ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলা যে কারণে নজিরবিহীন

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলা যে কারণে নজিরবিহীন

অভিযোগের তীর সু চি এবং মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের দিকে

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের গণহত্যার অভিযোগ পুরোনো। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় ‘অপারেশন ড্রাগন কিং’। তখন অভিযোগ ওঠে, সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের ভীতি প্রদর্শন, ধর্ষণ ও হত্যার দ্বারা জোরপূর্বক গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করেছে। সে সময় ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি মুসলিম দেশে এর প্রতিবাদ হলেও বিশ্বব্যাপী বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। এমনকি জাতিসংঘেরও শক্তিশালী পদক্ষেপ আমরা দেখিনি। তখন বরং বিশ্বব্যাপী মিয়ানমারের আলোচনা হিসেবে অং সান সু চি গুরুত্ব পেয়েছেন। তার আড়ালেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চলতে থাকে।

১৯৯২ সালেও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে গণহত্যা চালানো হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালে মিয়ানমার যে ভয়াবহ গণহত্যা পরিচালনা করে, কেবল সেই ঘটনাতেই সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। সব মিলিয়ে এগারো লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশের এই ছোট ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়েছে।  জাতিসংঘ ওই ঘটনাকে জাতিগত নিধনের এক আদর্শ উদাহরণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়েসহ আরো তিন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। এই সংকটে জাতিসংঘ মহাসচিবও উদ্বিগ্ন।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিশ্ববাসী সোচ্চার ছিল এবং এখনও আছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের হাজার বছরের নিবাস রাখাইন যার পূর্ব নাম ‘আরাকান’। সেখান থেকে পরিকল্পিত নৃশংসতার মাধ্যমে গত ২০ বছর ধরে উচ্ছেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে মিয়ানমার সরকার। এটি জাতিগত নিধন এবং পরিকল্পিত গণহত্যা। সর্বশেষ নৃশংসতা ও গণহত্যার বাস্তবায়ন হয়েছে দুই বছর ধরে। শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে, তবে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে তা ভয়াবহ নৃশংসতায় রূপ নেয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্থানীয় বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সমর্থনে এমন কোন বর্বরতা নেই যা রোহিঙ্গাদের ওপর চালায়নি। উত্তর রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত তিন জেলায় কার্যত ভিটেবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে তাদের দেশছাড়া করেছে। যাদের প্রায় এগারো লাখ বাংলাদেশে এবং কিছু অন্যান্য দেশে পালিয়ে গেছে। বাকি রোহিঙ্গারা রাখাইন অঞ্চলেই আবদ্ধ ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘নারী ও কিশোরীদের কাঠামোবদ্ধ হত্যা ও ধর্ষণ, গর্ভবতী নারীদের ধর্ষণ, শিশুদের ওপর হামলা, যৌনাঙ্গে আঘাত, স্পর্শকাতর স্থানে হামলা ও তার প্রদর্শন। এছাড়া নারীদের এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে, যেন তারা স্বামীদের সঙ্গে সহবাস করতে না পারে এবং সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে পড়ে। একজন নারীকে ত্রিশজন পর্যন্ত ধর্ষণ করেছে, তারপর স্তন কেটে ফেলা হয়েছে, যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে পশুত্বের চরম পর্যায় প্রদর্শন করে উল্লাস করেছে। পুরুষদেরও জোরপূর্বক বলাৎকার ও যৌনকাজে লিপ্ত করা হয়েছে। নারীদের যৌনদাসী করে সামরিক ঘাঁটিতে রাখা হয়েছে।’

বিষয়গুলো বিশ্বাবাসীর কাছে মিয়ানমার কোনোভাবেই লুকিয়ে রাখতে পারছে না, যদিও বহু চেষ্টা তারা করেছে। বিগত দুই বছরে বিশ্বের বহু দেশের স্বাধীন মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের তদন্তে বিষয়গুলো প্রমাণিত হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অনুরোধে মধ্য আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের তরফ থেকে জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস-এ মামলা দায়ের করেছে। বিশ্ব মানবাধিকার দিবস ১০ ডিসেম্বর এর শুনানি শুরু হয়েছে, চলবে ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর, একাধারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির প্রধান অং সান সু চি মিয়ানমারের এবং সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইতে উপস্থিত হয়েছেন নেদারল্যান্ডসের হেগে। শুনানি পর্যবেক্ষণ করতে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (এশিয়া-প্যাসিফিক) মাসুদ বিন মোমেনসহ বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল হেগে রয়েছেন। কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদলও পৌঁছেছেন সেখানে। গাম্বিয়ার পক্ষে দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারমন্ত্রী আবুবকর তামবাদুর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলও আছেন হেগে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা আছেন।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক রোহিঙ্গাদের সংগঠন বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের প্রেসিডেন্ট তুন খিন বলেন, ‘অবশেষে মিয়ানমার সরকার এবং এর সামরিক বাহিনী এখন সত্যিকারের চাপ অনুভব করছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ওপর জেনোসাইড সংঘটিত হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা আইসিজের আইনি রুলিং দেখতে চাই। যদি সেটি নাও হয় আমাদের প্রত্যাশা অন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের রক্ষা করতে দৃষ্টি দেবে।’

