ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কী আছে তার গেরুয়ারঙের ঝুলিতে?

মিনার মনসুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ১৪ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কী আছে তার গেরুয়ারঙের ঝুলিতে?

একদা যে ছিল অজপাড়াগাঁর ছন্নছাড়া এক বাউল- প্রান্তজনের নির্মল আনন্দের আর শাসককুলের খাজনা আদায়ের উপলক্ষ্য- সেই পহেলা বৈশাখ গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে। আসতোই। তার এই আসাটা কেউ ঠেকাতে পারতো না। তফাৎ এটুকুই যে করপোরেটওয়ালাদের গরম অর্থের বিপুল প্ররোচনায় আসাটা কেবল ত্বরান্বিতই হয় নি, সে-সঙ্গে তার চোখধাঁধানো জৌলুস আর তাকে ঘিরে রমরমা বাণিজ্যের তীব্র কলরব এখন নগরজীবনকেও গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। এটা ভালো কি মন্দ তা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে বোদ্ধামহলে ব্যাপক তর্ক চলছে। সেই তর্ক শোনার এবং তাতে যৎসামান্য অংশগ্রহণের সুযোগ আমারও হয়েছে। হচ্ছে প্রতিনিয়ত।



তর্ক মানেই পক্ষ-বিপক্ষ। তৃতীয় একটি পক্ষও অবশ্য আছে। তার কথা পরে বলা যাবে। আপাতত বিবাদমান দুই পক্ষের যুক্তিগুলো পরখ করে দেখা যাক। এক পক্ষ (মূলত কর্মজীবী বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও কেরানিকুল) বৈশাখের এই নগরায়ণে দারুণ খুশি। কাজটি কে করলো, কেন করলো- এসব নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। তারা খুশি একাধিক কারণে। প্রথমত, তাদের যুক্তি হলো, নিরানন্দ ও একঘেয়ে এই নগরজীবনে যদি খানিকটা গ্রাম্য বা গ্রামীণ সুঘ্রাণ মেলে তাতে মন্দ কী! দ্বিতীয়ত, মূলত জীবিকার তাগিদে গ্রামীণ জীবন ছেড়ে আসতে বাধ্য হলেও সেই জীবন তাকে এখনো ডাকে। পীড়িতও করে। কারণ যারা তাকে পেলে-পুষে বড় করেছে, পেছনে ফেলে আসা সেই মা ও মাটির জন্যে কিছু করতে না পারার কারণে তার মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধও কাজ করে। এমনও শুনি যে অনেকে তাদের বৃদ্ধ মা-বাবার খোঁজও রাখেন না বা রাখতে পারেন না। ফলে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে নাগরিক এই আড়ম্বর যতই মেকি হোক- এটা তার সেই পুরনো ক্ষতে কিছুটা প্রতিষেধকের কাজও করে। তাকে দু’দণ্ড শান্তি দেয়। সর্বোপরি, চলনে-বলনে যার যত ফুটানিই থাকুক, একথা তো অনস্বীকার্য যে সুরম্য ফ্ল্যাটবাসী থেকে হতশ্রী বস্তিবাসী নির্বিশেষে প্রায় সবাই তো এই নগরে ‘পরবাসী’।  শিকড়চ্যুত এই মানুষগুলো ক্ষণিকের জন্যে হলেও শিকড়ের সংযোগ অনুভব করে বৈশাখের এই নগরাগমনে। এর বাইরে বৈশাখকে ঘিরে অন্য কোনো বৃহৎ বা মহৎ ভাবনা নিয়ে তার বা তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। সে বা তারা মূলত নিজেকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত।

বৈশাখের বাণিজ্যিকীকরণ ও নগরায়ণে অন্য পক্ষটি (মূলত প্রগতিবাদী সাহিত্যিক, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক ও উচ্চশিক্ষিত তরুণ সমাজ) শুধু যে উদ্বিগ্ন তা-ই নয়, তারা মহা ক্ষুব্ধও বটে। এই অংশটি সমাজে সংখ্যালঘু হলেও তাদের এই উদ্বেগ ও ক্ষোভের কারণগুলো কিন্তু মোটেও সামান্য নয়। বৈশাখকে তারা তাদের জাতিগত অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করেন। তার পেছনে যুক্তির জোরালো সমর্থনও আছে। এ কথা তো মিথ্যা নয় যে, বাঙালিত্বের যে অভেদ্য চেতনা আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে- তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ হলো এই পহেলা বৈশাখ। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে যে, পাকিস্তানি জান্তা যখন আমাদের সংস্কৃতির ওপর উপর্যুপরি হামলা চালিয়েছে, তখন বৈশাখের বর্ম দিয়ে আমরা তা রুখে দিয়েছি। সেই আইয়ুবী কালো দশকে রমনার বটমূলকে ঘিরে বাঙালি সংস্কৃতির যে অভেদ্য দুর্গটি গড়ে উঠেছিল ছায়ানটের নেতৃত্বে, তা আজও আমাদের স্বাধীনতা ও প্রগতির অনির্বাণ বাতিঘর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে ক্লান্তিহীনভাবে। শত্রুরা সেটা জানে। জানে বলেই এই সেদিনও সেই বাতিঘর নিভিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছে উগ্র মৌলবাদী শক্তি। ছায়ানট-এর ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ উৎসবে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে প্রগতিমুখী জনস্রোত। কিন্তু বৈশাখের রুদ্ররোষে পাকিস্তানিদের সকল ষড়যন্ত্র যেমন ভস্মীভূত হয়েছে, এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

