীমা ১৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংকটে পড়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের নিকট ডলার ছিল না। ডলার ধারণের সীমা কমানোর কারণে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।

ইআরকিউ হিসাবে ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন:
রপ্তানি আয়ের একটা অংশ এই হিসাবে জমা রাখা যায়। যা দিয়ে রপ্তানিকারকেরা খরচ করতে পারেন। রপ্তানিকারকের রিটেনশন বা প্রত্যাবাসন কোটা (ইআরকিউ) হিসাবে জমা করা বিদেশি মুদ্রার ৫০ শতাংশ নগদায়ন করতে হবে। ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখার সীমা কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে। নতুন নিয়মে ইআরকিউতে প্রযুক্তি খাতের রপ্তানিকারকেরা ৭০ শতাংশের পরিবর্তে ৩৫ শতাংশ, সেবা খাতের রপ্তানিকারকেরা ৬০ শতাংশের জায়গায় ৩০ শতাংশ ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা রপ্তানি আয়ের ১৫ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে ৭ শতাংশ রাখতে পারবেন। এতে ব্যবসায়ীদের ধরে রাখা ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে।  

অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের তহবিল থেকে আমদানি ব্যয় মেটাবে: 
অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে স্থানান্তর সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী স্থানীয় ব্যাংকগুলো তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ করতে ৬ মাস মেয়াদের জন্য অফশোর ব্যাংকিংয়ের মোট মূলধনের ২৫ শতাংশ ঋণ নিতে পারবে। তবে এই অর্থ শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল এবং সরকারের আমদানি বিল পরিশোধে খরচ করতে হবে।

আমদানির তথ্য জানাতে হবে:
আমদানি তদারকি করতে ৫০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের বেসরকারি যেকোনো আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারি আমদানির ক্ষেত্রে আগেই তথ্য জানানোর প্রয়োজন নেই।

আমদানি ও বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা:
ডলার সংকট নিরসনে আগেই সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে সরকার। এছাড়া দামি গাড়ি, প্রসাধনী, স্বর্ণালংকার, তৈরি পোশাক, গৃহস্থালীতে ব্যবহার্য বৈদ্যুতিক সামগ্রী, পানীয়সহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করেছে। এছাড়া এসব পণ্য আমদানিতে ব্যাংক ঋণ বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আয়ের নথিপত্র ছাড়াই রেমিট্যান্স পাঠানো:
আগে ৫ হাজার ডলারের বেশি পাঠালে আয়ের নথিপত্র জমা দিতে হতো। এই নিয়ম তুলে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন প্রবাসী আয় বাবদ দেশে যত পরিমাণ ডলার পাঠানো হোক না কেন, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করছে না এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো। এর বিপরীতে আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ:
বিদেশে পড়ে থাকা ব্যাংকগুলো সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলার দ্রুত আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিদেশে আটকে থাকা ১.৫০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এবং ব্যাংকগুলোর অ্যাকাউন্টে (বিদেশে থাকা দেশীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রায় অ্যাকাউন্ট) প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট প্রসিডস রিকনসিলিয়েশন হিসাবে আটকে আছে। এসব অর্থ দেশে আসলে মুদ্রা বাজারে সংকট অনেকটা নিরসণ হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।  

আরও পড়ুন: ডলারের দাম বৃদ্ধি: কারসাজির প্রমাণ পেলে লাইসেন্স বাতিল

/এনএফ/সাইফ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়