ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বৈশাখ সাংস্কৃতিক নবজাগৃতির উৎসমুখ || শামসুজ্জামান খান

শামসুজ্জামান খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২১, ১৫ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বৈশাখ সাংস্কৃতিক নবজাগৃতির উৎসমুখ || শামসুজ্জামান খান

শামসুজ্জামান খান, ছবি : মোহাম্মদ আসাদ

বাংলাদেশ প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অংশ। এই সভ্যতা কৃষি সভ্যতা। নদী তীরবর্তী গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশের এই সভ্যতা বেশ প্রাচীন। মিসরের নীলনদ তীরবর্তী অঞ্চলে যেমন প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা, চীন ও মেসোপটেমিয়ায় যে সভ্যতা তাও নদী তীরবর্তী এবং সুপ্রাচীন। প্রাচীন কৃষি সভ্যতার আনুষঙ্গিক নানা সংস্কার-বিশ্বাসও এই সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। এসব সংস্কার প্রথমে কৃষি উৎসবের অঙ্গীভূত ছিল, পরে নববর্ষ উৎসব চালু হলে এসব সংস্কারমূলক আঞ্চলিক উৎসব তার সঙ্গে যুক্ত হয়। বাংলাদেশের প্রাচীন এমন একটি সংস্কারমূলক উৎসবের নাম ‘আমানি’।

আমানি ছিল মেয়েলি উৎসব, এর লক্ষ্য ছিল পরিবারের কল্যাণ ও পারিবারিক কৃষির সমৃদ্ধি কামনা। এই পারিবারিক উৎসবের আচার সম্পন্ন করতেন বাড়ির মহিলাকর্ত্রী। কৃষি আবিষ্কারে নারীর পথিকৃতের ভূমিকা এবং তারই ফলে নারীতান্ত্রিক বা মাতৃতান্ত্রিক সমাজের স্মৃতিচিহ্নবাহী বলে কেউ কেউ এ আচারমূলক অনুষ্ঠানটিকে চিহ্নিত করেন। এ ছাড়া সমাজে শত্রু নিধনের আচার পালন করার রীতি ছিল বছরের প্রথম দিনে। লোকবিশ্বাস ছিল, এতে সারা বছর শত্রুর আক্রমণ ও অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এর সঙ্গে নববর্ষে উদযাপন করা হতো বিগত বছরের গ্লানি মুছে ফেলার কামনায় কিছু আচার-অনুষ্ঠানও। চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী কোনো কোনো অঞ্চলে এ ধরনের অনুষ্ঠানের খবর পাওয়া যায়।

অন্যদিকে চৈত্রসংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখের দিনে গাজন বা চড়ক অনুষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে নতুন বছরের শুভ কামনা। চড়কের বাণফোঁড়ের ক্লেশের মধ্য দিয়ে বিগত বছরের পাপক্ষয়ের আরাধনা এবং নতুন বছরের সুখ কামনা করা হতো। আবার অন্য একটা চিত্রও পাওয়া যাচ্ছে। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছেন: ‘প্রাচীনকালে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে নববর্ষের উৎসব হতো। দোলযাত্রা বা হোলি সেই উৎসবেরই স্মারক।’ ‘দোলযাত্রা’ ও ‘হোলি’ আনন্দোৎসব- চড়ক ক্লেশ ও বেদনার। তাহলে দেখা যাচ্ছে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষকে জোড়া উৎসব ধরা হলে তা একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনা দু’ ধরনের উৎসবকেই অঙ্গীভূত করেছে।

