ঢাকা     রোববার   ০৬ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২১ ১৪৩১

জেন জেড প্রজন্মের ভাষা ও রাজনৈতিক ন্যারেটিভ

অনার্য মুর্শিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫০, ১০ আগস্ট ২০২৪  
জেন জেড প্রজন্মের ভাষা ও রাজনৈতিক ন্যারেটিভ

দেশের মানুষ আজ আনন্দে আত্মহারা! আন্দোলন সফল করে প্রশংসায় ভাসছেন তরুণ ছাত্রসমাজ। কয়েক বছর আগেও বিশ্বজিৎ, সাগর-রুনী, তনু, আবরার কিংবা সিনহা হত্যা মামলার মতো হাজার হাজার মামলার বিষয়ে মানুষ নিরাশ ছিল এই ভেবে যে, এগুলোর বিরুদ্ধে কোনোদিন বোধহয় প্রতিবাদও করা যাবে না। নতুন প্রজন্মকে ‘টিকটক প্রজন্ম’ আখ্যা দিয়ে অনেকেই হতাশায় নিমজ্জিত ছিলেন। সম্রাট, পাপিয়া, মতিউর, বেনজির, আবেদ আলী- কত নাম আমাদের সামনে এসেছে-গেছে! আমরা প্রতিবাদে রাস্তায় দাঁড়াতে পারিনি। দেশের মানুষ ভাবেনি তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এভাবে একদিন প্রলয় বাণ ডেকে ভাসিয়ে দেবে শেখ হাসিনা সরকারকে। কিন্তু এ প্রজন্ম অনেক কথাই আজ ভুল প্রমাণ করেছে।

জুলাই বিপ্লব ছিল অবশ্যম্ভাবী। এর দানা বেঁধেছিল ২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলনে। এত বড় একটা সময় চলে যাওয়ার পরও আমরা এই জেনারেশনকে চিনতে পারিনি। আমরা কোনোদিন ভাবতেই পারিনি ক্যালেন্ডারের পাতায় ৩২ জুলাই বা ৩৫ জুলাই আসে। ৯ দফা হয়ে যায় ১ দফা! আমরা ‘হরতাল’ ‘অবরোধ’ শুনেছি, কোনোদিন ‘বাংলা ব্লকেড’ শুনিনি। এই জেনারেশন নতুন ভাষা, নতুন ন্যারেটিভ, নতুন বয়ান তৈরি করছে। যা আগামী দিনে জাতির পাথেয়। তাদের এই ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে তাদের বৈশিষ্ট্যের উপর।  আসুন চিনে নেই এই জেনারেশনের সেই বৈশিষ্ট্যকথা।  

কী নামে ডাকি তোমায়

কী নামে ডাকবেন? ডিজিটাল জেনারেশন? ডাকতেই পারেন। তবে সমাজ বিজ্ঞানীদের কাছে এরা ‘জেনারেশন জেড’ নামে পরিচিত। ‘জেন জেড’ হলো সেই প্রজন্ম যারা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে। এর আগের প্রজন্মটি ‘জেনারেশন ওয়াই’ নামে পরিচিত। নতুন এই প্রজন্ম আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছে, যেখানে প্রযুক্তির বিপ্লব এবং সামাজিক পরিবর্তনগুলো খুবই স্পষ্ট। এই প্রজন্মের মানুষের শৈশব এবং কিশোরবেলা ডিজিটাল যুগের উত্থানের সঙ্গে মিশে গিয়েছে, যা তাদের জীবনযাত্রা, মানসিকতা এবং চিন্তাভাবনার মধ্যে বড় প্রভাব ফেলেছে।

জন্ম এবং বেড়ে ওঠা

জেন জেড এমন একটি পৃথিবীতে জন্মেছে যেখানে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের ব্যবহার প্রায় সর্বব্যাপী। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্যের অ্যাক্সেস পেতে খুবই দক্ষ এবং তাদের অনেকেই গ্লোবাল ট্রেন্ড সম্পর্কে খুবই সচেতন। এরা কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে টিকটক, ইউটিউব এবং ইনস্টাগ্রামের মত প্ল্যাটফর্মে নিজেদের প্রতিভা ও চিন্তাভাবনা প্রকাশ করছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে এদের সম্পর্ক তাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে এবং তথ্যের প্রবাহকে আরো দ্রুত করেছে।

