ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গাড়িবানের শতেক গঞ্জনা || অরুণ কুমার বিশ্বাস

অরুণ কুমার বিশ্বাস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১০, ১০ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গাড়িবানের শতেক গঞ্জনা || অরুণ কুমার বিশ্বাস

অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করেন যে, গাড়ি হলো তো জীবনে গতি এলো। আদতে মোটেও তা নয়, বরং গাড়ি হবার সঙ্গে সঙ্গে যা ঘটে তা হলো, মানুষ হাঁটতে বা ছুটতে ভুলে যায়; স্পিন বোলারের বলের মতো শুধু গড়াতেই জানে। সেই বলে গতি নেই, জোরসে মারলেও চার বা ছক্কার সম্ভাবনা প্রায় থাকে না বললেই চলে।

উপরি হিসেবে গাড়িবান মানুষের মধ্যে আরেকটি বিষয় বেশ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তা হলো অহঙ্কার বা ‘আমি কী হনু রে’ ভাব! এদেশে গাড়ির অভাব নেই, ভাবেরও নয়। গাড়ি থাকলেই ভাব হবে। যার গাড়ি যত বড় বা দামি, তার ভাবের কিনারা করা তত বেশি দুষ্কর। এই ভাব কিন্তু সেই ভাব নয়। এখানে ভাব-ভালোবাসা বা মহব্বতের বালাই থাকে না, যা থাকে তা হলো আমি হলুম গিয়ে রাজাগজা কেষ্টবিষ্টু, আর তোমরা সব ধুতুরা ফুল। গাড়ি না থাকলে সে কীসের জীবন! যত্তোসব নিম্নবিত্ত বা মিডিওকারের উঞ্ছবৃত্তিময় ফালতু জীবন!

একটু ভেবে দেখুন, গাড়িবান হওয়াটা কিন্তু মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। বেশির ভাগেরই গাড়ি ক্রয়ের পেছনে থাকে দুরন্ত দুর্নীতির ইতিহাস। টুকটাক সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি হলে সে ভিন্ন কথা, হয়তো একটু কষ্ট-কসরত করে মিতব্যয়িতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আট-দশ লাখের মধ্যে কিছু একটা গাড়ি কেনা সম্ভব। কিন্তু আমি বলছি বছর বছর গাড়ির মডেল বদলের মতো বিলাসী যারা তাদের কথা। পোরশে, হ্যামার কিংবা কেডিল্যাক ডেভিল চড়ে যারা শয়তানের হাসি হাসে, তাদের দিকে তাকালেই বুঝবেন তিনি কত বড় মাপের গাড়িবান মানুষ। এদের বিশাল বপু, চলাফেরায় হাঁসফাঁস, গলায় গম্ভীর স্বর যেন কণ্ঠনালীতে সদ্য শল্যচিকিৎসা হয়েছে। এরা আম জনতাকে খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। এরা অতিশয় ‘সদাশয়’ জীব। এদের থেকে আমি কুড়ি হস্ত দূরে অবস্থান করি। পারতপক্ষে খুব একটা ধারেকাছে যাই না।

এসকল গাড়িবান লোক কিন্তু মোটেও সুস্থ নন। বেশির ভাগের হার্টের ব্যামো নয় তো চিনিরোগ আছে। কারণ তারা হাঁটতে জানেন না, ছোটাছুটি দূরে থাক। গাড়ি মানেই গড়িয়ে চলা। এরা দেখতে ঘাড়ে-গর্দানে একসমান। গাণ্ডেপিণ্ডে গেলেন আর গাড়ি করে গড়িয়ে চলেন। অথচ শরীর এমন এক ইঞ্জিন, যা কিনা বসিয়ে রাখার উপায় নেই, তাহলেই বিগড়োবে। উঁচুমাপের পাত্তিঅলা গাড়িমানবের অর্থকড়ির অন্ত নেই, তাই গাড়ি মেনটেন করতে তাদের তেমন সমস্যা হয় না। তবে এরা যেহেতু খুব রাশভারী মানুষ, তাই স্বভাবতই এরা আইন-কানুন মানতে চান না। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ আটকালে জামার কলার নেড়ে বলেন- জানো, আমি কে! তার মানে উহারা নিজের পরিচয়ের ব্যাপারেই সন্দিহান। বেকুব আর কাকে বলে! বেচারা ট্রাফিক পুলিশ তখন ধন্ধে পড়েন। বুঝতে পারেন না, ন্যাদাপেট গাড়িবান বড়, নাকি আইন!

