ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ইতিবাচক আলোচনায় বাজেট ২০২০-২১

মোস্তফা মোরশেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ১৬ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
ইতিবাচক আলোচনায় বাজেট ২০২০-২১

বাজেট শুধু কিছু গাণিতিক সংখ্যা নয় বরং একটি দেশের আগামী দিনের স্বপ্নের প্রতিফলন। ১৯৭১ সালে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেবার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত আমাদের জাতির অর্থনৈতিক দিক নির্দেশনা দেবার কোনো লিখিত দলিল ছিল না। ২০০৮ সালে বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে জাতির জন্য প্রথম কোনো লিখিত স্বপ্ন নিয়ে আসে। সে বাস্তবতায় সরকার রূপকল্প-২০২১ এর পথ ধরে রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। এর আলোকে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাও তৈরি করা হয়েছে। প্রতি বছরের বাজেট হলো এ ধরনের পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদে ২০৪১-এ ‘উন্নত বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে ক্ষুদ্রতম সময়ের একক। তাই বাৎসরিক বাজেট একটি দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্ব বহন করে।

বিগত দিনে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের গতি ও মাত্রা বিশ্বের কাছে অনন্য উদাহরণ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। কিন্তু কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারির প্রকোপে সবকিছুই আবার নতুন করে লিখতে হবে। বাজেট ২০২০-২১ ও এর ব্যতিক্রম নয়। করোনাভাইরাসের নানামুখী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। ইতোমধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি হার ৮.২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫.২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে যা ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার গড় প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাধা হতে পারে। এছাড়া কৃষি থেকে শিল্পখাতে শ্রমিক স্থানান্তর করে শিল্প ও ম্যানুফেকচারিং খাতে মোট শ্রমিকের পরিমাণ ৪০ শতাংশে উন্নীত করে সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর যে লক্ষ্য ছিল সেটিও হুমকির মুখে পড়তে পারে।

বাজেট নিয়ে যেসব আলোচনা হয়েছে তাতে সচেতন পাঠকগণ ইতোমধ্যে জেনে গিয়েছেন কীভাবে কোথায় কত টাকা খরচ বা আয় হবে। বাজেট কত বড় হতে পারে এবং সে হিসেবে ঘাটতি কত হবে, উন্নয়ন বাজেটের অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন কীভাবে হবে এসব নিয়ে অর্থনীতিবিদগণের মধ্যে মতের পার্থক্য হতেই পারে। এর সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। বাজেট শুধু জাতির স্বপ্নই নয় বরং রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছারও একটি প্রতিফলন। তাই মতের পার্থক্য অপ্রত্যাশিত নয়। এছাড়া অর্থনীতির পর্যালোচনা এতটা সহজ নয়। যে কোনো একটি চলকের পরিবর্তনের ফলে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হতে পারে। তাই সমষ্টিক অর্থনীতিতে ভিন্ন মতের অবস্থান দেখা যায়। যেমন, কোভিড-১৯ এর এ সময়ে কেউ কেউ (যেমন, নোবেলজয়ী অভিজিত ব্যানার্জি) বলছেন, টাকা ছাপিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। আবার কেউ এ আহ্বানকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০২০-২১ এর বাজেট নিয়ে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলোসহ ইতিবাচক আলোচনা করতে চাই।