বললে অত্যুক্তি হবে না যে অর্জুনের যেমন গাণ্ডীব, বাঙালিরও তেমনি পহেলা বৈশাখ। বাঙালিমানসের অনেক গভীরে প্রোথিত তার শিকড়। হাতিয়ার বলি বা সুরক্ষা বর্মই বলি- বাঙালির এই যে অমূল্য সম্পদ তাকে যদি বিকিকিনির হাটে তোলা হয় চাল-ডাল-লবণের মতো, পরিণত করা হয় বারোয়ারি পণ্যে- তাহলে দেশপ্রেমিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মাত্রই উদ্বিগ্ন বোধ করবেন- এটাই স্বাভাবিক। তারা যদি এমন আশঙ্কার উত্তাপও অনুভব করেন যে দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়ার শক্তি প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েও যে-ক্ষতি করতে পারেনি বাঙালি সংস্কৃতির, বৈশাখকে নিয়ে যারা মস্তবড় বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে- তারা তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করছেন বা করে চলেছেন- তবে এই মানুষগুলোকে খুব একটা দোষও দেয়া যাবে না। এ কথা তো অনস্বীকার্য যে, যে-কাজটি আমি বা আমরা দেশাত্মবোধের গভীর চেতনাতাড়িত হয়ে করি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে, তার সঙ্গে করপোরেটওয়ালাদের মোটা অঙ্কের অর্থের প্রণোদনা বা প্ররোচনায় সম্পাদিত কাজ কখনো এক হতে পারে না। প্রকৃত কবিতার সঙ্গে বিজ্ঞাপনী সংস্থার তৈরি শ্রুতিমধুর চটকদার বক্তব্যের যে-তফাৎ, এক্ষেত্রেও ঠিক তাই। প্রথমটি হৃদয়জাত ও স্বার্থগন্ধশূন্য, দ্বিতীয়টি ফরমায়েসি, ফাঁপা এবং বিশেষ বাণিজ্যিক স্বার্থ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।আমরা পছন্দ করি বা না করি, এটা মুক্ত বাণিজ্যের যুগ। বাণিজ্যই এখন সভ্যতার চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর টাকা বা অর্থই হলো একালের আসল দেবতা- তা সে অর্থ যেভাবেই উপার্জিত হোক না কেন। অতএব, যেখানে লাভের ন্যূনতম সুযোগ বা হাতছানি আছে, দেশি-বিদেশি বণিকরা সেদিকেই ছুটবেন এটাই স্বাভাবিক। এমনকি বড়দিন কিংবা দুর্গাপূজার মতো ধর্মীয় উৎসবও ওদের দখলে চলে গেছে বহু আগেই। ব্যতিক্রম নয় ঈদ উৎসবও। লক্ষণীয় বিষয় হলো, গত কয়েক বছরে বৈশাখের পেছনে বিনিয়োগ ও বৈশাখকেন্দ্রিক বাজার এতটাই বেড়েছে যে মুসলমানপ্রধান বাংলাদেশে এখন ঈদ উৎসবের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে বাংলা নববর্ষকেন্দ্রিক এই উৎসব-আয়োজন। পহেলা বৈশাখ উদযাপনের উচ্ছ্বাস যেমন ক্রমবর্ধমান, তেমনি দিনদিন ফুলেফেঁপে উঠছে তার বাজার। বাস্তবতা হলো, এই বিনিয়োগ ও বাজারকে কোনোমতেই আর ঠেকানো যাবে না। কেউ যদি সেটা করার কথা ভাবেন- তা হবে বালির বাঁধ দিয়ে জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতোই অবাস্তব ও হাস্যকর একটি চিন্তা।

