ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নীরব, নিস্তব্ধ এফডিসি রাতের আঁধারে গর্জে ওঠে!

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৪, ১৬ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নীরব, নিস্তব্ধ এফডিসি রাতের আঁধারে গর্জে ওঠে!

চলচ্চিত্রের আঁতুর ঘর হিসেবে খ্যাত বিএফডিসি। লাইট, ক্যামেরার ঝলকানি আর পরিচালকের কণ্ঠে ‘অ্যাকশন-কাট’ আর তারায় তারায় মুখরিত ছিল এফডিসি চত্বর। শুটিংয়ের ফাঁকে আড্ডা জমত শিল্পীদের। কোলাহলপূর্ণ সেই এফডিসি এখন অনেকটাই নীরব, নিস্তব্ধ। কাজহীন অভাব-অনটনে দিনযাপন করছেন রুপালি জগতের এক্সট্রা শিল্পী, মেকআপম্যান, স্টান্টম্যানরা। অন্যদিকে ক্ষমতা আর আমিত্ব প্রকাশে ব্যস্ত চলচ্চিত্রের কিছু মানুষ। এদের সংখ্যা কম হলেও এরা একে অন্যের সঙ্গে রেষারেষি, ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যস্ত।

এফডিসিতে শিল্পীদের দেখা মিলে কালেভদ্রে। তারপরও এফডিসি লোকে লোকারণ্য থাকে অধিকাংশ সময়। এদের বেশিরভাগ বহিরাগত। কখনো পরিচিতজনের সঙ্গে, কখনো নিরাপত্তাকর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে, আবার কখনো ৫০-১০০ টাকার বিনিময়ে এফডিসিতে ঢুকে পড়ে উৎসুক দর্শক। তবে আগত দর্শক শুধু প্রিয় তারকাদের সঙ্গে সেলফি আর দেখা করতেই ব্যাকুল থাকেন। মাঝেমধ্যে নীরব, নিস্তব্ধ এফডিসি রাতের আধারে গর্জে উঠে! প্রায়ই শোনা যায় অপ্রীতিকর ঘটনার কথা। এর আগে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে শাকিব খানকে।

গত বছর এফডিসির কড়ইতলায় এক রাতে সহকারি পরিচালক সমিতির আনুমানিক ১০জন সদস্য সহকারি পরিচালক মনিরের উপর হামলা করে। ঘটনার এক পর্যায়ে উৎপাদন ও ব্যবস্থাপক সমিতির সদস্যরা সংগঠিত হয়ে সহকারি পরিচালক সমিতির সদস্যদের উপর হামলা চালায়। মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এছাড়া একই বছর চলচ্চিত্র সহকারি পরিচালকদের সঙ্গে চিত্রনায়ক শাকিব খানের বাকবিতণ্ডা হয়। পাশাপাশি দুই বিনোদন সাংবাদিক জিয়াউদ্দিন আলম ও সুদীপ্ত সাঈদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। এসব ঘটনার সময় বহিরাগত অনেকে জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়।

সর্বশেষ গত সোমবার চিত্রনায়িকা মৌসুমীর সঙ্গেও এমন ঘটনা ঘটেছে। এসব অপ্রীতিকর ঘটনার পেছনে জড়িয়ে আছে বহিরাগতরা। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সমিতিগুলোর নির্বাচনের সময় গর্জে ওঠে এফডিসি। নিজেদের শক্তি আর ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য বহিরাগতদের নিয়ে শোডাউন করা হয়। আর এসব বেশিরভাগ হয় রাতে। 

আগামী ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির দ্বি-বার্ষিক নির্বাচন। এ নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আর কাদা ছোড়াছুড়ি। এবার সভাপতি পদে মিশা সওদাগরের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মৌসুমী। গত সোমবার সন্ধ্যায় বিএফডিসিতে মৌসুমীকে শুভেচ্ছা জানাতে শিল্পী সমিতিতে যান মহিলা লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী। দাবি করা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে ছিলেন ছাত্রলীগের কর্মীরাও। শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে বহিরাগতদের সঙ্গে হট্টগোল বাঁধে অভিনেতা ড্যানিরাজের। এই হট্টগোল গড়ায় মৌসুমী-ড্যানিরাজ-ওমর সানি পর্যন্ত। বিষয়টি নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বহিরাগত ছেলেরা নিজেদের ছাত্রলীগ দাবি করে, গুলি করারও হুমকি দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। বহিরাগতদের এমন আচরণে সাধারণ মানুষের চোখ কপালে উঠলেও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি!