সাধারণ মানুষ বা একটু নিচুস্তরের (অবশ্যই আর্থিক বিবেচনায়) আত্মীয় যারা, তারা এদের এড়িয়ে চলেন। কারণ তেলেজলে কখনও মিশ খায় না। ফলে এই জাতীয় গাড়িবানরা বরাবরই নিঃসঙ্গ। অন্যকে কাছে টানতে গেলেও তাদের পক্ষে মোটেও তা সম্ভব নয়। কারণ গাড়ির বডির মতোই এদের নিজেদের বডিও বড্ড বিশাল। কাছে টানতে গেলেই পেটে ঢুঁস দেয়, ফলে আলিঙ্গন জাতীয় ব্যাপারটি মোটেই আর অর্থবহ হয় না। এরা কোথাও বেড়াতে গেলে বা মার্কেট প্লেসে গাড়ি পার্ক করা নিয়ে কিছু না কিছু গ্যাঞ্জাম করবেই। এক্ষেত্রে তাদের লাজলজ্জা বলে কিছু থাকে না। দামি গাড়ি তো আর যেখানে সেখানে ফেলে রাখা যায় না! কেউ কিছু বললে তাদের গলার টোন পাল্টে যায়, যেন দেশ তো ভালো, তামাম দুনিয়াটাই তার! এমন হামবড়া গাড়িবানদের কারণে আমাদের অনেকের জীবনটাই কখনও সখনও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

এবার আসুন সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়িবানদের প্রসঙ্গে। বস্তুত এরা মহা মুসিবতের মধ্য দিয়ে যায়। ‘সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নাই’ টাইপ মানুষগুলো প্রতি মুহূর্তে নিজের সঙ্গে আঁতাত করে চলে। কষ্টেসৃষ্টে কিছু টাকা জমিয়ে গাড়ি তো কিনলেন, কিন্তু তারপর! গাড়ি শুধু কিনলেই হবে! তা মেনটেন করতে হবে না! আপনার তো জমানো কাড়িকাড়ি টাকাকড়ি নেই যে গ্যারেজঅলাকে মাসমাইনে দিয়ে রাখবেন! যেহেতু পুরনো গাড়ি, এর কল-কব্জা, নাড়িভুঁড়ি সবখানেই সমস্যা। পুরনো ইঞ্জিন তাই ভয়ানক তেল খায়, গ্যাসে চালাবেন! ইঞ্জিন শুকিয়ে যাবে, নতুন ইঞ্জিন লাগাতে হবে। সবচেয়ে বড় গঞ্জনা হয় যখন চলতিপথে হঠাৎ দুখানা কাশি দিয়ে আচমকা গাড়ি থেমে যায়।    লাজুক হেসে চালক বলবে, স্যার, ইঞ্জিনে বড় গড়বড় আছে। গ্যারেজে নিতে অইবো। এ-কাজে চালকের কখনও কোনো আপত্তি নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ গাড়ি গ্যারেজ হওয়া মানেই তার কিঞ্চিত কামাইয়ের সুযোগ লাভ। উপরি কামাই। উপরি কে না চায়, বলুন। যারা সুন্দরী শালী দেখে বিয়ে করেন তারা এ বিষয়খানা বিলক্ষণ বোঝেন বলেই আমরা বিশ্বাস।

