ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অনুশীলনমূলক বই নিষিদ্ধ করার কারণ নেই

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অনুশীলনমূলক বই নিষিদ্ধ করার কারণ নেই

ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু আমরা কি শুধু ভাত খাই? ভাত হজম করার জন্য, সুপাচ্য ও সুস্বাদু করার জন্য ভাতের সাথে ডাল, তরকারি, মাছ, মাংস, দুধ ইত্যাদি খেতে হয়। শুধু ভাতে তৃপ্তি হয় না, পেট ভরে না, পুষ্টির চাহিদা মেটে না। একইভাবে শুধু ক্লাসের বই, শুধু এনসিটিবির বই শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটাতে পারে না। বইয়ের পাঠ আকর্ষণীয় ও বোধগম্য করার জন্য সহায়ক বই শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের পড়তে হয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে একটি করে লাইব্রেরি থাকে, থাকতে হয়। সেটি কেন? কোর্সের বই, বিভাগীয় বই তো যথেষ্ট হওয়ার কথা ছিল। তাহলে শিক্ষকদের, শিক্ষার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরিতে কাটাতে হয় কেন?

না, শুধু সেই বইগুলোই যথেষ্ট নয়। বিখ্যাত লেখকদের বই, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ইত্যাদি পড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন সমালোচক, লেখকদের লেখাও পড়তে হয় বিষয়টির আরো গভীরে যাওয়ার জন্য। জ্ঞানের দিগন্ত প্রসারিত করার জন্য। বিষয়টির পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য। একটি বিষয় সম্পর্কে বিভিন্ন লেখকের লেখা জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে, শিক্ষার্থীর জ্ঞান সমৃদ্ধ করে। শিক্ষার্থীদের যদি শুধু এনসিটিবির বই দিয়েই জ্ঞানের রাজ্য সংকুচিত করে দেয়া হয় তাহলে তাদের চিন্তার জগত, সৃজনশীলতার জগত, অনুধাবন ও কল্পনার জগত সংকুচিত হতে হতে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যাবে।

কথাগুলো এজন্য বলা, প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন-২০১৯ এ শিক্ষা সহায়ক অনুশীলনমূলক বইকে নোট গাইড হিসেবে আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধের কথা শোনা যাচ্ছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষাবিদগণও। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ঘাটতি, শিক্ষক স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে অনুশীলনমূলক বই শিক্ষার্থীদের কাছে বিশেষ করে মফঃস্বল ও প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষার্থীদের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। অনুশীলনমূলক বই প্রকাশনার সাথে সরাসরি  জড়িত ৪ লাখ ৬২ হাজার পরিবার। এটি নিষিদ্ধ করা হলে লাখ লাখ মানুষের জীবন জীবিকা হুমকির মধ্যে পড়বে। বাংলাদশে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বলেছেন, ‘এসব গ্রন্থ প্রকাশ ও বিক্রির সঙ্গে অন্তত ৮টি পেশার ২৩ লাখ ১০ হাজার মানুষ জড়িত। এই খাতে সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। এসব গ্রন্থ প্রকাশনা বন্ধ করা হলে সরকার একদিকে শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে, আরেকদিকে অসংখ্য কর্মহীন মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হবে।’ (সূত্র: বিডি২৪.কম)।

