জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তে বিশিষ্টজনের ভাবনা
স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যাপক সন্ত্রাস-সহিংসতা, নৈরাজ্য এবং প্রাণহানির ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বুধবারের (৩১ জুলাই, ২০২৪) মধ্যেই সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হবে। নিষিদ্ধকরণ প্রক্রিয়া ঠিক করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসবেন তিনি।
ওর্য়াকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের বিষয়টি এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়ও আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু নিষিদ্ধ করা হয়নি। এখন বিবেচনায় নেওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপকালে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘তাড়াহুড়ো করে কোনো কাজই করা ঠিক নয়।’
তাড়াহুড়ো করে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হলে রাজনৈতিক তৎপরতা তারা অন্য নামে চালাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বঙ্গবীর বলেন, ‘জামায়াতে ইসলাম রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ হবে, এরপরে আবার আরেক নামে হবে। আসলে আমাদের চেতনার অভাব। এবং স্বাধীনতা অর্জনে আমরা যারা ছিলাম, আমরা সঠিকভাবে স্বাধীনতা মানুষের সামনে, নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে পারি নাই। এটা তারই ফসল।’
ইতিহাসবিদ, সাহিত্যিক ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘গত তিন দশক জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের কথাটা বলে আসছি। এক সময় অনেকেই বলেছেন। তারপরে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বলেছে। শাহরিয়ার বা আমি এই বিষয়ে বারবার বলেছি। সরকার গ্রাহ্য করে নাই। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যখন নিবন্ধন বাতিল হলো তখনো করে নাই। সরকার এখন বুঝেছে। তার মানে আমরা এতদিন যে কথা বলে এসেছি সেটার দিকে মনোযোগ দেয়নি। অর্থাৎ সিভিল সোসাইটির কথা তারা গ্রাহ্য করেনি। করে নাই দেখেই আজকে কেউ আর তাদের হয়ে কথা বলছে না। কিন্তু তারা বলতে বাধ্য হচ্ছে যে, জামায়াত নিষিদ্ধ করতে হবে। কিন্তু আমি মনে করি যে, হ্যাঁ ঠিক আছে। আমাদের দাবির কথা তারা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।’
অনেকেই মনে করেন জামায়াত নিষিদ্ধ করলে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে। তখন তাদের কার্যক্রম কেমন হতে পারে? ‘জামায়াত এখন আন্ডারগ্রাউন্ডেই আছে। তারা এখন যা করছে তখনও তাই করবে। তখন হয়তো তারা বিএনপির সঙ্গে আরও মিশে যাবে।’ বলেন এই ইতিহাসবিদ।
হঠাৎ একটি দলকে নিষিদ্ধ করা হলে দেশের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বে এর প্রভাব কেমন হতে পারে? প্রশ্নের জবাবে মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘এখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে অবশ্যই একটা অভিঘাত হবে। কারণ এখন আঠারো কোটি লোক হয়ে গেছে। এখন পক্ষে-বিপক্ষে একটা অভিঘাত হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও একটা অভিঘাত হবে।’
সরকারের করণীয় সম্পর্কে এই ইতিহাসবিদ বলেন, ‘জামায়াতের রাজনীতি এবং অর্থনীতির দিকে নজর দিতে হবে। তবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার আগে সরকারকে ভালোভাবে বিষয়টি বুঝতে হবে এবং জনগণকে নিয়ে বসতে হবে। একা সরকার এখন আর কোনো কাজ করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। সরকারের যোগাযোগ শুধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। সরকার সিভিল সোসাইটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। তা প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও আমরা বলবো সমস্ত কিছু ভেবেচিন্তে তারা যেন অগ্রসর হয়। হাফ হাইটেড কোনো ব্যাপার কাজে দেবে না।’
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর’ অধ্যাপক ড. খুরশীদা বেগম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আরও পঞ্চাশ বছর আগে যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল সেই সিদ্ধান্ত এখন নেওয়া হচ্ছে— এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তবে এখন এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য উপযুক্ত সময় কিনা তা ভাবার প্রয়োজন আছে।’
‘সিদ্ধান্ত শুধু নিলেই হবে না। সিদ্ধান্ত কবে নাগাদ কার্যকর হবে— সেটি ঠিক করতে সরকারকে অবশ্যই সিভিল সোসাইটির মতামত নিতে হবে। সরকারকে মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী এবং অগ্রসর সমাজের মানুষের মত নিয়ে প্রক্রিয়া ঠিক করতে হবে।’ যোগ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, ২৯ জুলাই ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্বকালে প্রধানমন্ত্রী জানান, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করবে সরকার। ওই বৈঠকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু সরাসরি জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেন। একই বৈঠকে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি বিকল্প শক্তিগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
তারা//