ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

কক্ষ নম্বর ২০৬৯: ইতিহাসের সাক্ষী হলাম যেভাবে

সন্দীপন ধর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কক্ষ নম্বর ২০৬৯: ইতিহাসের সাক্ষী হলাম যেভাবে

সৈয়দ আকরম হোসেন

‘শিক্ষা যিনি দান করেন তিনি আলোকিত মানুষ, কাজটি তাঁর জীবন আলোকিত করে’

১৯৯৯ সাল। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার থিম কান্ট্রি বাংলাদেশ। বইমেলা উদ্বোধন করবেন কবি শামসুর রাহমান এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শামসুর রাহমানের অল্প কয়েকটি কবিতা পাঠের সুযোগ আমার আগেই ঘটেছিল। যাই হোক, ২৭ জানুয়ারি ১৯৯৯, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত, যেদিন কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার মূল মঞ্চ থেকে সুযোগ ঘটল কবির কথা শুনবার। এর দুদিন পর, ২৯ তারিখ কলকাতার ভিক্টোরিয়া গেস্ট হাউসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বর্তমানে শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রফিক উল্লাহ খানের মাধ্যমে পরিচিত হলাম তাঁর শিক্ষক এবং দুই বাংলার বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেনের সঙ্গে। তিনি কলকাতা এসেছিলেন গলার সমস্যার জন্য ডাক্তার দেখাতে। অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠল। হবে না-ই বা কেন, কারণ তিনি যে আমার মায়ের দেশ- যশোরের কৃতি সন্তান।

প্রথম দিনের আড্ডায় স্যারের কাছ থেকে জানতে পারলাম কীভাবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলবার জন্য সেখানে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা ধর্ম, জাতপাত-এর উর্ধ্বে উঠে একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা পয়লা বৈশাখকে জাতীয় উৎসবে রূপান্তরিত করেছেন। তাঁর সেবারের কলকাতা ভ্রমণের সময় আমরা একসঙ্গে একদিন গিয়েছিলাম অধ্যাপক প্রদুন্ম ভট্টাচার্যের বাড়ি। সেদিন অবাক হয়েছিলাম প্রদুন্ম ভট্টাচার্যের মতো নমস্য ব্যক্তি কীভাবে আকরমীয় ঝড়ে আক্রান্ত- একথা জেনে! দীর্ঘ সময় সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার পর স্যারের প্রতি অধ্যাপক প্রদুন্ম ভট্টাচার্যের প্রশ্ন- ‘আচ্ছা, আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সেই আকরম হোসেন?’

স্যার স্মিত হাসি দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার জ্ঞান অনুসারে ১লা জুলাই ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে আজ অবধি এই বিভাগে আমি একমাত্র শিক্ষক যার নাম সৈয়দ আকরম হোসেন।’

উত্তর শুনবার পরে প্রদুন্মদা জোরে হেসে উঠে বলেছিলেন, ‘আপনার নামের সঙ্গে আমি পরিচিত আমার বন্ধু শঙ্খ ঘোষের মাধ্যমে। তাঁর মাধ্যমেই আমি আপনার লেখা পড়ার সুযোগ পাই এবং আমি আপনার লেখার একজন গুণমুগ্ধ পাঠক! তবে এতদিন আমার ধারণা ছিল- আপনি বেশ বয়স্ক কেউ হবেন। মাথা ভর্তি সাদা চুল, এক গাল সাদা দাড়ি।’

সেদিন বুঝেছিলাম কেন তাঁর ছাত্র অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খান আমায় বলেছিলেন, তিনি কেবল আমার শিক্ষক নন, আমাদের বিভাগের একজন ঋষি।

পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্য-গবেষক মহলেও বারবার অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেনের নাম উচ্চারিত হয়। সেবারই দেখেছিলাম স্যারের মাথা উঁচু করে চলার শক্তি এবং বিশ্বাসের কারণ। আমরা তিনজন একদিন গেলাম ডিরোজিও’র সমাধি দেখতে (যদিও এর আগে একদিন আমরা গিয়ে ঘুরে এসেছিলাম, সেদিন স্যার গিয়েছিলেন মূলত কিছু ছবি তুলবেন বলে)। দ্বাররক্ষী ভেতরে প্রবেশের জন্য অনৈতিক প্রস্তাব দিলেন- তাকে কিছু দিতে হবে। প্রতিবাদে স্যারের উত্তর ছিল-  ডিরোজিও থাক আমার মনে এবং মননে তাঁর কর্মের মাধ্যমে। ডিরোজিও'র সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য আমি কোনো অনৈতিক পথ অবলম্বন করব না। কারণ তিনি নিজে এই সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন।

এর কয়েক মাস পরে, স্যারের কথামতো ১৪ এপ্রিল ১৯৯৯ সালে, পাসপোর্ট ভিসা এবং অফিসের ছুটির জটিলতা কাটিয়ে আমার জীবনের প্রথম বাংলাদেশ সফর। সেদিন রাতে রফিকদার সাথে প্রথম গেলাম ফুলার রোডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবাসে; সেটি কলা ভবনের ২০৬৯ নম্বর রুমের পাশে স্যারের আরেক কর্মক্ষেত্র এবং আবাসও বটে। গিয়ে একে একে পরিচিত হলাম স্যারের সহধর্মীণি এবং কমলা ভাবীর সঙ্গে। পরিচিত হলাম তাঁর দুই পুত্র প্রতীক এবং অভিকের সঙ্গে। তবে যে বিষয়টি দেখে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম, সেটা হলো রাত আটটা বেজে গেছে স্যার তবুও বসার ঘরে ব্যস্ত কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে। গবেষণার বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর জশপাল বলতেন, ‘একজন প্রকৃত শিক্ষক সব সময় ছাত্রদের মাঝেই অবস্থান করেন, ঠিক যেমন ঈশ্বর তাঁর ভক্তদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকেন।’

স্যারের বাড়ি গিয়ে আমার মনে হলো এর প্রকৃত উদাহরণ বোধহয় এই দৃশ্যটি। আমার যাওয়ার দিন কয়েক পরেই বাংলাদেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল ছিল। আগের দিন স্যারের বাড়ি যাই সন্ধ্যাবেলা। গিয়ে দেখলাম স্যারের তিন কৃতি ছাত্র উপস্থিত- অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী, অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ এবং অধ্যাপক আজিজুল হক। সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পরেই স্যার প্রথমেই আমায় সাবধান করলেন- আগামীকাল আমি যেন বাসার বাইরে বের না হই। এবং বাকি তিনজনের উদ্দেশ্যে বললেন, টুটুল যেহেতু আমাদের দেশের অতিথি তাই আগামীকাল আমরা সবাই সকাল ১০টা নাগাদ রফিক উল্লাহ’র বাসায় গিয়ে ওকে সঙ্গ দেব যাতে ওর খারাপ না লাগে।

প্রতি উত্তরে আমি যখন বললাম, স্যার, আমি না হয় আপনার বাসায় চলে আসব।

স্যার বললেন, না। রাস্তায় যদি কোনো বিপদ ঘটে তোমার; তোমায় আসতে হবে না। আমরাই যাব।