অতএব, শতকোটি টাকার প্রশ্নটি হলো, তাহলে করণীয়টা কী? বৈশাখকে ঘিরে এই রমরমা বাণিজ্য বহাল রেখে আমাদের অস্তিত্বের এই বাতিঘরটি কি বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব? আমি বলি, সম্ভব। আমার কথা শুনে অনেকে চমকে উঠতে পারেন। রেগে গিয়ে পড়া বন্ধ করে দিতে পারেন এ লেখা। কিন্ত কোনো প্রকার আবেগের বশে নয়, অনেক ভেবেচিন্তেই আমি বলছি- এটা সম্ভব। সহৃদয় পাঠকের হয়ত মনে থাকতে পারে যে, বিবাদমান দুটি পক্ষের বাইরে আমি একটি তৃতীয় পক্ষের কথা বলেছি এ লেখার শুরুতে। তাদের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিলেই আমি যে-কথা বলছি তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বোঝা সহজ বলে আমার বিশ্বাস। প্রথমেই জানা যাক, কারা এই তৃতীয় পক্ষ? লক্ষণীয় যে বৈশাখকে ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে জনতার যে বাঁধভাঙা ঢল নামে তার প্রায় ৯০ শতাংশই বিবাদমান দুটি পক্ষের কোনো একটি পক্ষভুক্ত নন। এরা মূলত নগরবাসী প্রান্তিক মানুষ। অত ভাবনাচিন্তার ধার তারা ধারেন না। আনন্দের উপলক্ষ্য পেলেই তারা সেখানে ছুটে যান। তবে তারা যে সবকিছুতে আনন্দ পান, প্রাণের টান অনুভব করেন তা কিন্তু নয়। এমনকি বড় বড় রাজনৈতিক দলের সভাসমাবেশগুলোতেও এখন লোকসমাগম করা কঠিন চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে এটা নিঃসন্দেহে খুব স্বস্তির বিষয় যে, আমাদের নগরকেন্দ্রিক জনসংখ্যার বড় একটি অংশ বৈশাখের সঙ্গে এক ধরনের নাড়ির টান অনুভব করছেন। এরকম উদাহরণ আমাদের দেশে অমর একুশের প্রভাতফেরি আর বইমেলা ছাড়া আর কী আছে? নিঃসংশয়ে বলা যায়, নাই। এরাই হলেন সেই তৃতীয় পক্ষ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এমনকী আমাদের সমাজ ও রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কী হবে- সেটাও কিন্তু নির্ধারিত হয় আপাত নিরীহ ও নির্বিরোধ এই পক্ষটি কোনদিকে ঝুঁকছেন তার ভিত্তিতে। অতএব, এদেরকে হেলা করা যাবে না কোনোভাবেই।

বৈশাখের টানে লাখ লাখ মানুষ যে বউ-বাচ্চা, আত্মীয় পরিজন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে, উপহার বিনিময় করছে, একে অপরের সঙ্গে মিলছে, মেলাচ্ছে- ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা, ধর্মান্ধতা ও সহিংসতার এই যুগে নিঃসন্দেহে এ এক বিশাল শক্তি। আশা ও ভরসার দিক হলো, তারা এমন এক উপলক্ষ্য ঘিরে একত্রিত হচ্ছে, আনন্দে মেতে উঠছে- যে উপলক্ষ্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির; যে উপলক্ষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির। সর্বোপরি, তার অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার। চেতনার এই শক্তি কাপ্তাইয়ের পাহাড়ি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে কয়েক লাখ গুণ বেশি আলোর উৎস হতে পারে- যদি পরিকল্পিতভাবে আমরা তাকে কাজে লাগাতে পারি। জনস্রোতকে থামানোর দরকার নেই, বারণ করার দরকার নেই করপোরেটওয়ালাদের। তারা তাদের কাজ করুক। আমরা আমাদের কাজ করি। আমরা যারা যুগপৎ বাঙালিত্বের ও মানবিকতার চেতনা ধারণ করি নিজের মধ্যে- তাদের আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। এটা মোটেও গর্বের বিষয় নয় যে, গত প্রায় ছয় দশকে আমরা ছায়ানট-এর মতো দশ-বিশটি নয়, আর একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের প্রতিটি জেলা-উপজেলায়, সম্ভব হলে গ্রামে গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় এমন অজস্র সংগঠন গড়ে তুলতে হবে যেখানে বাঙালিত্বের ও মানবিকতার চেতনার চর্চা হবে। কেবল পহেলা বৈশাখেই নয়, বছরজুড়ে নানা উপলক্ষে সচল রাখতে হবে এই চেতনা চর্চার ধারা। এক্ষেত্রে যতদূর সম্ভব, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে বেশি নজর দিতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বাঙালির ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির চর্চার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে সমভাবে।

আমরা মহা ভাগ্যবান যে পহেলা বৈশাখ তার গেরুয়ারঙের ঝুলিতে করে প্রতি বছর অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানুষে মানুষে মিলনের যে বিশল্যকরণী বয়ে নিয়ে আসে- নিউজিল্যান্ডের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে, বর্তমান বিশ্বে তার চেয়ে দামি কিছু নেই। এ সম্পদকে আমরা যেন কোনোভাবেই হেলা না করি। যেন মুহূর্তের জন্যেও তার মূল্য ও তাৎপর্য ভুলে না যাই।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়