ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

করোনাকালে মধ্যবিত্তের সংকট

রিয়াজুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫৬, ৭ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনাকালে মধ্যবিত্তের সংকট

মধ্যবিত্ত বলতে কাদের বোঝায়? অনেকের মতে, যারা মাসিক বেতনের ভিত্তিতে কাজ করে, যাদের আয় নির্ধারিত, যাদের বেতনের বাইরে কোনো আয় নেই তারা মধ্যবিত্ত। সহজ কথায়, মধ্যবিত্তরা দারিদ্র্যসীমার উপরে বসবাস করে কিন্তু তারা উচ্চবিত্ত নয়। দেশের উন্নতির সঙ্গে আমাদের দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যাও বাড়ছে। বিআইডিএস-এর গবেষণা মতে, ১৯৯১ সালে মধ্যবিত্তের হার ছিল ৯ শতাংশ। বর্তমানে এই হার ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালে মধ্যবিত্তের হার হবে ২৫ শতাংশ এবং ২০৩০ সালে এই হার হবে ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ মধ্যবিত্তের হার ক্রমবর্ধমান।

মধ্যবিত্তের মোটামুটিভাবে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন: এরা শিক্ষিত, রুচিশীল এবং মননশীল। আত্মসম্মান বোধ থাকে।  অভাব-অনটনের বিষয়ে মুখ বুজে সহ্য করেন, তবু কারো কাছে হাত পাততে পারেন না। বিত্তবান কিংবা বিত্তহীনদের মতো যে কোনো কাজও করতে পারেন না। সমাজ কী বলবে, এই নিয়ে তারা চিন্তিত থাকেন। এরা সৃজনশীল ভূমিকা পালন করেন (যেমন শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, ইত্যাদি)।

উপরের বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে উচ্চবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের মানুষের যে কোনো মিল নেই, সেটা বলা যাবে না। এবার মূল কথায় আসা যাক। বর্তমান বিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের কারণে সবাই মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত। প্রধানমন্ত্রী, রানী, রাজপুত্র, মন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ; বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃতের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃত্যু এখন কত সহজ হয়ে গেছে! করোনায় আক্রান্ত হয়ে আপনজন মারা গেলে লাশটা ফেলে সবাই চলে যাচ্ছে। জানাজায় কিংবা সৎকারে কেউ থাকছে না। সবার মধ্যে এক অদৃশ্য ভাইরাসের ভয়। আমাদের দেশেও ২৬ মার্চ থেকে জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ব্যতীত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

করোনাকালের এই সময় উচ্চবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের তুলনায় সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী মধ্যবিত্ত। কারণ তাদের সীমিত আয়। খরচ বেড়ে যাওয়ার একটা বিষয় থাকে। বাড়িভাড়া, বাচ্চাদের শিক্ষাবাবদ খরচ, ওষুধ খরচ, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল, মাসিক ডিপিএস ইত্যাদি খরচ বাদ দিয়ে যে টাকা অবশিষ্ট থাকে, সেই টাকা তারা দৈনন্দিন নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর জন্য ব্যয় করে। অর্থাৎ কোন খাতে তারা কত ব্যয় করবে সেটা মাসের শুরু থেকেই নির্ধারিত। যদি কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারে মাসের ২৫ তারিখের পর বাকিতে পণ্য কিনতে হয়, তাহলে তার সারা বছরই সেই ধার চলতে থাকে। যদি কোনো মাসে বাচ্চার লেখাপড়ার খরচ বেড়ে যায় কিংবা ওষুধের জন্য খরচ বেড়ে যায়, তবে সেই মাসে খাবারের জন্য কিছুটা কম খরচ করতে হয়। আয় নির্দিষ্ট হওয়ার কারণে হিসাব নিকাশ যা করার, খাদ্যের খরচের উপরই করতে হয়। যদি বাড়ি ভাড়া বেড়ে যায়, পরের মাস থেকে খাবারের মান একটু কমে যায়, যতদিন না পর্যন্ত বেতন বাড়ে। এই হচ্ছে মধ্যবিত্তের অবস্থা। কোনো দিকে যদি খরচ বেড়ে যায়, তাহলে তার প্রভাব পড়ে দিনের খাদ্য তালিকার উপর। মধ্যবিত্তের আরেক নাম যেন স্যাক্রিফাইস।

