ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

লক্ষ্য ছাত্র রাজনীতি, উদ্দেশ্য দেশ নেতৃত্ব শূন্য করা

মোতাহার হোসেন প্রিন্স || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৬, ১৩ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লক্ষ্য ছাত্র রাজনীতি, উদ্দেশ্য দেশ নেতৃত্ব শূন্য করা

পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল স্টাফ প্রধান রাও ফরমান আলী ‘How Pakistan Got Divided’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘একজন পশ্চিমা জেনারেল ভারতের জেনারেলের চেয়ে বেশী ভয় পেত পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি সচেতন একজন শিক্ষার্থীকে। কারণ তারা বিনা নোটিশে মুহূর্তের ভিতর হাজারো ছাত্রের সমাবেশ ঘটাতে পারত।’

শুধু তাই নয়, ১৯৭২ সালে ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিক আন্দ্রে মাঁরলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এসে বলেছিলেন, ‘আমি এমনই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত ছাত্রের সংখ্যা বর্তমান জীবিত ছাত্রের চেয়ে দ্বিগুণ।’ আর সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ সতের হাজার নেতা কর্মী নিহত হয়েছিলেন। এই হলো বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির গৌরব-উজ্জ্বল ইতিহাস। এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্মায়, যারা অন্যের মুখে হাসি ফুটিয়ে, অন্যের দুঃখ-কষ্ট জয় করে নিজে শান্তি পায়। তাদের জীবন কেটে যায় অন্যের উপকার করতে করতে। দেশ মাটি আর মানুষের প্রয়োজনেই তারা তাদের জীবনে চলার পথ নির্ধারণ করে। মানব কল্যাণে নিবেদিত সেই রাজনীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ মা মাটি আর এদেশের মানুষের প্রয়োজনে তিনি জীবনের এক চতুর্থাংশ সময় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। কারাজীবন যাপন কালে তিনি জেলের ভিতর থেকেই তৎকালীন ছাত্র নেতাদের শ্লোগান আর দেশের মুক্তি আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারণ করে দিতেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের মাধ্যমে। ছাত্রজীবন থেকেই জাতির পিতার দেশের প্রতি আপোষহীন মানসিকতা থেকে যে আদর্শের সৃষ্টি হয়েছে সেই আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে আজকের বাংলাদেশ। দেশের প্রয়োজনে মানুষের প্রয়োজনে সেই আদর্শ কখনো কারো সঙ্গে আপোষ করেনি।

বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির গৌরব-উজ্জ্বল অতীতের সাথে বর্তমানেও রয়েছে অসংখ্য ইতিবাচক ও ভালো কাজের দৃষ্টান্ত।  বর্তমান ছাত্র রাজনীতিতে ইতিবাচক কাজ এই কথাটির সাথে আমরা অনেকেই অপরিচিত বা এই কথাটিকে অনেকেই অবিশ্বাস করি। আর আমরা যারা ছাত্র সংগঠনের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সহযোগিতা পেয়েছি, যার কাছ থেকে পেয়েছি সেই ব্যক্তিকে আমরা ধন্যবাদ দেই, অথচ ব্যক্তিটি যে ছাত্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত সেই সংগঠনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে আমরা একেবারেই ভুলে যাই। আপনারা হয়ত ‘ছাত্র বিরাজনীতিকরণ’ শব্দটার সাথে পরিচিত থাকবেন। এই ছাত্র বিরাজনীতিকরণ শব্দটার অর্থ ছাত্রদের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, নিরুৎসাহিতকরণ, ছাত্র রাজনীতি বন্ধের জন্য নানা প্রচষ্টা চালিয়ে যাওয়া। আর এই দেশে ছাত্র বিরাজনীতি করণের চেষ্টা চালিয়েছেন, ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে দেশের মানুষের কাছে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করেছেন, এদেশের কিছু সামরিক স্বৈরশাসক ও তাদের বিদেশী প্রভুরা। কারণ একদিকে সামরিক স্বৈরশাসকেরা ভয় পেত ছাত্রদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আর বাংলাদেশের মানুষের কাছে ছাত্র নেতাদের জনপ্রিয়তাকে। আর তাদের বিদেশী প্রভু যারা বাংলাদেশের দুর্বল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, যারা এদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভূলুণ্ঠিত করে বাংলাদেশে বরাবরের মত তাদের কায়েমী স্বার্থ হাসিল করতে চায়। এই বাংলাদেশকে তাদের বশ্যতা স্বীকার করাতে চায়। তারা চায় এই বাংলাদেশ বারবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হোক। তারা চায় বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা প্রগতিশীলতার পতাকা না উড়িয়ে যেন জঙ্গিবাদ আর মৌলবাদের আস্তানা তৈরি করে। তারা চায় এদেশে হেফাজতে ইসলামের মত গোষ্ঠী যেন মিথ্যা কথায় জনগণকে প্রতারিত করে ঢাকার রাজপথ দখল নিয়ে সরকারের পতন ঘটায়। তারা চায় গুলশানে সংগঠিত হলি আর্টিজান বেকারীর মত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে এদেশের তরুণেরা মেতে উঠুক। যাতে তারা সন্ত্রাস আর জঙ্গীবাদের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে তাদের সামরিক সহযোগিতার নামে তাদের রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ বৈধ ও প্রশস্ত করতে পারে। আপনারা অবশ্যই জানেন গুলশানে হলি আর্টিজান হামলার পর পৃথিবীর পরাক্রমশালী রাষ্ট্রটি বাংলাদেশে সামরিক সহযোগিতার নামে সেনা পাঠাতে চেয়েছিল।

