ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ছাত্র নেতাদের লোভ লালসার উর্ধ্বে থাকতে হবে

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৪, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছাত্র নেতাদের লোভ লালসার উর্ধ্বে থাকতে হবে

মাছুম বিল্লাহ: চাঁদাবাজিসহ নানান অভিযোগে ব্যাপক সমালোচনার মুখে থাকা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। ২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের সম্মেলন হওয়ার পর ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতিতে শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। সেদিন রাতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাদের নাম ঘোষণা করেন। তারপর দ্রুত সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার কথা থাকলেও প্রায় দশমাস পর ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ছাত্রলীগের একটি অংশ। পদবঞ্চিতরা সে সময় অনশনও করে। পরে শীর্ষ নেতাদের হস্তক্ষেপে তারা শান্ত হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলামের কাছে চাঁদা দাবির গুরুতর অভিযোগ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছিল বেশ ক’দিন থেকে। শোভন ও রাব্বানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ- তারা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশন আদায়ের জন্য চাপ দিয়েছিল। এর বাইরেও তাদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ব্যক্তিদের ছাত্রলীগের কমিটিতে জায়গা দেয়া, অনৈতিক আর্থিক লেনদেন, সম্মেলনের পরও একাধিক শাখায় কমিটি না দেয়া, বিলাসী জীবন, দুপুরের আগে ঘুম থেকে না ওঠা, গণমাধ্যমকর্মীদের এড়িয়ে চলা কিংবা ফোন না ধরা, সংগঠনের একাধিক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েও নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে উপস্থিত হওয়া অথবা অনুপস্থিত থাকা ইত্যাদি অভিযোগ ছিল। এসব নিয়ে সমালোচনামুখর ছিলেন সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের এক সভায় দলের সভাপতি এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন। এরপর থেকেই ছাত্রলীগের দুই নেতার ভবিষ্যত নিয়ে দলে নানান আলোচন শুরু হয়। সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজের কমিশন দাবির অভিযোগটি টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়। জাবির ভিসি উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে টাকা দিয়েছেন, রাব্বানী এমন অভিযোগ করলে, উপাচার্য অস্বীকার করেন। তিনি ছাত্রলীগকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, ‘তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যে, তারা ঠিকাদারের কাছ থেকে কিছু কমিশন নেবে। তারা এ বিষয়ে আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু আমার কাছে এসে তারা হতাশ হয়েছে।’

শোভন ও রাব্বানীর বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। অন্যান্য নেতারাও তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তোলেন। কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে সম্মেলন ছাড়াই শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিরই যোগ্য কাউকে দায়িত্ব দেয়ার দাবি জানান। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত সেরকমই হলো।

এই দুই ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে ফেসবুকেও অনেকে পোস্ট দিয়ে তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। তাছাড়া দেশবাসী তো সাদাচোখে এটা দেখেছেই- ডাকসু ভবনে নিজের কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র লাগিয়েছিলেন রাব্বানী। তিন দশক পর ডাকসু নির্বাচনের পর ছয়মাস পার হতে চললেও প্রকট আবাসন সংকটসহ শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি পূরণে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা না থাকলেও ব্যক্তিগত আরামের জন্য তার এই উদ্যোগ সাধারণের কাছে ভালো লাগেনি।