এই হলো স্যারের দায়িত্ববোধ এবং একজন অনুজের প্রতি স্নেহ ও মমতা।

কথামতো সকালবেলা স্যার তাঁর তিন কৃতি ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন। এখানে বলে রাখি, সেদিন আমি এক অন্য সৈয়দ আকরম হোসেনকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। আমার দেখা আগের আকরম স্যারকে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। প্রথমত, এই প্রথম আমি স্যারকে প্যান্ট-শার্ট পরিহিত দেখলাম।  দ্বিতীয়ত আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, এই ব্যক্তিই কি দুই বাংলার বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক ও বাংলা সাহিত্যের দিকপাল? নাকি তিনি আমার মতোই এক আড্ডাবাজ তরুণ? যার নখের ডগায় রয়েছে বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাস, কোন খেলায় কে কতো উইকেট পেয়েছিল কিংবা কে কোন খেলায় কত বলে শততম রান করেছিল! আবার পাশাপাশি কলকাতার ফুটবল ইতিহাস- মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল কিংবা মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিভিন্ন খেলার পরিসংখ্যানও তাঁর জানা!

এখনো আমার স্মৃতিতে স্যারের ক্রিকেট প্রেম জ্বলজ্বল করে। সেবার একদিন স্যারের বাসায় দুপুরের নিমন্ত্রণ এলো। খবর পেলাম দুদিন আগে থেকেই স্যার আমার পছন্দের খাবার তালিকা ঠিক করতে চিন্তিত ও উদগ্রীব ছিলেন। এনিয়ে তিনি এবং কমলা ভাবী আমার দিদি শাহীন সুলতানার (অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খানের সহধর্মীণি) সঙ্গে বারকয়েক টেলি-কনফারেন্সও করেছেন। যাই হোক, স্যারের আদেশ অনুযায়ী সেদিন সকাল-সকাল আমি এবং রফিকদা বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। জলযোগ এবং চা-পানের পরেই স্যার বললেন, চলো ক্রিকেট খেলা যাক! আমি ভেবেছিলাম বোধহয় ফুলার রোড ক্যাম্পাসের বড় মাঠে গিয়ে আমাদের ক্রিকেট খেলতে হবে। কিন্তু পরমুহূর্তে আমার ভুল ভাঙল। তিনি কোয়ার্টারের লম্বা বারান্দায় উইকেট লাগিয়ে ক্রিকেট খেলার পিচ তৈরি করে ফেললেন। সেখানেও দেখেছিলাম তাঁর ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা এবং নৈপুণ্য।

১৯৯৯ সালে ঢাকা গিয়ে আমার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় লাইব্রেরির পাশের কক্ষে। তখন সেখানে তাঁর দুই কৃতি ছাত্র এবং বাংলা বিভাগের দুই তরুণ শিক্ষকের সহাবস্থান- একজন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী, অন্যজন অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খান। এই কক্ষে বেশিরভাগ সময় কাটানোর কারণে তখন বাংলা বিভাগের বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আমার নিকটাত্মীয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ছাত্রদের মুখে স্যারের ক্লাসের বিভিন্ন ঘটনাবলি শুনতাম রূপকথার মতো। এরা প্রায় সবাই আমাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করত আমার আপত্তি সত্যেও। আবার এদের অনেকে আমায় প্রশ্ন করত- আমি পশ্চিমবঙ্গের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক? কারণটা আমার বোধগম্য হতো না। যাই হোক, এনিয়ে মজার এক কাহিনী আছে। সেবার যাওয়ার আগে থেকেই আমার পরিকল্পনা ছিল যদি সম্ভব হয় তাহলে একবার আমার বাবার জন্মস্থান সিলেটের বিয়ানিবাজারের কাঁসারি পারা গ্রাম দেখে আসব। এ ব্যাপারে স্যার আগে থেকেই জানতেন। তাই আমি ঢাকা পৌঁছানোর পরেই তিনি ভীষ্মদাকে বলে রেখেছিলেন- টুটুলের সিলেট ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে। ভীষ্মদাও সিলেটের কৃতি সন্তান। ভীষ্মদা জানালেন, তার এক ছাত্র নোমান সিলেটে বাড়ি, সে আমার সফরসঙ্গী হতে রাজি হয়েছে। যেদিন আমরা দুজন কমলাপুর স্টেশন থেকে রাতের ট্রেনে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম, ট্রেনে নোমানের কাছ থেকেও একই প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম- আমি পশ্চিমবঙ্গের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি?  অনেক কষ্টে নোমানকে বোঝাতে সমক্ষ হলাম- আমি অধ্যাপনা পেশার সঙ্গে যুক্ত নই।