উচ্চবিত্ত মানুষের টাকার অভাব নেই। সারা মাসে হয়ত ২০ কেজি চাল লাগবে, ২০০ কেজি চাল কিনে রাখলো। যতটুকু ডাল, আলু, তেল, লবণ দরকার, তারচেয়েও বেশি কিনে রাখে। দরকার নাই, তারপরেও কিনে রাখে। গত মাসে হ্যান্ড সেনিটাইজার, মাস্ক বাজারে সংকট ছিল। অনেকেই অতিরিক্ত কিনে বাসায় রেখেছে। ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের অনেক ব্যবসায়ী এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। যদি কোনো পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়, সাথে সাথে তার মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় গুজব তৈরি করেও মূল্য বাড়ানো হয়। ৪০ টাকা কেজি দরের চাল একদিন পর হয়ে যায় ৪৮/৫০ টাকা। মধ্যবিত্ত পরিবার চাইলেই কিন্তু বেশি পরিমাণে কিনে রাখতে পারে না। কারণ তার আয় নির্দিষ্ট আর কোথায় কী খরচ করবে, সেটা আগে থেকেই নির্ধারিত। যে কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর দাম বেড়ে গেলে, তাদের খাদ্যের তালিকা কিংবা পরিমাণ বিবেচনা করতে হয়। হয়ত আগে সপ্তাহে চারদিন দুপুরে মাছ খেত, এখন দুইদিন খাচ্ছে। সয়াবিনের পরিবর্তে পামওয়েল কিনছে। আগে সকাল বেলা পরিবারের চার সদস্য চারটি ডিম খেত, এখন দুটি ডিম ভাগ করে চারজন খাচ্ছে। মধ্যবিত্তরা চাইলেই বাচ্চার টিউশনি বন্ধ করে দিতে পারে না, গ্রামে বাবা-মায়ের কাছে টাকা পাঠানো বন্ধ করতে পারে না। কারো কাছে হাত পাততে পারে না। পারে শুধু খাদ্য তালিকা পরিবর্তন করে জীবনমান পরিচালনা করতে পারে। সরকারের টিসিবি থাকাতে কিছুটা স্বস্তি। কিন্তু সেখানেও অনেক সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আগেই বলেছি, দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে কেনা, এটা অনেকের জন্যই আবার স্বস্তিদায়ক নয়। আমাদেরই সমাজে কিছু মানুষ আছে যারা টিসিবি থেকে পণ্য কিনে খুচরা বাজারে বিক্রি করে।

আর নিম্নবিত্তের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে ছোট একটা ঘটনা ব্যাখ্যা করি। আমার এক ব্যাচমেট শাহাদাত হোসেন। মোবাইলে ওর সাথে কথা হচ্ছিল। করোনাকালের এই সময়ে অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনার সুযোগ ছিল না। ও জানাল, মার্চের ৩১ তারিখ কাজের বুয়াকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। তারপরেও সকালবেলা কাজের বুয়া বাসায় হাজির। আমি বললাম, সমস্যা কোথায়? শাহাদাত জানাল, সে এসেছে মূলত ত্রাণের চাল, আলু আর পিঁয়াজ বিক্রি করার জন্য। হিসাবটা খুব সহজ। কাজের বুয়া বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ত্রাণের চাল, ডাল, লবণ, পিঁয়াজ পেয়েছে। তার জামাই পেয়েছে, ছেলেও পেয়েছে। এখন এত খাবার ঘরে রেখে কী করবে? যদি আমরা কিছু কিনি, তাই বিক্রি করতে এসেছে। দামও কম রাখবে, সেই আশ্বাসও দিয়েছে।