বিশ্বাবাসী অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করছে অং সান সু চির ভূমিকা। তিনি কেন এত বড় গণহত্যা ও জঘন্য অপরাধের পক্ষে সাফাই গাইতে হেগে গিয়েছেন? মিয়ানমারে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর সমর্থন লাভের আশায়। তবে তিনি কীভাবে খণ্ডাবেন ৪৪৪ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র? নেপিডো, ইয়াঙ্গুন, মান্দালয়সহ মধ্য মিয়ানমারের অন্যান্য শহরে অং সান সু চির এ উদ্যোগের সমর্থনে সামরিক বাহিনীর বড় বড় হোর্ডিং লাগানো হয়েছে। প্রতিদিন তার সমর্থনে মিছিল হচ্ছে, শোভাযাত্রা হচ্ছে। সু চির পদক্ষেপকে সমর্থন করছে  ওয়া, দ্য মংলা এবং রেস্টোরেশন কাউন্সিল অব সান স্টেট। তবে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার সমর্থন করছে আরাকান আর্মি, যারা রাখাইনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আরো রয়েছে তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যাল্যায়েন্স আর্মি ও এদের রাজনৈতিক ফ্রন্টগুলো। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সু চির বিরোধিতা ও মামলার সমর্থনে রয়েছে আরও বেশ কিছু এথনিক গোষ্ঠী। কারেন গ্রুপের মানবাধিকার সংগঠনের মুখপাত্র চেরি জাহান বিশ্বের ৫০টি সমর্থক গোষ্ঠীকে সু চির বিরুদ্ধাচরণ করতে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শুধু রোহিঙ্গারাই নয়, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর হাতে কারেন জনগোষ্ঠীসহ অন্যরা বিগত ৫০ বছর ধরে নিগৃহীত হচ্ছে। যার দালিলিক প্রমাণ জাতিসংঘে রয়েছে। জাতিগত কাচিন ও কারেনদের ওপর নিধন যজ্ঞকেও সু চি কখনো সামিরক বাহিনীর বাড়াবাড়ি বলে মনে করেননি। মনে করেছেন সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক দায়িত্ব হিসেবে! রোহিঙ্গা মুসলিমদের সমর্থক মানবাধিকার সংগঠনগুলো মিয়ানমার ক্যাম্পেইন বয়কট শুরু করেছে। বৈশ্বিকভাবে মিয়ানমারকে বয়কটের ডাক দিয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিশ্বের দশটি দেশের অন্তত ত্রিশটি মানবাধিকার সংস্থা।

আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ কয়েক বছর সময় প্রয়োজন। তাই মামলা দায়েরকারী মূল মামলার পাশাপাশি অর্ন্তবর্তীকালীন প্রতিকার চেয়েও আবেদন করেছেন। আবেদনকারীর অর্ন্তবর্তীকালীন প্রতিকার জরুরি কিনা এবং তা মঞ্জুর করা হবে কিনা সে বিষয়ে আজও শুনানি হচ্ছে। অর্ন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদনে গাম্বিয়া আইসিজের কাছে যেসব প্রতিকার চেয়েছে তা হলো- রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় আদালতের আদেশ অতি জরুরি। আর গণহত্যা প্রতিরোধে আশু ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারকে আদেশ দান। মিয়ানমার সেনাবাহিনী যাতে আর কোনো গণহত্যামূলক কাজ করতে না পারে, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করতে মিয়ানমারকে আদেশ প্রদান। গণহত্যার আলামত যাতে ধ্বংস না হয় কিংবা আলামত সংগ্রহকে যাতে অনভিগম্য করা না হয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আদেশ প্রদান।

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ ও জেনোসাইডের আড়াই বছরের মধ্যে মিয়ানমার বিচারের মুখোমুখি হয়েছে, এটি বিশ্বসভ্যতার জন্য শুভ লক্ষণ। আইসিজে ব্যক্তি অপরাধের বিচার করে না। সাধারণত সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রাখে। আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলা নজিরবিহীন। কারণ এর আগে জেনোসাইডের মামলা নিয়ে কেউ আইসিজেতে যায়নি। মিয়ানমার আইসিজে’র সদস্য নয়। বাংলাদেশ সদস্য হওয়ায় এবং রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে মিয়ানমার যে অপরাধ সংঘটিত করেছে তার তদন্ত ও এখতিয়ার আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টের রয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের শুনানিই মিয়ানমারের ওপর বড় চাপ এবং রোহিঙ্গাদের বিজয়। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন মঞ্চে বিষয়টি আলোচিত হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভুক্তভোগীরা বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে বলেছে: ‘এক সময়  অং সান সু চি ছিলেন শান্তির প্রতীক। আমাদের আশা ছিল তিনি ক্ষমতায় এলে নির্যাতন বন্ধ হবে। আমরা তার জন্য দোয়া করেছি। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় এসেই গণহত্যার প্রতীকে পরিণত হলেন। আমাদের রক্ষার বদলে তিনি হত্যাকারীদের সাথে হাত মেলালেন। তাদেরকে রক্ষা করতে গেলেন। আমরা এজন্য তাকে ঘৃণা করি।’

আইসিসি ব্যক্তিবিশেষের অপরাধের বিচার করে। আর আইসিজে রাষ্ট্রের বিচার করে। যে আদেশই আসুক না কেন, মামলার দুই পক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবার জন্য পালন করা বাধ্যতামূলক। আইসিসি, আইসিজে কারুরই নিজস্ব কারাগার বা আদেশ বাস্তবায়ন করার মতো নিরাপত্তা বাহিনী নেই। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতার ওপরই তাদের আদেশ বাস্তবায়ন নির্ভর করে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আইসিসি বা আইসিজে যদি কোন আদেশ দেয় তবে সেটি বাস্তবায়নে অনেক দেশই ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্বসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে এই নরপশুদের উচিত শিক্ষা বিশ্ববাসীকে দিতেই হবে।

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়