গত বছর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরদিন থেকে রাব্বানী টয়োটা কোম্পানির নোয়া মডেলের একটি মাইক্রোবাস ব্যবহার করতে শুরু করেন। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- ছাত্রনেতা হওয়া মানে কি অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়া? তাও এত তাড়াতাড়ি? বিশ্ববিদ্যালয়ে তাহলে কি পড়াশোনা, গবেষণা, সাংস্কৃতিক চর্চা, মানবিকতার চর্চা, সুস্থ রাজনীতি শেখা ও চর্চা করা, স্বদেশ প্রেম শেখা ও চর্চা করা এগুলো কিছুই হয় না? সবাই শুধু ছাত্রনেতা হতে চাইবে অথবা ক্যাডার হওয়ার জন্য ক্যাম্পাসে অবস্থান করবে? তাহলে যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা সামাজিক শৃঙ্খলার কী হবে? ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতেরই বা কী হবে? পড়াশোনা করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে-এই আপ্তবাক্য পরবর্তী প্রজন্ম আর বিশ্বাস করবে না। বরং তারা শিখবে ছাত্র রাজনীতি করে যে, গাড়িবাড়ি করে সে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও নেই। কোনো বছরই থাকে না, এবারও নেই। এই সংবাদটি নিয়ে অনেকেই তাদের মন্তব্য ও বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। কিন্তু এটি কি কোনো সংবাদ? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে থাকার  কী কারণ থাকতে পারে? একটি কারণ হতে পারে শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক দিয়ে আর একটি হতে পারে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে এ বিষয়গুলো তো আর বিবেচনায় নেয়া হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কয়টি কার্যকরী গবেষণা হয়? বছরের কতগুলো ক্লাস সঠিকভাবে ও কার্যকরী ক্লাস হয়? কতটা মানসম্মত পড়ালেখা হয়? কর্তৃপক্ষ ব্যস্ত থাকেন সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনকে ম্যানেজ করতে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা হাজারো সমস্যার মধ্যে থাকলেও সেদিকে তারা ভ্রুক্ষেপ করার সময় পান না। হাতে গোনা কিছু শিক্ষক ছাড়া কজন গবেষণা করেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই ব্যস্ত থাকেন সরকারকে খুশী করে একটি পদ বাগানো নিয়ে। সরকারি ছাত্র সংগঠনের সব ধরনের অপকর্মকে শুধু সমর্থন নয়, ধামাচাপা দিয়ে তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখও থাকেন অনেকে। যে দুই ছাত্র নেতাকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সড়িয়ে দিলেন, ৮৬ কোটি টাকা কেন, তাদের বিরুদ্ধে ১০৮৬ কোটি টাকার অভিযোগ উঠলেও কোনো ভিসি কি তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতেন? বলতেন না। মিডিয়ার কারণে এই ঘটনা প্রকাশ পেয়ে যায়। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ায় এখন অনেকেই কথা বলছেন।

ঢাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক মেধাবী সন্তান, দেশ পরিচালনাকরী নেতা, গবেষক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা তৈরি হয়েছে। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আজ কি অবস্থা! ত্রিশ, চল্লিশজন শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে কমন রুমে থাকে। সেই থাকাটুকুও আবার ছাত্রনেতাদের করুণায়। সেই করুণা মেটাতে হয় তাদের কথায় উঠবস করার মধ্য দিয়ে। গভীর রাতে তাদের হুকুমে ঘুম থেকে উঠে যেতে হয় কোনো মিটিং, মিছিল, চিকা মারা, প্রতিপক্ষকে মারা কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এই মেধাবী সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিজেদের কোনো কিছু বলার নেই। তারা ছাত্রনেতা কিংবা ক্যাডারদের হুকুমের গোলাম। বহু মিডিয়া বহুবার তুলে ধরেছে এই করুণ কাহিনি- পরিবর্তন আসেনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বারবার শুধু বলেছে ‘কোনো ধরনের অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে’। আসলে তারা যে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেন না এতদিনে সবাই জেনে গেছে।

বর্তমানে যারা জাতীয় নেতা তাদের অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, ছিলেন ছাত্রনেতা। তাদেরকে আইয়ুব খানের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে স্বাধীনতার আন্দোলন করতে হয়েছিল। তাদের সম্পর্কে শোনা যায় না যে, তারা নিজে আরাম আয়েশের জন্য ছাত্র রাজনীতি করেছেন। বরিশাল বিএম কলেজের এক উপাধ্যক্ষ আমাকে বলেছিলেন, তার রুমমেট রাজনীতি করতেন। কাজেই মিটিং মিছিল করতে হতো বলে অনেক রাতে রুমে ফিরতেন। রুমে ফেরার সময় তিনি সিঁড়ি থেকে জুতো হাতে নিয়ে রুমে ঢুকতেন যাতে অন্য রুমমেটের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। এই হচ্ছে তখনকার নেতাদের আচরণ। আর এখনকার নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর অত্যাচার করে রুম থেকে বের করে দিয়ে তারা রুম দখল করেন। ছাত্র নেতাদের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নেতাদের হতে হবে আদর্শ শিক্ষার্থী, আদর্শ প্রতিনিধি, আদর্শ নেতা। তাদের সব ধরনের লোভ লালসার উর্ধ্বে থাকতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ছায়াতলে যাবেন। তাদের  কাছ থেকে সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সত্যিকারের ভালোবাসা পাবেন, তবেই না তারা ছাত্রনেতা।

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত


ঢাকা/মাছুম বিল্লাহ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়