 

 

এরপর তাঁকে যখন বললাম, আমি অধ্যাপনা পেশার মানুষ- এমন ভাবার কারণ কী? তখন নোমান বলল, আসলে আকরাম স্যার বিভাগে সাধারণত কারো সঙ্গে এমন করে কথা বলেন না। অথচ দেখেছি আপনাকে দেখলেই তিনি দাঁড়িয়ে কথা বলেন কিংবা রফিক উল্লাহ স্যারের রুমে আপনার গলার আওয়াজ পেলে তিনি সেই রুমে গিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলেন, তাই আমাদের ধারণা আপনিও হয়তো ভারতের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

নোমানের কাছ থেকেই স্যারের পড়ানো, ক্লাসে বিভিন্ন ঘটনার কথা জানতে পারি। সেই থেকে ইচ্ছা ছিল একদিন স্যারের ক্লাস শুনব। এই ইচ্ছা রফিকদা এবং ভিষ্মদার কাছে প্রকাশ করি। কিন্তু তারা এ-ব্যাপারে সাহায্য করতে অপারগ, যা করার আমায় নিজেকেই করতে হবে। কিন্তু আমি সাহস পাচ্ছিলাম না স্যারকে বলবার। অবশেষে ২০০১ সালের অগাস্ট মাসে  একদিন সন্ধ্যায় স্যারকে সাহস করে বলেই ফেললাম। শুনে স্যার প্রথমে খানিক সময় চুপ করে থেকে বললেন, আমার ক্লাস করে তোমার কী হবে?

বুকে অল্প সাহস যুগিয়ে প্রতি উত্তরে বললাম, স্যার আমার জ্ঞান ভাণ্ডারের উপকার হবে।

স্যার একটা হাসি দিয়ে বললেন, আগামী পরশু ঠিক ২টা ১৫ মিনিটে আমার এখানে চলে আসবে। একসঙ্গে কলা ভবনে যাব। আর একটা কথা মনে রেখ, আমার ক্লাস ঠিক আড়াইটায় শুরু হবে। আমি ক্লাসে প্রবেশ করব ঠিক দুটো উনত্রিশ মিনিটে এবং আমার ক্লাসে কোন রকম শব্দ করা নিষেধ।

তারিখটা ছিল রবিবার, ১৯ অগাস্ট ২০০১। যথাসময়ে গিয়ে হাজির হলাম। দুজন একসঙ্গে কলা ভবনেও এলাম। স্যার বললেন, আমার ক্লাস চলাকালীন কারুর বের হওয়ার নিয়ম নেই। আমি বললাম, বেশ। কিছু সময় পর স্যার আমায় নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। গরমের মধ্যেও ক্লাস রুমের সব জানালা বন্ধ। এমনকি পাখাগুলোও। ক্লাসে ঢুকেই স্যার দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে দিলেন। এরপর শুরু করলেন তাঁর পরানো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প। যদিও গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা কিন্তু মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্যারের কথাগুলো শুনছিলাম। মনে হচ্ছিল সেই রবীন্দ্রনাথ নিজেই বাংলার রাঢ়ভূমিতে আমাদের তাঁর ছোটগল্পের ব্যাপারে বলছেন। ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা। এমনকি একটি পিন পতনের শব্দও কানে বাজবে। এর মধ্যে কোনো এক ছাত্রী ফিসফিস করে কেবল বলেছে- এভাবে জানালা, দরজা বন্ধ করে পাখা না চালিয়ে গরমের মধ্যে কি ক্লাস করা যায়?

