ঢাকা     রোববার   ০৬ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২১ ১৪৩১

নতুন বাংলাদেশে আমাদের প্রত্যাশা 

মীর রবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৮, ৮ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ১৭:১৯, ৮ আগস্ট ২০২৪
নতুন বাংলাদেশে আমাদের প্রত্যাশা 

অনেক স্বপ্ন নিয়ে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। স্বাধীনতার পরপরই স্বাধীন দেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা থমকে যায়। ১৯৭৫ পরবর্তীকাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যে ক’টি সরকার গঠিত হয়েছিল, সব সরকারের আমলেই দলীয়করণ, লাগামহীন দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সংখ্যালঘুদের পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলসহ ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যবসা বারবার মুক্তিযুদ্ধের দর্শনকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। আজ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকারের হাতেই বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের তথাকথিত ইজমের করুণ পরিহাসের সাক্ষী হলো জাতি। 

১৯৭৫-২০২৪ সাল পর্যন্ত জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার শাসন দেখেছে বাংলাদেশ। কোনো শাসকই মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ উপহার দিতে পারেনি, নিশ্চিত করতে পারেনি মানুষের মৌলিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, স্বাধীন বিচার বিভাগ, আইনের শাসন ও জননিরাপত্তা। এর বিপরীতে প্রত্যেকের হাতেই দেশের মানুষকে নানাভাবে নাস্তানাবুদ হতে দেখেছি আমরা। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কোনোটাই এ দেশে সত্যিকার অর্থে আলোর মুখ দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধের অধিকাংশ স্বপ্ন ও প্রত্যাশার বাস্তবায়ন আজও অধরা। মুক্তিযুদ্ধকাল ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে সবাই বয়সে এখনকার মতো তরুণ ছিলেন, এখনকার মতো তাদেরও অনেক স্বপ্ন ছিল। তারা চেয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ– যেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে; কোনো বৈষম্য থাকবে না। সব নাগরিক তার মৌলিক অধিকার ভোগ করবে। ঠিক একই রকম স্বপ্নে এ দেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। খালেদাবিরোধী আন্দোলনও এর বাইরে ছিল না। ২০২৪ সালে এসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনাবিরোধী গণঅভ্যুত্থানও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাইরে নয়। এ সময়ে এসে তরুণদের কাঙ্ক্ষিত ‘বৈষম্যহীন, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ’ ঠিক কতটা ফলপ্রসূ হবে তা বুঝতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। 

চলমান পরিস্থিতি থেকে কিছু ঘটনার দিকে আমরা এই মুহূর্তে নজর দিতে পারি। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের দিন (৫ আগস্ট ২০২৪) ও দিবাগত রাত থেকে অদ্যাবধি দেশের যে চিত্র দেখছি, তা আমাদের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি করছে। আওয়ামী লীগের পতনের মুহূর্তেই গণভবন, সংসদ ভবনসহ সারাদেশে গণলুট, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, সংখ্যালঘুদের আক্রমণ, বঙ্গবন্ধুসহ নানা ধরনের ভাস্কর্য ও স্থাপনা ভাঙচুরের ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করছে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা, সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী ও বিএনপি-জামায়াতের প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ কর্মকাণ্ড নতুন করে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহারের ফলে পুলিশের প্রতি জনক্ষোভও চিন্তার বিষয়। 

