ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

চলচ্চিত্রে ‘বাবা’ আজ গুরুত্বহীন 

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৫, ২০ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
চলচ্চিত্রে ‘বাবা’ আজ গুরুত্বহীন 

আজ বিশ্ব বাবা দিবস। বাবার জন্য সন্তানের মনে শ্রদ্ধাবোধ সবসময় না থাকলেও, বাবার মনে সন্তানের জন্য মমতা সব অবস্থাতেই থাকে। বিশেষ এই দিনটিতে পৃথিবীর সব বাবাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। বাবা দিবস নিয়ে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ করেই আমার চলচ্চিত্রের পর্দায় বাবা চরিত্রটির কথা মনে পড়ল। সমাজে, পরিবারে বাবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। প্রতিটি সন্তানের মাথার ওপর বাবা বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে থাকেন। তারপরও এ দেশে ‘বাবা কেন চাকর’ নামে সিনেমা তৈরি হয়। এবং এই সমাজের দর্শক সেই সিনেমা লুফে নেন। অবশ্য সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। 

আমার বলার একটি উদ্দেশ্য হলো, সিনেমার পর্দা থেকে বাবা চরিত্রটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। 

সমাজের বাস্তব চিত্র রুপালি পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হয়। ‘সন্তান যখন শত্রু’, ‘পিতা মাতা সন্তান’, ‘মা যখন বিচারক’, ‘পিতার আসন’, ‘চাচ্চু’ শিরোনামের সিনেমাগুলোর নাম মনে হলে সিনেমার চরিত্রগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এতে নায়ক-নায়িকা যতটা না মনে দাগ কেটেছে, তার চেয়ে বাবা-মার চরিত্রগুলো বেশি দাগ কেটেছে। এখন আর এমন দেখা যায় না। বিগত কয়েক বছর পারিবারিক গল্পের উপর কোনো সিনেমাই নির্মাণ করা হয়নি। নায়ক-নায়িকা নির্ভর এ সব সিনেমায় বাবা বা মা চরিত্রটি যেন অসহায়। কিছু সিনেমায় বাবা-মা’র চরিত্র থাকলেও তা দু’একটি শটেই শেষ করে দেওয়া হয়। সেখানে বাবা গৌন। অনেক সময় তাদের কোনো ডায়ালগও থাকে না। অর্থাৎ পর্দায় বাবার চরিত্রটি গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। 

এক সময় সামাজিক-পারিবারিক গল্পনির্ভর সিনেমায় মুগ্ধ হয়েছেন এদেশের সিনেমাপ্রেমীরা। বাবাকে কেন্দ্র করে সিনেমার পুরো গল্প শেষ হয়েছে, এমন জনপ্রিয় অনেক সিনেমা রয়েছে। চলচ্চিত্রে আজ আর সেই সোনালি যুগ নেই, কেবলই এখন তা স্মৃতি। একজন নির্মাতা তার পছন্দ অনুয়ায়ী গল্প বাছাই করেন। নিজের মতাদর্শ নিয়ে সিনেমা তৈরি করতে পারেন বর্তমান সময়ে এমন নির্মাতা আছেন কজন? তাদের সময় বুঝেই চলতে হয়। প্রযোজকের লগ্নীকৃত অর্থ কীভাবে উঠে আসবে সেকথাও ভাবতে হয়। তাহলে কি আমাদের ধরে নিতে হবে বাবারা সমাজ থেকে, পরিবার থেকে গুরুত্ব হারিয়েছেন? নইলে এই সময়ের সিনেমায় বাবার গুরুত্ব নেই কেন?

পরিচালক সিনেমা নির্মাণের জন্য গল্প, স্ক্রিপ্ট রেডি করে প্রথমে বসেন প্রযোজকের সঙ্গে। প্রযোজক সিনেমার গল্প শোনেন। এরপর যখন বাজেটের কথা বলা হয় তখনই সিনেমার চরিত্রের উপর ছুড়ি চালানো হয়। আর প্রথম ছুড়িটাই যেন বাবার গলায় চালানো হয়। কারণ গল্পের প্রয়োজনে বাবার চরিত্রে ভালো কোনো শিল্পী নিতে গেলে তার পারিশ্রমিকটাও বেশ চড়া। এছাড়া ধরুন সোহেল রানা, ফারুক, ইলিয়াস কাঞ্চন, প্রবির মিত্র অথবা আবুল হায়াতকে কোনো চরিত্রের জন্য নেওয়া হলো। তারা কি দু’এক শটের জন্য অভিনয় করবেন? তাদের চরিত্রেরও গুরত্ব থাকতে হবে। বাধ্য হয়ে নির্মাতা এসব চরিত্র সংক্ষিপ্ত করে নামেমাত্র কোনো শিল্পীকে নেন। এসব শিল্পী দু’একটা শট দিয়েই শেষ।

