ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

করোনায় গুজব ঠেকাতে প্রয়োজন কঠোর নজরদারি

মোহাম্মদ নূরুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৫, ৬ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনায় গুজব ঠেকাতে প্রয়োজন কঠোর নজরদারি

বিশ্বব্যাপী চলছে মহামারি করোনা। এই ভাইরাসের ছোবলে পুরো মানবজাতি বিপর্যস্ত। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। অথচ এই ক্রান্তিকালেও কিছু মানুষ ফেসবুক-ইউটিউবে গুজব ছড়িয়ে চলছে। এর মাধ্যমে উপার্জন করছে অর্থ। কিছু লোক জড়িয়ে পড়েছে এই ঘৃণ্য অপরাধে।

এই গুজব সৃষ্টিকারীরা অনৈতিক পথে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিদেশি মুভি থেকে ক্লিপ নিয়ে ভিডিও বানাচ্ছে। তাতে জুড়ে দিচ্ছে নিজের তৈরি গল্প। পুরনো ছবি নিয়ে ফেসবুকে দিয়ে দাবি করছে ‘করোনায় মৃত’। কেউ কেউ কোনো তথ্য যাচাই না করে, কোনো চিকিৎসক-পুলিশ কর্মকর্তার বরাত না দিয়েই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, করোনায় কোথায়, কখন কার মৃত্যু হয়েছে।

ঘটনা এখানেই থেমে থাকছে না। এর ডালপালা গজানো শুরু হয়েছে সর্বব্যাপী। ফেসবুকের তথ্য-ছবি ও ইউটিউবের ভিডিও ক্লিপ ধরে দেশের গণমাধ্যমগুলোও প্রতিবেদন তৈরি করে ফেলছে। অথচ এসব প্রতিবেদনে থাকছে না কোনো ভিডিও-ছবি বিশেষজ্ঞের অভিমত। থাকছে না কোনো অপরাধ-বিশ্লেষকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ; প্রশাসনের দায়িত্বশীল কারও বক্তব্যও না। এসব গণমাধ্যম ভেবে দেখছে না—যে অপরাধ ইউটিউবার-গুজব রটনাকারী করেছে, সেই অপারাধে তারাও সমান অংশীদার। একজন গুজব রটনাকারী তার ফেসবুকে একটি পোস্ট দিলে সাধারণ তার ফ্রেন্ড-ফলোয়াররাই দেখেন। তারাই প্রভাবিত হন আগে। কিন্তু গণমাধ্যমে ওই গুজবকে তথ্য ধরে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত-প্রচারিত হলে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষই সত্য বলে গ্রহণ করে। এর পেছনের কারণ খতিয়ে দেখতে গেলে বেশ কিছু প্রসঙ্গ সামনে আসবে:

             ১। অন্যদের চেয়ে আলাদা  হওয়ার আকাঙ্ক্ষা
             ২। অর্থ উপার্জন
             ৩। সেলিব্রেটি বনে যাওয়ার স্বপ্ন
             ৪। সমাজে প্রভাব বিস্তার
             ৫। বিকৃত আনন্দ

পুনারাবৃত্তি এড়িয়ে চলার স্বার্থে ওপরের পাঁচটি ইস্যুই একসঙ্গে আলোচনা করা যাক। মানবমনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি—অন্যদের চেয়ে নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করা। এই আলাদা হওয়ার জন্য সমাজের একেক শ্রেণী একেক ধরনের আচরণ করে। কেউ সমাজের মঙ্গল সাধন করে। কেউ করে ক্ষতি। কেউ সমাজকে আনন্দ দেয়, কেউ দেয় দুঃখ-কষ্ট।  সম্প্রতি সমাজকে আনন্দ দেওয়ার চেয়ে বিপাকে ফেলার প্রতিযোগিতা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।

