ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কর্মমুখী শিক্ষায় দূর হবে বেকার সমস্যা

রিয়াজুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ৮ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কর্মমুখী শিক্ষায় দূর হবে বেকার সমস্যা

রিয়াজুল হক: ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ৪০তম বিসিএস-এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এই বিসিএস-এ মোট ১ হাজার ৯০৩ জন ক্যাডার নিয়োগ দেয়া হবে। কিন্তু এই সীমিতসংখ্যক চাকরির বিপরীতে আবেদন করেছেন ৪ লাখ ১২ হাজার ৫৩২ জন প্রার্থী। দেশের ইতিহাসে এটি রেকর্ড। বিসিএস-এর শিক্ষাগত যোগ্যতায় বলা হয়েছিল, (ক) কোন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী/চার বছর মেয়াদী স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী বা সমমানের ডিগ্রী; (খ) স্বীকৃত বোর্ড হতে এইচ.এস.সি পরীক্ষা পাসের পর ৪ বছর মেয়াদী শিক্ষা সমাপনী ডিগ্রী অথবা সমমানের ডিগ্রী। তবে কোনো প্রার্থীর শিক্ষা জীবনে একাধিক ৩য় বিভাগ/শ্রেণি বা সমমানের জিপিএ থাকলে তিনি যোগ্য বিবেচিত হবেন না।

চার লক্ষাধিক উচ্চ শিক্ষিত চাকরি প্রার্থী মাত্র ১৯০০ পদের জন্য প্রায় দুই বছর ধরে চাকরি পাওয়ার জন্য লড়াই করে যাবেন, যাদের বয়স আবার ৩০ বছরের কম। কি ভয়ঙ্কর চিত্র! অনেক উন্নত দেশের মোট জনসংখ্যা আমাদের দেশের এই চাকরি প্রার্থীর সংখ্যার থেকে কম। এই হচ্ছে বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের অবস্থা। সবাই সার্টিফিকেটধারী বিএ, এমএ পাশ। কিন্তু পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়া এদের কোন বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান নেই। এদের পুরোপুরি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ছোট এই দেশে আদৌ সম্ভব নয়। এতো অফিসারের পদ আমাদের দেশে আদৌ নেই। অথচ প্রতি বছরই চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান ধরন অনুযায়ী এই সমস্যা অদূর ভবিষ্যতে আরো জটিল হবে।

প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষা চালু করতে হবে। সহজ কথায়, কারিগর তৈরি করতে হবে। অষ্টম শ্রেণি শেষ হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা গ্রহণের দুটি দিক থাকবে। একদল যাবে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায়, অন্য দল কর্মমুখী শিক্ষায়। যেসব শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ ৩-এর কম পাবে, তারাই পরবর্তী পর্যায়ে কর্মমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নেবে। বিভিন্ন বিষয়ভেদে এই প্রশিক্ষণের মেয়াদ হবে দুই থেকে পাঁচ বছর। প্রশিক্ষণ শেষে বোর্ড থেকে তাদের সার্টিফিকেট দেয়া হবে। কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় মাছের চাষ, হাঁস-মুরগির খামার, পশুপালন, ফলের চাষ, ড্রয়িং, গ্রাফিকস ডিজাইন, পোল্ট্রি ফার্ম, ডেইরি ফার্ম, বুটিকশিল্প, কম্পিউটার ট্রেনিং অ্যান্ড সার্ভিসিং, মোবাইল সার্ভিসিং, সেলাই, ইলেকট্রনিক সামগ্রী সার্ভিসিং, সেলুন, ক্ষুদ্র ব্যবসা, হস্তশিল্প, কাঠের কাজ, বেতের কাজ, বাঁশের কাজ, লেদ মেশিন স্থাপন, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ, হোটেলসংক্রান্ত ট্রেনিং, চুলকাটার ট্রেনিং, দর্জি, কলকারখানার কাজ, সেলসম্যানশিপ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষিত ও দক্ষ হবে। ওস্তাদের কাছ থেকে দেখে দেখে শেখে। এর মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়। আমরা আলপিন তৈরি করতে পারি না, সেপটিপিন তৈরি করতে পারি না, স্ক্র তৈরি করতে পারি না। অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়, এটা উন্নয়ন সহায়ক নয়।