এবার নির্মাতার দ্বিতীয় মিটিং নায়কের সঙ্গে। নায়ক গল্পের দিকে তাকানোর আগে দেখেন পর্দায় তার উপস্থিতি কতটুকু। নায়ককে সন্তুষ্ট করতে অন্যান্য চরিত্র কমিয়ে নায়কের চরিত্রের গুরুত্ব বাড়ানো হয়। এরপরের মিটিং নায়িকার সঙ্গে। নায়িকা আগেই দেখেন অন্য কোনো নায়িকা আছে কিনা? এরপর নজর দেন নায়কের গুরুত্ব কেমন? নায়করে মত নায়িকারও গুরুত্ব দেয়া চাই-ই চাই। পরিচালক তাদের মন রক্ষা করতে তখন নিজের মতাদর্শ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। এভাবেই গল্পেরও বারোটা বেজে যায়। পর্দায় দর্শক শুধু নায়ক-নায়িকাকে দেখেন বাকি চরিত্রের কোনো গুরুত্ব থাকে না।

ঢাকাই চলচ্চিত্র বর্তমান সময়ে নায়িকা প্রযোজক নিয়ে আসেন। তখন নায়িকার মর্জির উপর নির্ভর করতে হয় নির্মাতাকে। গল্পের প্রয়োজন থাক আর না থাক নায়িকার চাহিদা অনুযায়ী চার থেকে পাঁচটি গান থাকতেই হবে। এসব কারণে বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্র নাজুক অবস্থা পার করছে। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো একটার পর একটা ব্যবসায়ীকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে। এসব সিনেমার গল্পগুলো শুধু নায়ক-নায়িকাকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হচ্ছে। পুরো সিনেমায় একজন নায়ক আর একজন নায়িকাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খায়। তাদের প্রেম-বিরহকে কেন্দ্র করে সিনেমার গল্প এগিয়ে যায়। এসব সিনেমার গল্প ও সংলাপ প্রায় একইরকম। দর্শক এ ধরনের সিনেমা দেখে নাক সিটকান।

ঢাকাই সিনেমায় এখন আর পারিবারিক গল্প দেখা যায় না। বাবা-মাকে কেন্দ্র করে কোনো সিনেমা নির্মাণ হয় না। অথবা শুধু বাবা বা মাকে কেন্দ্র করেও সিনেমা নির্মিত হয় না। যা সোনালি যুগে দেখা যেত। সোনালি যুগের সিনেমায় বাবা-মা অথবা পরিবারের একটা গান থাকত। এখন তাদের সংলাপ বলার জায়গাটা খুব অল্প। গান তো অনেক পরের কথা। এখন নায়ক-নায়িকার তিনটি রোমান্টিক গান একটি স্যাড গান আর কারণ ছাড়াই একটি আইটেম গান দিয়ে পুরো সিনেমা শেষ করা হয়।

সোহেল রানা, ফারুক, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো গুণী শিল্পীদের আজ আর চলচ্চিত্রের পর্দায় দেখা যায় না। হঠাৎ করেই চলচ্চিত্র থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন পর্দা কাঁপানো এ শিল্পীরা। এছাড়া অনেক গুণী শিল্পী চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তাদের শূন্য স্থান আজও চলচ্চিত্রে পূরণ হয়নি। পর্দায় বাবার চরিত্রের গুরত্ব না দেওয়ায় এসব শিল্পী ধীরে ধীরে দূরে সরে গেছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে বাবার রোলে অভিনয়ের জন্য এখন আর ভালো অভিনেতাকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। 

সামাজিক-পারিবারিক নিজের শেকরের গল্প এখনও দর্শক দেখতে চায়। গতানুগতিক ধারার ছবি দর্শক আর দেখতে চায় না। পর্দায় ফিরে আসুক বাবার চরিত্র। নায়ক-নায়িকার পাশাপাশি অন্যান্য চরিত্রের গুরুত্ব দেওয়া হোক। ফিরে আসুক চলচ্চিত্রের সোনালী অধ্যায়।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়