এছাড়া একথা ভুলে গেলে চলবে না, অনুশীলনমূলক বইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এ পরিস্থিতির পেছনে র্দীঘদিনের পুঞ্জীভূত কারণ আছে। সেসব সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়। দেশের ৯৫শতাংশ শিক্ষার্থী এই বই পড়ছে। ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর এক দশক পরেও ৪২ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ এখনও সঠিকভাবে বিষয়টি বুঝেন না, প্রশ্ন করা তো দূরের কথা। ২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় দেখা গেছে- বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন হুবহু বাজারের গাইড থেকে তুলে দেয়া হয়েছে। এর অর্থ কী বা এর কারণ কী? এই অনুশীলনমূলক বই যারা লিখেন তারা মোটামুটি ভালো মানের শিক্ষক, অন্যান্য  শিক্ষকগণ এসব বই থেকে এখনও সাহায্য নেন। শহরের বিদ্যালয়গুলোতে একটি শ্রেণিকক্ষে একশ’র বেশি শিক্ষার্থী। একজন শিক্ষক ঐ ক্লাসের ডিসিপ্লিন রক্ষা করতেই অনেকটা সময় ব্যয় করে ফেলেন। ফলে প্রশ্ন থেকে যায়- কতজন ছাত্রকে তারা নিবিড়ভাবে সময় দিতে পারেন? এসব কারণে শিক্ষার্থীরা ছুটছে কোচিং সেন্টারে, পড়ছে অনুশীলনমূলক বই। গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে শুধু শিক্ষক স্বল্পতা নয়, অধিকাংশ শিক্ষকদের মান নিয়ে রয়েছে বিরাট প্রশ্ন। এটি একটি বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে আমরা অস্বীকার করতে পারব না, এড়াতেও পারব না। একটি শ্রেণিকক্ষে ক’জন নিয়মিত, মেধাবী এবং সৃজনশীল শিক্ষার্থী থাকে? সৃজনশীলতা অনেকের ভেতরে থাকলেও শিক্ষা জীবনে পরিবেশের কারণে ক’জন তা প্রকাশ করতে পারে? হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন শিক্ষার্থী হয়তো সবকিছু ছাপিয়ে তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে পারেন, ভালো ফল করতে পারেন। তারা হয়তো ইঞ্চিনিয়ারিং, চিকিৎসা শাস্ত্র পড়ে ভালো পেশাজীবন গড়েন। এভাবে কেউ বিসিএস দেন, কেউ আবার চলে যান বিদেশে। শিক্ষকতায় কমসংখ্যক ছাত্র আসতে চান। তারও বাস্তব কারণ আছে যা আমাদের জানা। এই পরিস্থিতিতে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের চেয়ে বেশি নির্ভর করতে হয় বাজারে প্রচলিত সহায়ক বা অনুশীলনমূলক বইয়ের ওপর।

আগে কলেরা হলে রোগীকে পানি খেতে দিতেন না ডাক্তার। পানির অভাবেই অনেক রোগী মারা যেত। পরে আবিষ্কৃত হলো কলেরা হলে রোগীকে স্যালাইন পানি খেতে দিতে হবে। এখন তাই করা হচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল হচ্ছে না, তার কারণ কি বাজারের অনুশীলনমূলক বইয়ের উপস্থিতি? বিষয়টি তা নয়। এর কারণ বহুবিধ এবং অনেক গভীরে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকারকে সেসব কারণ বের করতে হবে। তবে, এসব কারণ বের করে সমাধান দেয়া খুব সহজ কাজ নয়। বই রেশনিং করে এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বর্তমানে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বই বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। এটি ভলো পদক্ষেপ। তারপরও ‘কিন্তু’ থেকে যায়। আমি এনসিটিবির এক কর্মকর্তাকে বলেছিলাম, ‘আমরা শিক্ষা নিয়ে কাজ করি, অন্যান্য বইয়ের সাথে এনসিটিবির বই আমাদের প্রয়োজন । কীভাবে পাব? আগে তো বাজার থেকে কিনে নিতাম। এখন কী করব? বই বাজারে পাওয়া যায় না।’

তিনি বললেন, ‘বছরের প্রথম দিকে আপনাকে চাহিদা দিতে হবে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে।’ আমি বললাম, ‘আমি তো ঢাকায় ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ে বসি। আমি কার কাছে গিয়ে বইয়ের চাহিদা দিব।’ তিনি বললেন, ‘খুঁজে দেখেনে ঢাকার কোন এলাকায় শিক্ষা কর্মকর্তা বসেন। তার অফিসে গিয়ে চাহিদাপত্র দিতে হবে। কারণ দর্শাতে হবে আপনি কেন বই চাচ্ছেন? তারপর এক বছর পর তার অফিসে গিয়ে বই নিয়ে আসতে হবে।’ শিক্ষাকে আমরা এত রেশনিংএর মধ্যে নিয়ে এলাম কেন? এতে কতটা উপকার হয়েছে? আর শহরে যারা থাকেন তাদের জন্য ওয়েবসাইটে বই দেয়া আছে। কিন্তু সে বই ডাউনলোড করতে শুধু ঘণ্টা নয়, দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়।