স্যার পড়ানো থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, আমি কাউকে বলিনি আমার কোর্স নিতে, যাদের সমস্যা হচ্ছে এভাবে ক্লাস করতে, তারা চাইলে অন্য কোর্স নিতে পারে। ফর্ম ফিলাপ করে নিয়ে এলে আমি সই করে দেব। এটা সবাই মনে রেখো রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বীরভূমের ওই তপ্ত মাটিতে কোনো পাখা ছাড়াই ছাত্রদের নিয়ে মাঠে বসে ক্লাস করাতেন শান্তিনিকেতনে। কথাগুলো বলে স্যার আবার ঠিক যেখানে থেমেছিলেন সেখান থেকেই পড়ানো শুরু করলেন। কীভাবে যে দেড় ঘণ্টা কেটে গেল এখনো ভাবলে শিহরণ জাগে মনে। এই হছে তাঁর পাঠদান। আরো উদাহরণ অবশ্য পরে বহুবার পেয়েছি।

২০১৮ সালে কলকাতার ট্যাগর রিসার্চ ইন্সটিটিউটে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধী গ্রহণ করতে এসে সেখান স্যারের বক্তব্য এবং তারপর সেখানে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় কিংবা বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সামনে দীর্ঘ সময় পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে তাঁর দেয়া বক্তব্য কীভাবে সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল আমার মনে আছে। কিংবা সন্ধ্যার সময় বিশ্বভারতীর কলা ভবনের ক্যান্টিনের সামনে বেঞ্চে বসে বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা ছেলেমেয়েদের যেভাবে শান্তিনিকেতনের ইতিহাস এবং রবীন্দ্রনাথ সহজভাবে বুঝিয়েছিলেন কখনও ভোলার নয়। সকল ঘটনার সাক্ষী থাকার সৌভাগ্য আমার ঘটেছিল।

এখানে দুটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। ট্যাগর রিসার্চ ইন্সটিটিউটে অনুষ্ঠানের প্রথমে ছিল সমাবর্তন ও রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য  উপাধী প্রদান। এরপর দুপুরের আহার। তারপর ওখানকার ছাত্রছাত্রী এবং শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে আলাপচারিতা। দ্বিতীয় অনুষ্ঠানের শেষে বিশ্বভারতীর এক গবেষক এবং কলকাতার এক সরকারি কলজের শিক্ষকের মন্তব্য ছিল: ‘এতো সহজভাবে যে রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবন করা যায় স্যারের সঙ্গে পরিচয় না হলে জানতেই পারতাম না।’ আর একটি ঘটনা বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রিটা মোদকের উক্তি: ‘স্যার এতো বড় মাপের রবীন্দ্র গবেষক বলেই হয়তো আমাদের সামনে এতো সহজভাবে রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরলেন এবং বাংলাদেশের রবীন্দ্রচর্চা ও রবীন্দ্র গবেষণার ছবি এতো সুন্দরভাবে তুলে ধরতে পারলেন। আমরা কিসের পাণ্ডিত্যের বরাই করি এদের সামনে!’

এই দীর্ঘ সময় আমি নিজে স্যারের দায়িত্ববোধ এবং স্নেহের প্রকাশ বিভিন্নভাবে উপলব্ধি করেছি। একবার স্যারের বাসায় দুপুরের নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে দই দিয়ে ভাত মেখে খাওয়া দেখে স্যার বলে উঠলেন, দই দিয়ে ভাতের চেয়ে খই দিয়ে মেখে খেতে আরো উপাদেয়। তার দুদিন পরে সন্ধ্যায় ডাক এলো তাঁর বাসায় যাওয়ার জন্য। পরে জেনেছিলাম, তিনি নিজে পুরনো ঢাকা থেকে ভালো খই সংগ্রহ করে এনেছিলেন আমার জন্য। ২০০১ সালে ঢাকা থেকে ফেরার সময় রাতে বাসে ফিরছিলাম, উদ্দেশ্য ছিল জ্যোৎস্না রাতের পদ্মা দেখব। বেনাপোলে বাস থামতেই দুই উর্দিধারি বাসে উঠে আমার নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম; পরে জানতে পারি তখনকার বেনাপোলের কমিশনার অফ কাস্টমস স্যারের ছাত্র ছিলেন।স্যার রাতে ফোন করে তাকে জানিয়ে রেখেছেন আমাকে যেন রিসিভ করে তার  কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে সকালের নাস্তা করিয়ে বর্ডারে পৌঁছে দেয়া হয়।