বলতে দ্বিধা নেই, ২০০৮ সালের গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিসের পর বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় কোভিড-১৯ নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এর প্রধান কারণ সেসময় শুধু ফাইনান্সিয়াল মার্কেটে বিপর্যয় হয়েছিল কিন্তু এবারের বিপদ একইসাথে অর্থনৈতিক ও মানবিক। শুধু অর্থনীতি নয় বরং মানুষের জীবন ও জীবনঘনিষ্ঠ সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তা সহসাই কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়। আইএমএফ-এর মতো অনেকেই বলছেন, এটি ১৯৩০ সালের মহামন্দার মতোই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্ম দিবে। সবচেয়ে বড় কথা, এ ভাইরাস সার্স, মার্স কিংবা ইবোলা ভাইরাসের মতো নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশ বা অঞ্চলে সংক্রমিত হয়নি। বরং উচ্চ আয়ের দেশে করোনাভাইরাসের তাণ্ডব অনেক বেশি যা বিশ্ব অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সার্বিকভাবে বড় অর্থনীতির দেশসমূহে স্ট্যাগফ্লেশন হতে পারে যেখানে দ্রব্য ও সেবার দাম বাড়বে কিন্তু উৎপাদন স্থির থাকবে বা কমে আসতে পারে। এরকম হলে সকল আয়ের দেশকেই ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। এ ঋণাত্মক পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তা ধারণা করা সহজ নয়। করোনাভাইরাসের প্রকোপ কতদিন থাকবে, প্রতিষেধক কবে আবিস্কার হবে, এর সহজলভ্যতা কী হবে ইত্যাদি অনেক প্রশ্নের উত্তরের সাথে আগামীর অর্থনীতির সম্পৃক্ততা রয়েছে। আর এসব অনিশ্চয়তা ও ক্ষেত্রবিশেষে একমুখী তথ্য প্রবাহের (asymmetric information) কারণে বৈশ্বিক উৎপাদন কমে আসা শুধু সময়ের ব্যাপার।

বাজেট আলোচনায় বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অধ্যায় হলো প্রবৃদ্ধি। বিভিন্ন সংস্থা (বিশ্বব্যাংক, ওইসিডি, আইএমএফ, এডিবি, ইত্যাদি) বিভিন্নভাবে প্রবৃদ্ধির হিসাব করে থাকে। মার্চ ২০২০-এ প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে জাতিসংঘ বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক জিডিপি ৩.২ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাবে যার মূল্য অন্তত ৮.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর যদি দ্বিতীয় মেয়াদে এ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয় তবে প্রবৃদ্ধি ৩.২ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। এরকম হলে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। ২০১৯-২০ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের প্রবৃদ্ধি কতই বা হতে পারে! পৃথিবীর দেশসমূহের অনিবার্য অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ও সংযোগের কারণে কোনো দেশের আয় হ্রাসের ফলে চাহিদা কমে গেলে অন্য দেশের আয় কমে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমে আসবে। পরিসংখ্যান বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। রেমিটেন্স প্রবাহ ও রপ্তানি কমে যাবার কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধি যে কমবে তা নিশ্চিত তবে কতটুকু ঠেকানো যাবে সেটিই মুন্সিয়ানার বিষয়।