করোনাকালে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসমূহের দাম যেন বেড়ে না যায়, সেটা সবার আগে বিবেচনায় আনতে হবে। সরকার এই বিষয়ে অনেক কঠোর। মূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর হিসাব করে খরচ করতে সুবিধা হবে। এরা ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরে গেলেও হাত পাততে জানে না। ভালো নাই- মধ্যবিত্তরা এটা বলতে শেখে নাই। এদের জীবনের সব মায়া থাকে কর্মের উপর। জীবনের অর্জিত সব সার্টিফিকেটগুলো এদরে আত্মসম্মানে বলীয়ান করে তোলে।

মধ্যবিত্তদের কীভাবে খরচ করা উচিত, সেটা পরামর্শ দেওয়া বোকামি। কারণ এদের মতো হিসেবি জীবন কেউ পার করে না। শিক্ষিত হবার কারণে এরা ভবিষ্যত নিয়েও শঙ্কিত থাকে। কিছু সঞ্চয়ের চেষ্টা করে। একটা টাকাও এরা অহেতুক অপব্যয় করতে পারে না। মধ্যবিত্তরা কিন্তু সাহায্য চায় না। বৈশ্বিক মহামারির এই সময়, তারা চায় পণ্য বা সেবার মূল্য নিয়ন্ত্রণ। মধ্যবিত্তরা যে নির্ধারিত টাকা আয় করেন,তার মধ্যেই তাদের সাধারণ জীবিকা চালিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু মূল্য যদি হঠাৎ করে বেড়ে যায়, তখন তাদের সেই পণ্যের চাহিদা থাকলেও খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হয়। পিঁয়াজের দামের সময়ও এমনটা আমরা দেখেছি। কেউ কেউ পিঁয়াজ বাদ দিতে না পারলেও এক কেজি পিঁয়াজ দিয়ে এক মাসও চালিয়েছেন।

কয়েকদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা গুজব ছড়ানো হলো, দুই/তিন মাস বাড়ি ভাড়া মওকুফ করা হয়েছে। এই ধরনের  গুজব আসলেই ভালো না। আমি অনেক রিটায়ার্ড মানুষকে চিনি, যারা তাদের সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে একটা তিন/চার তলা বাড়ি করেছেন। সেটাই তাদের একমাত্র আয়ের উৎস। আবার অনেক চাকরিজীবী আছেন, যারা ঋণের টাকায় বাড়ি করেছেন। বেতন থেকে তাদের কিস্তি দিতে হয়। অনেকের কিস্তির টাকা পরিশোধের পর বেতন হয় না। তখন বাড়ি ভাড়ার টাকাই তাদের সংসার চালানোর মাধ্যম। তবে বিত্তশালী কোনো ব্যক্তিবর্গ যদি ইচ্ছা করে ভাড়াটিয়াদের বাড়িভাড়া মওকুফ করে থাকেন, সেটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক।

মধ্যবিত্তের শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান, রাজনৈতিক সচেতনতা রয়েছে।  মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগ আমাদের মধ্যবিত্ত। হঠাৎ আসা করোনার মতো বিপর্যয় মোকাবিলায় আমাদের মধ্যবিত্তরা একেবারেই অপ্রস্তুত। তাদের সীমিত আয়, যা দিয়ে কেবল মৌলিক চাহিদাগুলোই পূরণ সম্ভব। এখানে বিলাসিতার সুযোগ নাই। মধ্যবিত্তের আয় নির্দিষ্ট হওয়ার কারণে হিসাব সবসময় সমন্বয় করে চলতে হয়। সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, প্রয়োজনীয় কোনো কিছুর সংকট নাই। তাই কোনো ধরনের  কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে পণ্যে বা সেবার মূল্য যেন বৃদ্ধি না পায়, সেটা অবশ্যই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। কারণ নিত্য পয়োজনীয় পণ্যের মূল্য হঠাৎ করে বৃদ্ধি পেলে, আয় ব্যয়ের হিসাবে সমন্বয় করতে কষ্ট হবে, যা অবশ্যই কাম্য নয়। 

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়