আমার চোখে আকরম স্যার ব্যতিক্রমী মানুষ। তিনি কেবলমাত্র তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য স্বমহিমায় রয়েছেন তাই নয়, তিনি তাঁর সময়ানুবর্তি জীবনযাপন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই নিয়ে সমগ্র বাংলাদেশ তথা বাঙালি জাতিসত্তার মধ্যে বিরাজ করছেন। তাই আজ তাঁর ছাত্ররা কেবল বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিব, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন কিংবা বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছে তাই নয়, তাঁর ছাত্ররা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেও কর্মজীবনে উজ্জ্বল অবস্থানে রয়েছেন। একজনের মন্তব্য এখানে না উল্লেখ করলে স্যারের মূল্যায়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ২০১৮ সালে স্যারের কলকাতা আগমনের আগে আমায় ফোনে তিনি জানান শান্তিনিকেতনে গিয়ে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। আমি যেন তাঁর ফোন নম্বর সংগ্রহ করে রাখি। কথাটি মানবেন্দ্র বাবুকে বলতেই তিনি বললেন, ‘আকরম স্যার হলেন আমার সেই শিক্ষক, যাকে এখনো চোখে দেখিনি কিন্তু তাঁর বই পড়ার পর থেকেই তিনি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হয়ে আছেন। আর তাঁর বই ছিল বলেই আমরা আমাদের মাস্টার্স- এর পড়াশোনা এতো মসৃণভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি।’

স্যার হতে পারতেন অনেক কিছুই, কিন্তু তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ২০৬৯ নম্বর কক্ষে বসে বিশ্বের বাংলা সাহিত্যের এক ইতিহাস রচনা করে গেছেন দীর্ঘ একান্ন বছর শিক্ষকতা জীবনে। তাই আজ বিশ্বে বাংলা সাহিত্যপ্রেমী কিংবা বাংলার ছাত্রদের কাছে তিনি এক বটবৃক্ষ। তিনি সক্ষম হয়েছেন ছাত্রদের মাধ্যমে আকরমীয় ধারা স্থাপন করতে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে।

স্যারের মধ্যে লক্ষ্য করেছি পাণ্ডিত্যের পাশাপাশি প্রবল দেশপ্রেম, সমাজ এবং রাজনৈতিক সচেতনতা। এ কারণে সেই পূর্ব পাকিস্তান আমল থেকে বর্তমানের বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলন কিংবা গণ-অভ্যুত্থানে তিনি পালন করেছেন মহান দায়িত্ব এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রদান করেছেন নেতৃত্ব। তাঁর কাছ থেকেই আমার আধুনিক কবিতা এবং বর্তমান সময়ের কথাসাহিত্যের জ্ঞানার্জন। স্যারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোনো জাগতিক ছাঁচে ফেলা যাবে না। বরং স্যারের ভাষাতেই বলি- আমরা দুজনে রক্তিয়, যেটা কেবল উপলব্ধি করা যায়। আমি একটা কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি- পিতামাতার পরেই শিক্ষকের ঋণ। তাই  আকরম  স্যারের কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য। স্যারের ৭৫তম জন্মদিনে প্রার্থনা করি- তিনি আমার শিক্ষক এবং একজন পিতা হিসেবে আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি তাঁর ছায়াতলে আমাকে আশ্রয় দেবেন।



কলকাতা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়