ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

জাতিসংঘের অধিবেশন সামনে রেখে মিয়ানমারের কূটচাল

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৫, ২৬ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাতিসংঘের অধিবেশন সামনে রেখে মিয়ানমারের কূটচাল

মাছুম বিল্লাহ : বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের কল্যাণকামী সকল রাষ্ট্র, সংস্থা এবং ব্যক্তিবর্গ  সবাই গত ২২ আগস্ট কক্সবাজারের দিকে তাকিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট সবাই আশা করেছিলেন, বহুল প্রতীক্ষিত ও আলোচিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। কিন্তু হলো না! বাংলাদেশ সরকারের সব প্রস্তুতি ও আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকার পরও বিষয়টি থেমে গেছে। চীনের সরাসরি মধ্যস্থতায় এবার অনেকটা তড়িঘড়ি করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করেছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। তার প্রধান কারণ হচ্ছে নেতৃবৃন্দ রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য যে পাঁচটি শর্ত জুড়ে দিয়েছিল এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সেগুলো নিয়ে কোনো কাজ বা সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা ছিল না। তারা যে অগ্নিকুণ্ড থেকে মরতে মরতে আমাদের দেশে এসেছে, আশ্রয় নিয়েছে, তারা তাদের দেয়া শর্তগুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে ফিরে গিয়ে পুনরায় বাঘের মুখে পড়তে চাচ্ছে না। এটি সাধারণ হিসেব। তাদের পাঁচটি শর্ত হচ্ছে (ক) তাদেরকে বৈধ নাগরিকত্ব প্রদান, (খ) তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, (গ) জোরপূর্বক অধিকার করে নেয়া জমি ফেরত দেয়া, (ঘ) নিজেদের গ্রামে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং (ঙ) অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা- যেটি তাদের ছিল না। তারা সেখানে বাস করতো বন্দী জীবনের মতো। নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া তারা চলাফেরা করতে পারত না। পূর্বের সেই পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে তারা যে ফেরত যাবে না, এটি তো বোঝাই যায়।

তাহলে এত দ্রুত এই পদক্ষেপ নেয়ার কারণ কী? মিয়ানমার সরকারের এই পদক্ষেপের কারণ হলো বিশ্বকে, বিশ্বমতামতকে, বিশ্ববিবেককে ধোকা দেয়া। সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে অধিবেশন বসছে। সেই অধিবেশনে রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে মিয়ানমারের ওপর বড় ধরনের চাপ আসবে। ইতিমধ্যে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে আছে। আমেরিকা ও কানাডায় মিয়ানমারের সেনা প্রধানের সফর প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। সেজন্য মিয়ানমার এই কূটনৈতিক চাল চেলেছে। বাংলাদেশ যেহেতু উভয় সংকটের মধ্যে আছে তাই তারা এই খেলা খেলছে। বাংলাদেশ মানবাধিকারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু এটিও তো সত্য- বাংলাদেশের মতো এত বড় জনবহুল দেশে অতিরিক্ত সাড়ে এগারো লাখ মানুষের সার্বিক দায়িত্ব পালন করাটা কতবড় কঠিন! এই বিষয়গুলো মিয়ানমার সরকারও ভালোভাবে জানে। ফলে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে এই খেলাটা খেলছে। তারা জানে বাংলাদেশ তাদের জোর করে তাড়াতে পারবে না, আবার দীর্ঘ সময়ের জন্য আশ্রয়ও দিতে পারবে না। অযথা সংকটের মধ্যে বাংলাদেশকে নিক্ষেপ করাই যেন মিয়ানমার সরকারের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকা রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় করেছে। পরিবেশের অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তায় পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। তারপরও মিয়ানমার বিশ্বাবাসীকে ধোকা দেয়ার জন্য এইসব উদাহরণ সৃষ্টি করছে যাতে বলতে পারে- তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করেছে, চেষ্টা করছে। কিন্তু সেখানে বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা যে নেই, তা যে কোনো মানুষ বুঝতে পারে এবং পারবে।