সৃজনশীলতা কিংবা মননশীলতা দিয়ে যারা স্বাতন্ত্র্য অর্জনে ব্যর্থ হয়, তারা বেছে নেয় অনৈতিকতার পথ।  কারণ তাদের মন দূষিত। তারা অন্যদের চেয়ে আলাদা হতে চায়, তবে কোনো মহৎ পথে নয়। সাদা চোখে তাদের অপরাধ ধরা পড়ে না। সূক্ষ্ম চোখে ধরা পড়ে। ধরা পড়ে তারা সাধারণ অপরাধী নয়, ডিজিটাল ক্রিমিনাল। সাধারণ অপরাধীদের কারণে দুই-একজনের টাকা-পয়সা হারানো যায়। কারও কারও হয়তো অঙ্গহানিও ঘটে। কখনো এক-দুই জনের প্রাণহানির কারণও হয় এই তারা। কিন্তু ডিজিটাল ক্রিমিনালরা পুরো জাতিকে পঙ্গু করে দেয়।  বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয় পুরো মানবজাতিকেই।

বিস্ময়কর হলেও সত্য—এই ডিজিটাল ক্রিমিনালদের সহজে চেনা যায় না। সাদা চোখে তাদের বন্ধুই মনে হয়। কারণ তারা চলে সাধারণ মানুষের সঙ্গেই। কথা বলে সহজভাবেই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে চলে তাদের সব রকমের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।

এই অপরাধীরা বিশেষ বিশেষ মৌসুমে বিশেষ বিশেষ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। যখন যে মৌসুম আসে, তখন সেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। এখন চলছে করোনার প্রাদুর্ভাব। এই ক্রিমিনালরাও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তৈরি করছে ভিডিও-ছবি। তাতে এমন  মনগড়া তথ্য হাজির করছে, তত্ত্ব উপস্থাপন করছে, যা প্রথম শোনায় মনে হতে পারে এর চেয়ে সত্য আর হতেই পারে না। কিন্তু ক্ষণিকের মুগ্ধতা কেটে গেলে অনুসন্ধিৎসু চোখ-কানে ঠিকই ধরা পড়ে—এই কাজ কেনো মহৎ মানুষের নয়। এই কাজ ডিজিটাল ক্রিমিনালের।

এর মাধ্যমে তারা কেবল আলাদাই হচ্ছে না, সঙ্গে উপার্জন করছে অর্থও।  ইউটিউব চ্যানেলে যত ভিজিটর, তত ভিউ। যত ভিউ তত ডলার। সঙ্গে বাড়ছে জনপ্রিয়তাও। এই চক্রের মোহে পড়ে একসময় তারা স্বপ্ন দেখে সেলিব্রেটি বনে যাওয়ারও। তাদের নিয়ে এক শ্রেণীর মিডিয়া প্রতিবেদন প্রচার-প্রকাশও শুরু করে। এর  মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী-রুচির গোষ্ঠীর কাছে তারা সেলিব্রেটির মর্যাদাও পেয়ে যায়।

আর একবার সেলিব্রেটি বনে গেলে তাদের আর পায় কে? প্রথমে ওই গোষ্ঠীর ভেতর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। একসময় সফলও হয়। স্বাতন্ত্র্য-অর্থ-জনপ্রিয়তা-প্রভাবের মতো এই বিষয়গুলোর ভেতর দিয়ে তারা এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পায়।

এই তথাকথিত সেলিব্রেটিদের বিকৃত রুচি-আনন্দের বলি হয় সাধারণ মানুষ। তারা এসব সেলিব্রেটির বানানো প্রতিবেদন ও ভিডিও’র সূত্র ধরে নিজেদের মধ্যে বাক-বিতণ্ডার  শুরু করে। জড়িয়ে পড়ে পরে মারামারিতেও। কারও কারও প্রাণও যায় তাতে।

এই করোনা প্রাদুর্ভাবে সাধারণ অবরুদ্ধ মানুষ তথ্যের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। এরই সুযোগে অপরাধীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য দিয়ে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করছে। একথা কে না জানে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ফেসবুকে মুসলমানদের পবিত্র কাবাঘরের জন্য অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার জের ধরে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা? কিংবা ‘কোরআন অবমাননা করে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করা’র অভিযোগ তুলে রামুর বৌদ্ধমন্দিরে আগুন দেওয়ার কথা?