আমাদের প্রয়োজন কারিগর, দক্ষ কারিগর। নামধারী বিএ, এমএ পাস হওয়ার দরকার নেই। কারণ সব সার্টিফিকেটধারীকে চাকরি দেয়ার সুযোগ আমাদের এই দেশে নেই এবং বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হলে বিদেশেও চাকরির সুযোগ নেই বললেই চলে। আর অধিকাংশ চাকরি উৎপাদনশীল খাত হিসেবে বিবেচিত নয়। আমাদের প্রয়োজন সবার আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ। সেটা করতে হলে কারিগরি প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। দেশে যারা মোবাইল সার্ভিসিং করে, তাদের প্রায় শতভাগ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। ওস্তাদের কাজ দেখে দেখে তারা কাজ করা শুরু করে। অথচ তারা যদি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতো, তবে দু-একবার নষ্ট হয়ে যাওয়া আমাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনগুলো ফেলে না দিয়ে সেগুলো মেরামত করতে পারলে ফলপ্রসূ হতো। আমাদের দেশে আধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন কৃষক নেই। এখনো তাদের জমিতে বলদের ব্যবহার অপরিহার্য। জমিতে কখন, কতটুকু সার দিতে হবে, সেই জ্ঞান তাদের নেই। যারা চুল কাটে, তাদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। গ্যারেজের কাজে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই। কারিগরি প্রতিটি কাজেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

আমাদের দেশে এসএসসি পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীদের একাংশ ডিপ্লোমার দিকে যাচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী ডিপ্লোমায় পড়বে কি না, সেই বিবেচনা তাকে করতে হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষার পর। যারা ডিপ্লোমা পাস করে তারা নিজেদের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তৈরি করে এবং তাদের পড়ার বিষয় অত্যন্ত সীমিত। তাদের দিয়ে তো আর রং মিস্ত্রির কাজ করানো যাবে না, ড্রাইভিং করানো যাবে না। ডিপ্লোমায় সেলুনের কাজ, বুটিক শিল্প কিংবা পশুপালনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। তাই একজন শিক্ষার্থী কোন দিকে যাবে, এই সিদ্ধান্ত অষ্টম শ্রেণির পর হলে সবচেয়ে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। কারণ অষ্টম শ্রেণির পর জিপিএ’র ওপর ভিত্তি করে একদল শিক্ষার্থী যাবে কারিগরি প্রশিক্ষণে, অন্য দল যাবে সাধারণ শিক্ষায়। এরপর সেই সাধারণ শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে এসএসসি পাস করার পর একদল ডিপ্লোমায় ভর্তি হবে এবং অন্য দল উচ্চ মাধ্যমিকে। আমাদের প্রয়োজন প্রতিটি প্রয়োজনীয় কাজের উপর প্রশিক্ষিত কর্মী।  আমাদের কর্মীরা বিদেশে যাবার পর অধিকাংশই নিম্নমানের কাজ করে। এতে পরিশ্রম যেমন বেশি, আয়ের পরিমাণ কম। দেশে রেমিট্যান্সও কম আসে। অথচ কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত একজন যদি প্রবাসে গিয়ে কাজ করত, তবে ভালো মানের কাজ করতে পারত। একইসঙ্গে আয়ও বেশি হতো। অদক্ষ কোনো ব্যক্তির প্রবাসে যাওয়ার দরকার নেই। কারিগরি প্রশিক্ষণ নেয়ার পর বিদেশে যেতে হবে। এজন্য কর্মমুখী শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। বিদেশে যে বিষয়ের উপর দক্ষ কর্মী চাওয়া হয়, আমাদের তা থাকে না। অথচ আমরা যদি সঠিকভাবে দক্ষ কর্মী তৈরী করতে পারতাম, তবে আমরা দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করতে পারতাম। রেমিট্যান্সের পরিমাণও অনেক বৃদ্ধি পেত।

আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে যে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকি, ব্যবহারিক জীবনে শুধুমাত্র ১০ ভাগ শুধু কাজে লাগে, বাকি ৯০ ভাগ কোনো কাজে আসে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেন ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগতে পারে, সেজন্য কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে। কারণ এর মাধ্যমে অর্জিত সকল জ্ঞানই ব্যবহারিকভাবে কাজে লাগবে। শুধুমাত্র প্রশিক্ষিত জনশক্তি রপ্তানির মধ্যমেই বেকারত্বের হার শূন্যের কোঠায় নামানো সম্ভব। বেকার বিহীন হবে আমাদের এই দেশ, এটাই সকলের প্রত্যাশা।

লেখক: উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়