২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথমবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, এই প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। দ্বিতীয় প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হলো। প্রত্যাবাসন  শুরু না হওয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটিকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, ‘আমরা জোর করে কিছু করতে চাই না। তবে প্রত্যাবাসনে যারা বিরোধিতা করছে তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা রোহিঙ্গাদের দাবির কাছে জিম্মি হতে পারি না। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে ২৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। তারা তাদের নিজের দেশে গিয়ে দাবি আদায় করবে।’ কিছু এনজিও বা অচেনা ব্যক্তিবর্গ পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি রোহিঙ্গাদের ইংরেজিতে ফিরে না যাওয়ার প্ল্যাকার্ড তৈরি করে দিয়েছে। এ ছাড়াও নানাভাবে তাদের প্ররোচিত করছে। তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে। কোনো কোনো মহল নাকি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বন্ধ হওয়ায় উল্লাস প্রকাশ করেছে। এটি কোনো পক্ষেরই করা উচিত নয়। কারণ বাংলাদেশ তার নিজের হাজারো সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারপরও এত বড় সংকট মোকাবিলা করা দেশের পক্ষে আর সম্ভব নয়। একদিকে তো রোহিঙ্গাদের দেয়া শর্ত অনুযায়ী প্রক্রিয়াটি শুরু হয়নি, দ্বিতীয়ত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে মোটামুটি নিরাপত্তার মধ্যেই আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে তাদের জন্য আন্তর্জাতিক দাতাদের কতটা কী করার থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। তখন তাদের কী হবে? তাই রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দসহ দেশি বিদেশি সবাইকে প্রক্রিয়াটি তরান্বিত করতে হবে।

আন্তর্জাতকি মহল যখন কক্সবাজারের দিকে চোখ রাখছিল তখন মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিডোতে দেশটির সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং লায়েংয়ের সঙ্গে দেখা করেন চীনের রাষ্ট্রদূত শেন হেই। রাখাইনের রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল চাপ দিলে চীন যে মিয়ানমারের পাশে থাকবে তা তিনি ঐ বৈঠকে উল্লেখ করেন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৫০ হাজার। মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার থেকে বাংলাদেশ আগেই কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে ফেরত পাঠাবে না। তবে কেউ স্বেচ্ছায় ফিরতে চাইলে তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আসলে আস্থার ঘাটতির কারণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যেতে পারছে না। এই আস্থার ঘাটতি পূরণের জন্য আমরা চীনকে অনুরোধ করব মিয়ানমারকে সত্যিকার অর্থে রাজী করাতে। আমরা মনে করি, চীন বাংলাদেশের বন্ধু। বন্ধুর মতোই আমরা তাদের কাছ থেকে আচরণ আশা করছি।

রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনুকূল পরিবশে সৃষ্টিতে ইউএনএইচসিআর ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে মিলে রাখাইন রাজ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। তবে এজন্য রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বসতভূমি ও ফেরার সম্ভাব্য স্থানগুলোতে প্রবেশাধিকার চায় ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপি। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকে এ যাবত আসা রোহিঙ্গাদেরই প্রথমে প্রত্যাবাসন এবং সেটি সম্পন্ন হওয়ার পর তার আগে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বিবেচনা করা হবে। ২২ আগস্ট থেকে তিন হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করার কথা বলেছে মিয়ানমার। মিয়ানমার দুটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ১৫০ জন করে সর্বোচ্চ ৩০০ জন রোহিঙ্গা গ্রহণ করবে। অর্থাৎ ওই তালিকার সবাই ফিরতে রজি হলেও এগারো দিনের বেশি সময় লাগার কথা। তারপরও আমরা আশা করেছিলাম বিষয়টি শুরু হোক, কিন্তু হলো না। চীনের সম্পৃক্ততা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি না হওয়া এই সংকটের জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা আরো বাড়ার ইঙ্গিত বহন করছে। প্রথমত মিয়ানমার গত দুই বছরে রোহিঙ্গাদের ফেরার মতো অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। নাগরিকত্বের বিষয় তোলায় মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হবে না– চীনের এ কথার পর বাংলাদেশ মিয়ানমারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড নিতে উৎসাহিত করছে। চীনের সহযোগিতা এখানে একান্তভাবে কাম্য।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হওয়ার কথা আছে। জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক সমন্বয়ক ষ্টিফেন হিকি বলেন, ‘মিয়ানমারে জটিল সময় চলছে। আগামী দিনগুলাতে আমরা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়ন দেখার আশায় আছি। আমরা মনে করি, প্রত্যাবাসন স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সন্তষ্ট যে, ইউএনএইচসিআর মাঠে আছে। তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই দেশের সঙ্গেই কথা বলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে ওই তিনটি নীতি অুনসরণ করা নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা পরিষদের কাজ করা উচিত।’ আমরাও তাই মনে করি। জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে সত্যিকার অর্থে এগিয়ে আসতে হবে আর রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় চাপ প্রয়োগ করতে হবে মিয়ানমারের ওপর। কারণ রেহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তন করা কিংবা সংশোধন করা। ঐ আইনের ফলেই রোহিঙ্গারা দেশবিহীন হয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করলেই রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে চাইবে।

লেখক: শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়