প্রবৃদ্ধি কমে যাবার অনেক কারণের মধ্যে যেটি মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত সেটি হলো আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে মোট চাহিদার ঘাটতি। মূলত চাহিদার ঘাটতির কারণেই মন্দা বা মহামন্দা হয়ে থাকে। মন্দার একটি কারণ উল্লেখ করলে সেটি হবে ‘সার্বিক চাহিদা হ্রাস’। আর একটি চলক দ্বারা মন্দা পরিমাপ করতে চাইলে সেটি হবে ‘বেকারত্বের হার’। করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সার্বিক চাহিদা কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও চাহিদা কমে যাবার হাজারো উদাহরণ দেয়া যাবে। শুধু বিমান চলাচল কমে যাবার ফলে আকাশপথের যাত্রীদের সরবরাহকৃত খাবারের চাহিদা কমেছে। ফলে এর সাথে যুক্ত ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের আয় কমেছে। কিংবা খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ হবার কারণে কত লোকের যে আয় কমেছে তার হিসাব পাওয়া কঠিন। সহজ সমীকরণ দিয়ে এ হিসাব করা অসম্ভব কারণ এ সকল অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সঠিক ও পরিপূর্ণ তথ্য নেই। তাছাড়া এ সকল কর্মসংস্থানের বড় রকমের একটি মাল্টিপ্লায়ার প্রভাব রয়েছে। একটি কর্মসংস্থান নষ্ট হলে এর পরোক্ষ প্রভাব হিসেবে অনেক লোকের কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বাজেটের আকার নিয়ে অনেক কথা হয়। আমাদের অর্থনীতির যে আকার ও গতি তাতে কর-জিডিপি অনুপাত অন্তত ২০ শতাংশে উন্নীত করা আবশ্যক। এতে দুটি লাভ হতো। এক: আয়ের বৈষম্য কমে উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নেয়া যেত। দুই: উন্নয়ন ব্যয়ে জনগণের অংশগ্রহণ, অংশীদারিত্ব ও স্বত্ব বাড়ত। তথাপি কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য আগ্রাসন থেকে মানুষকে বাঁচাতে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ বছর পর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদিও অনেকে এভাবে বলতে চাচ্ছেন, আয়ের সীমা (income slab) সংকুচিত করা হয়েছে। কিন্তু এর ইতিবাচক প্রভাবই বেশি। কারণ নিম্ন আয়ের মানুষকে উচ্চ আয়ের মানুষের চেয়ে কম কর দিতে হবে। ফলে আয়ের বৈষম্য কমার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এছাড়া শিল্পের করপোরেট করও কমানো হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ উৎসের সবচেয়ে বড় খাত হলো ব্যাংকিং খাত। এ থেকে সরকার ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করেছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা নেবার পরিকল্পনা রয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে, ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নের জন্য ব্যাংকের উপর নির্ভরশীলতার দুটি প্রভাব দেখা যায়। প্রথমতঃ ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবাহ হ্রাস পেয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে যা অর্থনীতির ভাষায় ‘ক্রাউডিং আউট’ নামে পরিচিত। কিন্তু বিগত সময়ে ব্যাংকখাত থেকে ঋণ নেয়ার পরও এরকম প্রভাব দেখা যায়নি। কারণ ব্যাংকের তারল্যের অবস্থা ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের একটি মাপকাঠি হলেও ‘একমাত্র’ নয়। ফলে ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন নিয়ে খুব একটা শঙ্কিত হবার কিছু নেই। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত ৩০ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি নগদ তারল্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। এছাড়া রিজার্ভ রয়েছে আরো ৬২ হাজার কোটি টাকা। প্রণোদনা বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রি-ফাইন্যান্স হিসাবে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এছাড়া সিআরআর (ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ) ছাড় দেয়ার ফলে ১৮ হাজার কোটি টাকা সহযোগিতা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে কোনো সমস্যা হবে না বলেই প্রতীয়মান। সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে সাত হাজার ৬৭৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৫ শতাংশ কম। কিন্তু দুই-ডিজিটের বেশি সুদ দিতে হলেও এবার সঞ্চয়পত্রের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্দেশ্য থাকলেও কোভিড-১৯ এর কারণে তা পুনরায় বিবেচনা করতে হচ্ছে।

দ্বিতীয়তঃ ঘাটতি বাজেটের ফলে মুদ্রাস্ফীতি হতে পারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি ৫.৪৬ শতাংশের বিপরীতে ২০২০-২১ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৫.৪ শতাংশ যা গ্রহণযোগ্য। বাজেটের আকার আরও বড় হলেও যে পরিমাণ মুদ্রাস্ফীতি হত তা সাম্প্রতিকসময়ে আমাদের শক্তিশালী অর্থনীতির জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারবে না। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, রাজস্বখাত বিবেচনায় আমাদের সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তাই খুব অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু না ঘটলে মুদ্রাস্ফীতির ফলে অর্থনীতির বড় ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই।

পৃথিবীজুড়ে নভেম্বর ২০১৯ থেকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাসের আলোচনা চলছে। জাতীয় বাজেটেও এর প্রতিফলন হয়েছে অনেকখানি। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ইতোমধ্যে জরুরি স্বাস্থ্যখাতের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ১ লক্ষ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। ৫০ লক্ষ শ্রমিকের কর্মক্ষেত্র পোশাক শিল্পে ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। শিল্প ও সার্ভিস খাতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে ৩০ হাজার কোটি টাকার স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ দেবার বিধান রাখা হয়েছে। ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি এর আওতায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক এক্সপোর্ট ডেভেলাপমেন্ট ফান্ডের বরাদ্দ ৩.৫ বিলিয়ন ডলার হতে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছে।