কোনো কোনো গাড়িবান আবার গাড়ির চালক নিয়ে মুসিবতে পড়ে যান। বড্ড অস্থিরতায় ভোগেন। সুন্দরী বউ বা অল্পবয়সী মেয়ে থাকলে এই মুসিবত বহুগুণে বাড়ে। গাড়ির মালিক মন দিয়ে অফিস করতে পারেন না। এই বুঝি চালিয়াত চালক তার মেয়ের সঙ্গে ফুসুরফাসুর প্রেম শুরু করে দিল! আবার এমন দুশ্চিন্তাও পেয়ে বসে যে, চালক হয়তো গাড়ি নিয়ে উবার কিংবা ও-ভাইয়ে গিয়ে যোগ দিল। একটু বাড়তি কামাই। উপরির মতো। তিনি নিজে নেন, তাই অন্যকে খুব সহজেই সন্দেহ করতে পারেন। যার যেমন খাদ্যখানা, তার তেমন তানা-না-না, মানে ঢেঁকুর। এবার আসুন আমাদের গঞ্জনার কথা কিছু বলি। এরা অকারণ হর্ন বাজায়। চালককে চাপে রাখে, যা যা, পারলে উড়াল দিয়া যা! গাড়ি থামে ক্যাঁ! বৃষ্টিতে রাস্তা তলিয়ে গেছে, তাতে কি! এরা এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো দুরন্ত গতিতে গাড়ি হাঁকায়। ফলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবোধ মানুষগুলো ছিটকে আসা কাদাপানিতে অসময়ে গোসল করে। স্কুলড্রেস নষ্ট হয়, কারো বা বাতিল হয় জরুরি অফিসগমন।

গাড়ি চড়ে তাই বেগ বাড়ে, ফলে ক্রমশ হারিয়ে যায় তাদের আবেগ। মনুষ্যত্ব লোপ পায়। আমার নয়, যাযাবরের কথা এটা। পথচারীদেরও দোষ আছে। গাড়ি আসছে দেখলেই তাদের হঠাৎ রাস্তা পেরোতে মন চায়, কেউ কেউ মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হয়, আবার কেউ কানে পুঁটলি মানে হেডফোনের গুলটি গুঁজে হেলেদুলে রাস্তা পার হয়। সত্যি বলতে, আমাদের সিভিক সেন্স যেন দিন দিন লোপ পাচ্ছে, আমরা ক্রমশ অ্যামাজন জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারে পরিণত হচ্ছি। ব্যক্তিগত গাড়ি না থাকলে কিছু কিছু সুবিধা কিন্তু আপসে পাওয়া যায়। এই যেমন কষে জ্যাম লেগেছে, আপনি পাবলিক বাস থেকে নেমে যান, রিকশা ধরুন বা হেঁটেই বাকি পথটুকু কাভার করুন। ন্যাদাপেট গাড়িবান কিন্তু কক্ষণো তা পারবে বা করবে না। তাতে তার ইয়ে মানে ইজ্জতে লাগে, বা অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস হয়েছে। ফলে গাড়িতে আগুন লাগলেও আর সে ছুটতে পারবে না। পুড়ে চিকেনফ্রাই হবে তাও সই, বাট নো নড়নচড়ন।

গাড়িতে এসি আছে বটে, কিন্তু প্রাণভরে নিশ্বাস নেবার জো নেই। আপনি রিকশা চেপে আকাশ দেখতে দেখতে বাসায় যান, তার তিনি! ছ’ফুট বা দু’ফুট ছোট্ট মুড়ির টিনে বসে আকাশ পাতাল ভাবেন আর দুশ্চিন্তায় ফুরিয়ে ফেলেন সাধের জীবন! ফিবছর গাড়ি কিনবো, উপরি জুটবে তো!   

লেখক: কথাসাহিত্যিক, অতিরিক্ত কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টমস


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়