এই দীর্ঘ শীবের গীতের একটিই উদ্দেশ্য। এখন এই করোনাকালে ভুয়া ছবি-ভুয়া ভিডিও প্রচার-প্রকাশের ওপর যদি সরকার নজরদারি  না চালায়, তাহলে আরও একটি নাসিরনগরকাণ্ড কিংবা রামুকাণ্ড যে ঘটবে না, তার কী নিশ্চয়তা আছে?

এখনই নজরদারি না করলে শাস্তির ব্যবস্থা না করলে এসব ভুয়া ছবি-ভিডিও প্রচারের মাধ্যমে বিভ্রান্তির ডালপালা গজাতেই থাকবে। আর অনুবাদের মাধ্যমে বিদেশিদের কাছেও চলে যাবে। তখন একদিকে জাতি বিভ্রান্ত হবে, অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়বে।

আপৎকালে ফেসবুক-ইউটিউবে যেসব গুজব ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা রোধ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন প্রশাসনের কঠোর নজরদারি। প্রশাসনকে দেখতে হবে—কে ফেসবুকে কী লিখছে, কী শেয়ার করছে। ইউটিউবে কী আপলোড করা হচ্ছে, কারা করছে? এসবের বিষয়বস্তু কী? বিদেশি মুভির ক্লিপ নিয়ে যারা বাংলা ডাবিং করে ফেক প্রতিবেদন তৈরি করছে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। যারা কোনো রকম নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত ছাড়াই ফেসবুকে তথ্য প্রচার করছে, তাদেরও আনতে হবে নজরদারিতে।

ফেসবুক-ইউটিউবের ওপর কঠোর নজরদারির মাধ্যমে গুজব সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে গুজব সৃষ্টিকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দেওয়ার জন্য অভিযান চালাতে হবে ভ্রাম্যমাণ আদালত কিংবা টাস্কফোর্সের। আর এই উদ্যোগ নেওয়ার এখনই সময়। না হলে সময় যত গড়িয়ে যাবে, মানুষ তত বিভ্রান্ত হবে।

আর গণমাধ্যমের নীতি-নির্ধারকদের প্রতি অনুরোধ—এখন চলছে মহামারি। এখন আপৎকালীন সাংবাদিকতার যুগ। এই ক্রান্তিকালে অন্তত কাটতি-হিট নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা না করাই শ্রেয়। নিজের, পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের—সর্বোপরি পুরো মানবজাতির মঙ্গলের স্বার্থেই যুগের হুজুগে না মেতে দায়িত্বশীল হতে হবে। এখন প্রতিযোগিতার সময় নয়, পেশাদারিত্বের ক্রান্তিকাল। সুতরাং তথাকথিত পারফরমেন্সের চেয়ে, সততা-নিষ্ঠা-দয়া-বস্তুনিষ্ঠতাকে গুরুত্ব দিতে হবে।

কারণ, গণমাধ্যমকে মনে রাখতে হবে, রুচিগঠন ও রুচির জোগান দেওয়া, দুটোই তাদের হাতে। তারা রুচি গঠন করবে, না রুচির জোগান দেবে—সেই সিদ্ধান্ত নিজেদেরই নিতে হবে। বিকৃত রুচির জোগান দিলে সাময়িক কাটতি-হিট বাড়বে হয়তো। কিন্তু মহাকাল তাদের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলবে। আর যদি সুরুচির জোগান দেওয়ার পাশাপাশি নতুন রুচি গড়ে তুলতে পারে, তাহলে তারা নিজেরাই একদিন কালের স্রষ্টা হয়ে উঠবে। কেউ তাদের কালের কাঠগড়ায় তুলবে না। তারাই সময়কে শাসন করবে।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী
ইমেইল: [email protected]



ঢাকা/এনই/নাসিম 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়