দুই

বাংলা নববর্ষের উৎসব এখন বাংলা বর্ষপঞ্জির বোশেখ মাসের প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত হয়। বহু আগে নববর্ষ যে অন্য সময়ে হতো তার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে নববর্ষের কথা উল্লেখ করেছেন। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিতায় অগ্রহায়ণ বন্দিত হয়েছে এই ভাষায়, ‘ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, ধন্য অগ্রহায়ণ মাস। বিফল জন্ম তার, নাই যার চাষ।’ কবির অগ্রহায়ণ বন্দনার কারণ- যতদূর জানা যায়, তখন অগ্রহায়ণ মাসে নববর্ষ ছিল। তবে কখন কীভাবে বৈশাখ মাসে নববর্ষ উদযাপন শুরু হলো তা জানা যায় না। কিন্তু মুকুন্দরামের সময়ে অগ্রহায়ণ মাসে যদি নববর্ষ হয়ে থাকে তাহলে ভারতচন্দ্রের সময়ে যে বৈশাখে নববর্ষ হয়ে গেছে তার প্রমাণ আছে তাঁরই কবিতায়:  বৈশাখে এ দেশে বড় সুখের সময়। নানা ফুল গন্ধে মন্দ গন্ধবহ হয়।’ তাছাড়া বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এবং আলীবর্দি খাঁ বৈশাখের  প্রথম দিনে পুণ্যাহ করতেন। এদেশের কবিদের কবিতা ও গানে নববর্ষের নানা আবহ ফুটে উঠেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা নববর্ষের উৎসবকে ভিন্ন তাৎপর্য ও নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন। ফলে বাংলা নববর্ষ হয়ে ওঠে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিক মিলনমেলা। স্বার্থহীন বা লোভ-লালসাহীন মানবমৈত্রীর গভীরতর দ্যোতনায় বৈশাখের এ অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে সর্বসম্প্রদায়ের সম্প্রীতি ও ঐক্য চেতনার প্রতীক। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বাঙালি জাতির এক সর্বজনীন মহান উৎসব। সকল বাঙালির মিলনমেলা। কৌম, গোত্র বা সম্প্রদায়ের আঞ্চলিক ক্রিয়াকরণধর্মী, আঞ্চলিক নববর্ষ উৎসব-আচারের জায়গায় গড়ে উঠতে থাকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির ঐতিহ্যভিত্তিক নতুন এক জাতীয় দিবস : বাংলা নববর্ষ, বাঙালির নববর্ষ।

তিন

সুপ্রাচীনকাল থেকে বঙ্গদেশে বাঙালি কৃষিজীবী মুসলমান সম্প্রদায় নানা দেশীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ আবাহন করেছেন। হিন্দু জমিদারের পুণ্যাহ আর দোকানদার-মহাজনের হালখাতা অনুষ্ঠানে সাধ্যমতো অংশ নিয়েছে। জমিদারি উচ্ছেদের পর পুণ্যাহ অবলুপ্ত হয়েছে। কৃষি অর্থনীতিতে নগদ পয়সার নিত্যনৈমিত্ত প্রবাহ না থাকায় বাকিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বেচাকেনা ছিল অপরিহার্য। ফলে হালখাতার গুরুত্বও ছিল বিরাট। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখন ভোক্তার সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বাংলাদেশে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ঢুকে যাওয়ায় মানুষের হাতে নগদ পয়সাও জমা হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কেনাকাটায় বাকির ব্যবসা প্রায় উঠেই গেছে। আর তাই জৌলুস হারিয়েছে হালখাতা অনুষ্ঠানটিও। তবে নববর্ষের অন্যান্য গ্রামীণ অনুষ্ঠান ও মেলা এখনো কিছু পরিমাণে চালু আছে, উদাহরণ হিসেবে লাঠিখেলা বা কাঠি নাচ (কুষ্টিয়া, নড়াইল ও কিশোরগঞ্জ), ষাঁড়ের লড়াই  (কেন্দুয়া, নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চল), মোরগের লড়াই (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), গরুর দৌড় (মুন্সিগঞ্জ), হাডুডু খেলা (মানিকগঞ্জসহ অন্যান্য স্থানে) এবং সারা দেশে নানা রকমের মেলার নাম উল্লেখ করা যায়। এসব অনুষ্ঠান-উৎসব বা প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সার্বিক আনন্দের উৎস এবং ঐতিহ্যে অংশগ্রহণের উপযোগী মাধ্যম। কিন্তু সর্বজনীন জাতীয় বিস্তার এসব অনুষ্ঠানের ছিল না এবং এসব অনুষ্ঠানকে পরিকল্পনার মাধ্যমে নববর্ষের উৎসবের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্তও করে নেওয়া হয়নি।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নব উদ্ভূত শিক্ষিত নগরবাসী বাঙালি মুসলমান ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র-কাঠামোর মধ্যেও তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নানা গোষ্ঠীর আচার অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকরণকে জাতীয় আধারে বিন্যস্ত করে নতুন এক সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগঠনমূলক কর্মকাণ্ডে শামিল হতে প্রয়াসী হয়। কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক এবং পূর্ব বাংলায় তার অনুসারীরা বাঙালির সমন্বিত সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করেছে, একে নানা কৌশলে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। কারণ এর মধ্যে তারা দ্বিজাতি তত্ত্বের মৃত্যুবীজের অঙ্কুরোদগম লক্ষ করেছে। তাই এর বিরুদ্ধে শুরু করেছে বাঙালিকে জাতিগত নিপীড়ন- তার আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে দেওয়ার কূটকৌশল। এই ধারাতেই বাধা এসেছে বাঙালির নববর্ষ উদযাপনেও। ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ উৎখাত হয়ে যাওয়ার পরই শুধু যুক্তফ্রন্ট সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে বাঙালির জাতিগঠন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি সুস্পষ্ট পথনির্দেশ দান করেন এবং সে বছর বিপুল উৎসাহে বাঙালি নববর্ষ উদযাপন করে।