কেপিআইভুক্ত একটি এলাকায় কীভাবে বহিরাগতরা প্রবেশ করে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটায়? এসব ঘটনার পেছনে বহিরাগতদেরই দায়ী করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু যতদূর জানা যায় বহিরাগতরা শিল্পীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই বিএফডিসিতে প্রবেশ করে।

চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর নির্বাচনে সবসময় উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। বিশেষ করে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে আরো বেশি উৎসবমুখর হয় এবং এই সমিতি নিয়ে সবার আগ্রহ যেন একটু বেশিই। এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজ্জাক, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, মাহমুদ কলি, রুবেল, মান্নাসহ অনেকে। এক সময় পাঠক খবরের পাতা খুলতেন সপ্তাহে কোন শিল্পীর, কোন সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে তা জানার জন্য। এখন খবরের পাতা খুলেন চলচ্চিত্র পাড়ার নানামুখী ঘটন-অঘটনের খবর জানার আগ্রহ নিয়ে।

আগে সিনেমায় অভিনয় করা নিয়ে রাজনীতি করতেন শিল্পীরা। এখন একে অন্যের সঙ্গে রেষারেষি, ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যস্ত। ‘শিলপাটার ঘষাঘষি মরিচের জীবন শেষ’ বর্তমানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ঢাকাই চলচ্চিত্রে। রাঘব বোয়ালরা তাদের কথার ফুলঝুড়ি আর একে অন্যের প্রতি ক্ষমতা প্রদর্শন করছেন। চলচ্চিত্রের এ অস্থিরতায় ইউটিউবে সিনেমা দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনার  ঝড় তুলে নিজেদের বোদ্ধা ভাবছেন অনেকে। শিল্পীর সঙ্গে শিল্পীর, নির্মাতার সঙ্গে নির্মাতার, প্রযোজকের সঙ্গে প্রযোজকের নেই কোনো আত্মিক সম্পর্ক। দিন দিন বেড়েই চলছে তাদের রেষারেষি। বেড়েই চলছে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, মামলা-পাল্টা মামলা। শুধু মামলায় থেমে থাকেনি, হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ক্ষমতা প্রদর্শন আর নোংরা রাজনীতি বাড়লেও দিনে দিনে কমে যাচ্ছে সিনেমা নির্মাণের সংখ্যা। ফলে হলে সিনেমা মুক্তির সংখ্যাও কমে গিয়েছে। অতীতে তাকালে দেখা যায়— এক সপ্তাহে কয়েকটি সিনেমা মুক্তির জন্য প্রস্তুত থাকত। সেখান থেকে প্রযোজক সমিতি নির্ধারণ করে দিতেন কোন দুটি সিনেমা মুক্তি পাবে। এই কমসংখ্যক সিনেমা নিয়েও চলে নোংরা প্রতিযোগিতা। দেখা গেছে, সারা বছর সিনেমা শূন্য থাকে হলগুলো কিন্তু নির্দিষ্ট কোন তারিখে সিনেমা মুক্তি দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে প্রযোজকরা।

কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, সমিতিগুলো বয়কট আর আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। এছাড়া নতুন করে ‘চলচ্চিত্র পরিবার’ গঠন; এর পাল্টা হিসেবে ‘চলচ্চিত্র ফোরাম’ গঠন করা হয়। দুই ভাগে বিভক্ত ছিল চলচ্চিত্রের মানুষগুলো। নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে অনেককে বেকার থাকতে হচ্ছে। যেহেতু চলচ্চিত্রে কয়েকটা পক্ষ দৃশ্যমান, এ কারণেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য শুটিং বন্ধ করে দেয়া, সিনেমা সেন্সর বোর্ডে জমা পরার আগেই বেনামী চিঠিতে অভিযোগ দায়ের, সিনেমা মুক্তির আগে মামলা ঠুকে দেয়া, নিয়মের মারপ্যাঁচে ফেলে সিনেমা আটকে দেয়া- এগুলো নিয়মিত ঘটছে। মোট কথা প্রতিপক্ষের ক্ষতি করতে যতগুলো পথ খুঁজে পাওয়া যায় ততগুলোই ব্যবহার করা হয়। একটি সিনেমার শুটিং শেষ করে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়া যেন রাজ্য জয় করার মত স্বস্তি। কিন্তু মুক্তির পরে অধিকাংশ সময়ই লোকসানে পরতে হয় প্রযোজকদের। এদিকে বুকিং এজেন্টদের দৌরাত্মে কুপোকাত প্রযোজক।

চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি বেশি করছেন, কাজ কম করছেন। ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় অসহায় হয়ে পরছে চলচ্চিত্রের স্বল্প আয়ের মানুষগুলো। যাদের জীবিকা চলচ্চিত্র থেকে, তারা বড় বড় রাঘব বোয়ালদের রেষারেষির যাতাকলে পিষ্ট হয়ে অর্থাভাবে দিনযাপন করছেন। চলচ্চিত্রের সংগঠনগুলোর নির্বাচন আর কাদা ছোড়াছুড়ি করে নয়, নিয়মের মধ্যে থেকে চলচ্চিত্র প্রযোজনার সুযোগ করে চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। চলচ্চিত্রের স্বার্থে সকল ভেদ ভুলে এখন প্রয়োজন বেশি বেশি মানসম্পন্ন সিনেমা নির্মাণ করা। তাহলেই চলচ্চিত্রে আবারো সুবাতাস বইবে।



ঢাকা/রাহাত সাইফুল/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়