বাজেটে কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় চারটি কৌশলের কথা বলা হয়েছে। এক: সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেয়া ও বিলাসবহুল ব্যয় পরিহার। দুই: ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে শিল্প ও ব্যবসার জন্য রেয়াতি সুদে ঋণ প্রদান। তিন: হতদরিদ্র, কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিতদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণ। চার: পরিকল্পিত মুদ্রা সরবরাহ যাতে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখা যায়। এ চারটি কৌশল যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তবে ইতিহাসের পাতায় এ বাজেট আগামী দিনের জন্য রেফারেন্স হয়ে থাকবে।

এবারের বাজেটের সাফল্যের সবচেয়ে বড় জায়গা হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ ও গৃহীত উদ্যোগ। যদিও এ বরাদ্দ আরও বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ৮১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বিপরীতে এ খাতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে যা মোট বাজেটের ১৬.৮৩ শতাংশ এবং মোট জিডিপি’র ৩.০১ শতাংশ। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। এখানে একটি বিষয় গভীরভাবে অনুধাবন করা দরকার। কর আদায় হোক আর সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দই হোক আমাদের এখন সকল আয়ের মানুষের আর্থিক সব ধরণের লেনদেনের জন্য ‘একক হিসাব’ (single account) থাকা দরকার। আর্থিক অব্যবস্থাপনা রোধ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে জন্য এর আবশ্যিকতা রয়েছে। সবার জন্য আলাদা ‘একক হিসাব’ থাকলে যে কোন প্রান্ত থেকে সম্পদ স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া অনেক সহজ হবে। এছাড়া ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেও দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য একক হিসাব পরিচালনার মাধ্যমে সম্পদ স্থানান্তরের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য একটি প্রকল্প তৈরি করে তা দ্রুততার সাথে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করছি।

বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবা খাতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১৯,৯৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও আশানুরূপভাবে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে তা ২২,৮৮৪ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে, গত বছরের তুলনায় শিক্ষা খাতের বরাদ্দ খুব বেশি হয়নি। তবে সরকারকে এজন্য ধন্যবাদ দিতে হবে যে স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি খাতের গবেষণায় ১০০ কোটি টাকার ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কার্যত উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।

কৃষিখাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এর বিপরীতে প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তবে ভর্তুকি বৃদ্ধিসহ এ খাতে অধিক বরাদ্দ দেবার অবকাশ রয়েছে। একটি বিষয় খুব পরিষ্কার। করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে বিশ্বব্যাপী শিল্প ও ম্যানুফেকচারিং খাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং খুব তাড়াতাড়ি এ থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা নেই। এর বিপরীতে কৃষিখাতই অনেক বেশি শক্তিশালী ও টেকসই আচরণ করেছে। শুধু মানুষের খাবার ও পুষ্টি সরবরাহের জন্য নয় আগামী দিনে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কৃষিকে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের শুরু থেকে এ সময় পর্যন্ত শিল্প-কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে এবং আগামী অনির্দিষ্ট কালের জন্য তা অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, আমাদের কৃষি উৎপাদন থেমে নেই।

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে কৃষি পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটতে পারে। সে বাস্তবতায় বিশ্বব্যাপী লক-ডাউন পরবর্তী সময়ে আমাদের কৃষি পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কৃষিখাতে বরাদ্দ যুক্তিসঙ্গতভাবে আরও বাড়ানোর বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। এছাড়া কৃষিখাতে আমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত স্বাভাবিক দক্ষতা রয়েছে। ফলে সামান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ খাতের প্রবৃদ্ধি অনেক বাড়ানো সম্ভব।

বাজেট বাস্তবায়নের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করা, প্রকল্প বাস্তবায়নসহ অন্যান্য খাতে টাকা খরচ করার গুণগত মান বৃদ্ধি, ইত্যাদি অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও বাংলাদেশের মানুষের ঘাত সহ্য করার যে অকৃত্রিম ক্ষমতা রয়েছে তা নিশ্চয়ই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। আমি বিশ্বাস করি, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শেষ হয়ে আসলে আমাদের অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে মাস-দুয়েকের বেশি সময় লাগবে না। তবে সে পর্যন্ত বৈশ্বিক বিপর্যয় বৈশ্বিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে।

লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতি গবেষক


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়