এরই মাঝে আমরা দেশব্যাপী নানামুখী ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ, লুণ্ঠন ও হত্যা সংঘঠিত হতে দেখেছি। যা শেখ হাসিনা সরকারের সাম্প্রতিক দমননীতির শিকারে মৃত্যুবরণ করা মানুষের সংখ্যা থেকে কম নয়। পুলিশহত্যা, থানায় আক্রমণের প্রতিবাদে পুলিশের কর্মবিরতির কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি চরমে।  দেশের মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা না করে বরং নিজেরাই আইন ভঙ্গ করছে। আওয়ামী লীগ ও হিন্দু নিশ্চিহ্ন কল্পে মানুষকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যার মতো নৃশংসতা দেখাচ্ছে। যা আমাদের তরুণদের এই আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমাদের প্রত্যাশা ঠিক এমনটা নয়। ইতোমধ্যে আন্দোলনের সমন্বয়কদের বক্তব্যেও সেসব কথা উঠে এসেছে। ফ্যাসিবাদের ফ্যাসিস্ট আচরণ কারো কাছেই কাম্য নয়। আমরা তরুণদের মনে করিয়ে দিতে চাই, ‘স্বাধীনতার উদযাপন কখনো লুটপাট, আগুন আর বৈষম্য দিয়ে শুরু হতে পারে না। এটা স্বাধীনতার চিত্র না’। একইভাবে ‘লীগের দালাল, ভারতের দালাল, নাস্তিক, কাফের’ ইত্যাকার ট্যাগ দিয়ে কাউকে হেনস্থা বা শারীরিক আক্রমণ কিংবা হত্যা আওয়ামী রেজিমের ‘রাজাকার, পাকিস্তানী, শিবির’ ট্যাগের সমান। যদি এসবের পুনারাবৃত্তি ঘটে, তাহলে এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কোনো অর্থই থাকবে না। সেই সঙ্গে ক্ষমতার হাত বদলে যদি বিএনপি জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে, সেটাও বাংলাদেশের জন্য শুভকর হবে না। এক শোষকের বিদায়ে পুরোনো আরেক শোষকের আবির্ভাব তরুণ সমাজও প্রত্যাশা করছে না। তাদের প্রত্যাশা রাজনৈতিক নতুন মেরুকরণ। সেটা হয়তো সময়সাপেক্ষ বিষয়। 

চলমান পরিস্থিতিতে কিছু ঘটনা আমাদের আশাহত করলেও দেশব্যাপী লুট, হত্যা, অগ্নিসংযোগ বন্ধ ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তরুণদের নানামুখী তৎপরতা আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। শেষ পর্যন্ত আমরা তরুণদের কাছে আশা করছি, এই নব-বিপ্লব যেন বেহাত না হয়। পুরোনো শোষক গোষ্ঠী জামায়াত-বিএনপি জোট,  হেফাজত-চরমোনাইদের মতো ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাতে যদি রাষ্ট্রক্ষমতা যায়, তাহলে পূর্ববর্তী ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ইতোমধ্যে তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি। এসবে অতি উৎসাহী কিছু মানুষও জড়িয়ে পরেছে। এদের প্রতিরোধ করা আবশ্যক। এসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পুরো জাতির জন্যই বিপদ। 

গণঅভ্যুত্থানে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশে আমাদের সকলের প্রত্যাশা অনেক। বিশেষত গণঅভ্যুত্থানকারী নতুন প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অধিক‌। তারা চাকরিক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন চাচ্ছে। মোটাদাগে বৈষম্য মুক্তির লক্ষ্যে গণতন্ত্র, মানবিকতা, ভোটের অধিকার ও ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের কথা বলছে। সেই ধারাবাহিকতায় নতুন বাংলাদেশে আমরা প্রত্যাশা করছি—

১. মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে সম্মানের জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। 
২. গণমাধ্যমসহ সকল মানুষের স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। 
৩. সকল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষ্যে সকলের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার দিতে হবে এবং সেই সঙ্গে ধর্ম পালনে অনিচ্ছুক মানুষের ধর্ম পালন না করার অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। ধর্মীয় উগ্রবাদ বন্ধে তৎপর থাকতে হবে।
৪. নারী নেতৃত্ব, নারী স্বাধীনতা ও তাদের অধিকার হরণ করা যাবে না। তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশে সকল হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। 
৫. দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির স্বাধীন চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। 
৬. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিতে সকল ধরনের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে বিজ্ঞানমুখী ও নৈতিক ধারায় আনতে হবে।
৭.বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকল সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে সুপরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। 
৮. বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে এবং আইন বহির্ভূত কর্মকাণ্ড বন্ধের নিশ্চয়তা দিতে হবে।  
৯. সামরিক ও বেসামরিক যে কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। 
১০. আদিবাসীদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। 

সর্বপরী নতুন বাংলাদেশে আমাদের প্রত্যাশা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী কাঠামো ভেঙে সকল ধরনের বৈষম্যমূলক ধারা সংস্কার করে বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তির বৈশ্বিক মান প্রতিফলনের জন্য সংবিধান এমনভাবে সংশোধন করা উচিত, যাতে সব নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকে। কার্যকারী গণতান্ত্রিক, আদর্শিক, মানবিক ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যাশায় পুরো প্রজন্ম এখন অপেক্ষমান। ছাত্র-জনতার জীবন ও রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ আবার নতুন কোনো স্বৈরাচারের হাতে না-পড়ুক এই প্রত্যাশা সকলের।

লেখক: কবি
 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়