চার

তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ৯২-ক ধারা জারি করে স্বৈরশাসন চালু এবং রাজনৈতিক কর্মী, এমনকি সংস্কৃতিক্ষেত্রের প্রগতিশীল সক্রিয়বাদীদের বিপুলহারে গ্রেপ্তার করায় সংস্কৃতির মুক্তধারার যে উৎসমুখটি খুলে গিয়েছিল তা আবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসন জারি হওয়ায় মুক্তবুদ্ধির চর্চা, গণমুখী সংস্কৃতির অনুশীলন একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু জনতার সংগ্রাম থেমে থাকতে পারে না। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগ বের করে গোপন লিফলেট ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’। ১৯৬২ সালে চার ছাত্রনেতার নেতৃত্বে স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস গঠন, এই বছরেই ‘দেশ ও কৃষ্টি’ বইয়ে বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও ছাত্রদের শিক্ষা আন্দোলন সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ওপর তীব্র আঘাত হানতে থাকে এবং বাঙালির এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলন তার রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়। এই সময়ের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’ এক নতুন ও নব দিকনির্দেশক স্লোগান হিসেবে আবির্ভূত হয়। বাঙালিত্বের চেতনার তীব্র চাপে সে বছর (১৯৬৪) প্রাদেশিক সরকার বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে। সেদিন ঢাকার বিভিন্ন নববর্ষ অনুষ্ঠানে অভূতপূর্ব জনসমাগম হয়। বাংলা একাডেমি, পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ, ছায়ানট (প্রতিষ্ঠা ১৯৬১), পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ, নিক্বণ ললিতকলা কেন্দ্র, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, সমাজকল্যাণ কলেজ ছাত্র সংসদ, গীতিকলা সংসদ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে হাঙ্গামার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার পরও বাংলা একাডেমির বটতলায় ‘ঐক্যতানের’ অনুষ্ঠানে এত দর্শক-শ্রোতার সমাগম হয় যে, ভিড়ের চাপে কয়েকজন আহত হয়। বাঙালির নববর্ষ অনুষ্ঠানে এত বিপুল মানুষের উপস্থিতি দেখে দৈনিক ‘পাকিস্তান অবজারভার’ বিস্ময় প্রকাশ করে।

এরপর বাংলা নববর্ষকে জাতীয় উৎসবে রূপ দিয়ে রমনার অশ্বত্থমূলে অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ‘ছয় দফা’ আন্দোলন শুরু করার পর এই আয়োজন এক নতুন রাজনৈতিক তাৎপর্য লাভ করে। সেই থেকে বাংলা নববর্ষ সকল বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়