শিক্ষা এবং কর্মজীবনের ক্ষেত্রে জেন জেড-এর চিন্তাভাবনা পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় ভিন্ন। তাদের অনেকেই সার্টিফিকেট গ্রহণে অনাগ্রহী। তারা স্বশিক্ষিত। আমরা হয়ত লক্ষ্য করেছি, এই প্রজন্মের কিছু জানার প্রয়োজন হলে বড়দের আর জিজ্ঞেস করে না, গুগল ইউটিউব থেকেই জেনে নেয়। বাংলাদেশে কোভিডের আগ থেকেই অনলাইন স্কুলগুলো খুব জনপ্রিয় হচ্ছিল। পাঠ্য বইয়ের ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্যকেও তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্রস চেক করে। ফলে একপক্ষীয় ইতিহাস বা মতামত তারা গ্রহণ করে না। এই চিত্র শুধু বাংলাদেশেরই নয়, সারা বিশ্বে। 

কর্মজীবন ও ভবিষ্যৎ ভাবনা

তারা মূলত প্রথাগত শিক্ষাপদ্ধতির চেয়ে ব্যবহারিক এবং প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। তারা এমন কর্মক্ষেত্র পছন্দ করে যেখানে স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা রয়েছে। জেন জেড-এর অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং এবং উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে পছন্দ করে। কারণ এটি তাদের নিজেদের সময় নিয়ন্ত্রণ করার স্বাধীনতা দেয় এবং নিজেদের দক্ষতার উপর ভিত্তি করে কাজ করতে উৎসাহিত করে। ফাস্ট পোস্টের জরিপের ফল বলছে, তাদের অর্থ না থাকলেও রুচি নিয়ে প্রশ্ন করা যাচ্ছে না। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের উচ্চমূল্যের জিনিস পছন্দ। তারা সেই ব্র্যান্ডগুলোকেই গ্রহণ করে যাদের কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি আছে। অবাক করা বিষয় হলো, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে এরা কোনো সঞ্চয় করে না। তারা আজকের জন্য বাঁচতে চায়। তারা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আগ্রহী নয়। তারা ভবিষ্যৎকে অজনা গন্তব্য মনে করে। সম্প্রতি ইউএস ব্যাংকের তিন হাজার সক্রিয় এবং এক হাজার উঠতি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে জানা যায়, জেন জেডের ৩৮ শতাংশ জীবনের মান নিয়ে ভাবে, ৩৬ শতাংশ বিত্তশালী জীবনযাপন করতে চায় কিন্তু সঞ্চয় ছাড়া, ২৮ শতাংশ জানিয়েছে ইচ্ছেমতো জীবন ধারণ করতে চায়। বেবি বুমার্সের জরিপে দেখা যাচ্ছে ৬১ শতাংশ আর্থিক নিরাপত্তায় গুরুত্ব দিচ্ছে, ৩৩ শতাংশ সুস্বাস্থ্যে গুরুত্ব দিচ্ছে। 

সামাজিক ও পরিবেশগত চেতনা

জেন জেড প্রজন্মটি সামাজিক এবং পরিবেশগত সচেতনতার জন্য বিখ্যাত। তারা বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে সজাগ এবং ন্যায়বিচার ও সাম্যের পক্ষে সরব। বিশ্ব উষ্ণায়ন, পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে তারা খুবই চিন্তিত এবং এগুলো প্রতিরোধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এই প্রজন্মের মানুষ নিজেদের পছন্দ এবং আচরণের মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে এবং তারা এমন পণ্য ও পরিষেবা বেছে নেয় যেগুলো পরিবেশবান্ধব এবং সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল। এই প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কোরিয়ান পপ গান শোনে। এদের মধ্যে জনপ্রিয় বিটিএস। বিটিএস দুই বছর আগে জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। বিটিএসের দলপ্রধান কিম নামজুন বৃক্ষপ্রেমী। তার জন্মদিনে সরা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের ভক্তরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষরোপণ করে।  

মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি 

জেন জেড-এর মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তারা মানসিক স্বাস্থ্যকে স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং এ সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা করে। তারা বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মোকাবিলা করতে সক্ষম এবং প্রয়োজনে পেশাদার সহায়তা নিতেও দ্বিধা করে না। জেন জেড-এর সাংস্কৃতিক পছন্দ এবং প্রভাব আমাদের সমাজে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। তারা এমন মিডিয়া কন্টেন্ট পছন্দ করে যেগুলো তাদের মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তাদের চিন্তাভাবনাকে প্রতিফলিত করে। তারা বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কন্টেন্ট এবং বিনোদনমূলক মাধ্যমগুলোকে বেশি পছন্দ করে। তাদের পছন্দের মাধ্যমে সমাজে সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য এবং অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব উঠে আসে। যে কারণে আপনি কোটা আন্দোলনেও দেখবেন তারা সাম্য এবং ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করেছে।

তারা যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বেশিক্ষণ সময় নেয় না। সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করে। সরকার যদি তাদের সাইকোলজি বুঝত তাহলে কোটা আন্দোলনে দীর্ঘসূত্রিতা করত না। এরা এক কথার মানুষ। যা সিদ্ধান্ত নেয় তা করতে পিছপা হয় না। সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর অ্যানালিটিকস এবং তাদের এককেন্দ্রিক সাজেশানের ফলেই হয়ত এই প্রজন্মের চরিত্রের ধরন এমন হয়েছে।

তারা টেলিভিশন এবং মিডিয়া নিয়ে ভাবে না। সোশ্যাল মিডিয়াকেই তারা মিডিয়া হিসেবে গণ্য করে। বড় মিডিয়াগুলোর মোজো ডিপার্টমেন্টকেই তারা অনুসরণ করে। কোটা আন্দোলনের সহিংসতার জন্য সম্প্রতি  তথ্যপ্রতিমন্ত্রী সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করেন এবং গুজব এড়াতে অনেক মন্ত্রী মেইন স্ট্রিম মিডিয়াগুলো অনুসরণ করতে বলেছিলেন। এই রাজনীতিকগণ আমাদের প্রজন্মকে বুঝতে পারেনি বলেই এমন মন্তব্য করেছেন। প্রজন্মের একমাত্র মিডিয়া সোশ্যাল মিডিয়াকে বন্ধ করে দিয়ে তারা প্রজন্মের চক্ষুশূল হয়েছেন। 

রাজনৈতিক দর্শন

জেনারেশন জেড সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার ক্ষেত্রে বেশ সক্রিয় এবং সাহসী। বর্তমান বিশ্বে অনেক রাজনৈতিক আন্দোলন রয়েছে যেখানে জেন জেড-এর বড় ভূমিকা রয়েছে। আমরা যারা এতোদিন বলে এসেছি, এই জেনারেশন রাজনৈতিকভাবে উদাসীন, তাদের জ্ঞাতার্থে বলতে পারি, এই জেনারেশন রাজনীতির অতীত ঘাটাতে চায় না। বর্তমানের কোনো কিছুতেই তাদের আস্থা নেই। তারা সব কিছুতেই এক ধরনের ডিকনস্ট্রাকটিভ মানসিকতা নিয়ে চলে। এরা যথেষ্ট ডিসেন্ট্রালাইজড। সব রকম সেন্ট্রালাইজেশনের বিপক্ষে তারা। আ. লীগ, বিএনপি, জামায়াত, সিপিবি- কোনো ঐতিহ্যবাহী দলের প্রতি তাদের দৃষ্টি নাই। সবাইকেই তারা প্রশ্ন করতে পারে, সন্দেহ করতে পারে। প্রশ্ন করা এই প্রজন্মের একটা বড় দর্শন। যা আমাদের ওয়াই জেনারেশনে ছিল না। এই প্রজন্মের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে তার বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে, যা গবেষণার দাবি রাখে। 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়