বর্তমান সমায়ে ছাত্র রাজনীতির ইতিবাচক দিকগুলো মিডিয়া ও পত্র-পত্রিকায় তুলে ধরা হয় না। তারুণ্যনির্ভর বাংলাদেশে আজ ৪.৫ থেকে ৫ কোটি তরুণ। এই তরুণদের একটি বৃহৎ অংশ ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। দেশের প্রয়োজনে, এদেশের মানুষের প্রয়োজনে, তরুণদের ইতিবাচক আর মানবসেবায় নিবেদিত কাজগুলোকে অবশ্যই মিডিয়া আর পত্রিকাগুলোতে তুলে ধরা উচিত। কারণ দেশ গঠনে বাংলাদেশের তরুণরাই এখন মোক্ষম হাতিয়ার। তাই ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত তরুণদের ইতিবাচক কাজকে যথাযথভাবে সমাজের মানুষের কাছে তুলে ধরলে তারা অনুপ্রাণীত হবে, উৎসাহিত হবে। আজ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে, উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর দেশের এই অগ্রযাত্রায় এদেশের তরুণ সমাজ তথা ছাত্র সমাজেরও ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। অনেকে হয়ত বলবেন, দেশের অগ্রযাত্রায় ছাত্র সমাজের ভূমিকা কী? তখন আপনাদের বলব, ২০০১ থেকে ২০০৫ সালে বিএনপি সরকার টানা পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। বিএনপি’র এই অর্জনে তাদের ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা কম ছিল না।

যাই হোক, দেশের তরুণদের ইতিবাচক কাজকে উৎসাহিত না করে, তাদের দ্বারা সংগঠিত নেতিবাচক কাজকে ফলাও করে প্রচার করলে, সমাজের মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। ভালো ও মানব কল্যাণমূলক কাজে তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। ছাত্রদের নেতিবাচক কাজে অবশ্যই গঠনমূলক সমালোচনা থাকবে, যাতে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। আর কখনো যদি কিছু ছাত্র আইনশৃঙ্খলার তোয়াক্কা না করে, সীমা লঙ্ঘন করে তখন অবশ্যই রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। 

তাই বর্তমান সমায়ের ছাত্র সংগঠনের ভিতর লুকিয়ে থাকা কিছু আদর্শচ্যুত কর্মীর দুষ্কৃতির জন্য, এই সকল তরুণ ছাত্রদের দিয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগঠনকে দোষারোপ করা যায় না। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আদর্শে গড়া ছাত্র সংগঠন। জাতির পিতার মানব কল্যাণে নিবেদিত অসম্ভব ত্যাগ আর তিতিক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে এই সংগঠনের নেতা কর্মীরা দেশ মা মাটি আর মানুষের সেবায় নিজেকে ছাত্রজীবন হতে নিয়োজিত করতে শেখে, দেশের কল্যাণে কাজ করে যায়। আর ছাত্রজীবন থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জাতির পিতা আমাদের জন্য দেশের কল্যাণে আপোষহীন যে জীবন দর্শন রেখে গেছেন, সেই আপোষহীন দর্শন নিয়েই দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই দেশের প্রয়োজনে নিজ দলের পথভ্রষ্ট কর্মীদের এক চুল পরিমাণ শাস্তি দিতে কার্পণ্য করেন না। আর এই আদর্শের চর্চা তিনি ছাত্র রাজনীতি থেকে করে আসছেন, আজ সেই আদর্শের বলে বলীয়ান হয়ে বিশ্বসভায় তিনি সমাদৃত। তাই এদেশে ছাত্র রাজনীতিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি ভাষা, একটি মানচিত্র দিয়েছে। স্বাধীকার আদায়ের প্রতিটি সফল সংগ্রামে পেয়েছে হাজারো তরুণের রক্তস্নাত লাশ ও তাদের পরিবারের স্বজন হারানো কান্না। এদেশের ছাত্র রাজনীতি একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা দিয়েছে, দিয়েছে ছাত্রনেতা থেকে উঠে আসা অসংখ্য মানবদরদী নেতা। তেমনি করে ছাত্র রাজনীতি না করে আসা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বের  দায়ভার বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকেও বহন করতে হয়েছে।

লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়