একুশে বই মেলায় বহু ধরনের বই প্রকাশিত হয়। অনেকের বই পাঠক কেনেন, অনেকের কম কেনেন। অনেকের বই একেবারেই কেনেন না। কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন দেন সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে। কেউ কেউ টিভিতে আলোচনার জন্য বিভিন্ন ফন্দি ফিকির করেন। কিন্তু পাঠক যে বইটি ভালো লাগে সেটি কিনবেনই। সব বই তো চলবে না। অনুশীলনমূলক বইয়ের ক্ষেত্রে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। কিছু নির্দেশনা দিতে পারে, কিন্তু বই একেবারে নিষিদ্ধ করা কতটা যুক্তিসঙ্গত? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মূল বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে শ্রেণিকক্ষে, বিভিন্ন সূত্র থেকে তাদের পড়াশোনার বিষয় ভালোভাবে জানতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের পত্রিকাগুলো এক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। টিভি চ্যানেলগুলো ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। দু’একটি টিভিতে ঢাকা শহরের কিছু শিক্ষক মডেল ক্লাস পরিচালনা করেন। আমি সেগুলো দেখেছি। কিন্তু একেবারেই ট্রাডিশনাল ক্লাস। শুধু সংজ্ঞা দিচ্ছেন, আর পড়িয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের যে কাজে অংশগ্রহণ করাতে হবে, তাদের বেশি বেশি সুযোগ দিতে হবে এই বিষয়টি সেখানে ঘটছে না। তাদের ক্লাস দেখে গ্রামের শিক্ষকদের খুব একটা কিছু শেখার নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব বিষয়ে দৃষ্টি দিলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণ উপকৃত হবেন।

সবশেষে যেটি করতে হবে তা হচ্ছে মানসম্পন্ন প্রশ্ন। প্রশ্ন তৈরি করা সহজ কাজ নয়। সব শিক্ষক প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। তবে সব শিক্ষক যাতে প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন, তাদের সেভাবে তৈরি করতে হবে।  সেটি করতে হলে প্রয়োজন মোটিভেশন, উৎসাহ প্রদান, প্রশিক্ষণ। নিয়মিত প্রশাসনের উপস্থিতিতে অন্তত মাসে একবার সকল শিক্ষকদের দিয়ে ‘ডিমনেষ্ট্রশন’ ক্লাস পরিচালনা করাতে হবে। তাহলে তারা পড়াশোনা করবেন, সাহস পাবেন, নিজেরা তৈরি হবেন। বিদ্যালয় থেকে বোর্ড পর্যন্ত প্রশ্ন এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেগুলোর উত্তর দিতে শিক্ষার্থীদের মূল বই অবশ্যই পড়তে হবে। নিজের চিন্তা চেতনা ও সৃজনশীলতার ছাপ উত্তরপত্রে ফুটে উঠবে। বই সামনে দিলেও যাতে নিজের মতো করে উত্তর লিখতে পারে। সে কোথা থেকে পড়ল বা শিখল সেটি বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে সে প্রকৃত বিষয়টি বুঝেছে কিনা তার প্রমাণ নিতে হবে। দেশের পত্রপত্রিকাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের বাস্তবভিত্তিক সমস্যা ও সামাধানের কথা বলা হয়, বিভিন্নজন লিখে থাকেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের চোখে সেগুলো ধরা পড়ে কিনা জানি না। তবে, যে রোগ তার আসল চিকিৎসা প্রয়োজন। মাথা ব্যথা হলে প্রয়োজন উপসর্গ অনুযায়ী মেডিসিন, মাথা কেটে ফেলা নয়।

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়