ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মাদকমুক্ত বরগুনা গড়তে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ

এম. সোলায়মান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৮, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাদকমুক্ত বরগুনা গড়তে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ

বরগুনা আমাদের আবেগ ও অনুভূতির শহর। এখানে বেড়ে ওঠা প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন আলোকিত বরগুনা গড়ার। ছোট্ট এই জেলা দেশের সর্ব দক্ষিণে হওয়ায় এখানকার উন্নয়নব্যবস্থা অন্যান্য জেলার চেয়ে তুলনামূলক কম হলেও প্রকৃতি আর জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে এ জেলার মানুষের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এ অঞ্চলে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের মুখেও দিন শেষে দেখা যায় অমলীন হাসি। পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন একে-অপরের সঙ্গেও রয়েছে গভীর বন্ধন। এখানকার মানুষের আন্তরিকতা আর ভালোবাসার গল্প দেশের অন্যান্য জেলার জন্য হতে পারে উদাহরণসরূপ। বরগুনা শহরের পূর্বে রয়েছে পায়রা নদী ও পশ্চিমে বিষখালী নদী। যেখানে জীবিকা নির্বাহের জন্য হাজার হাজার মানুষ নদীর স্রোতে গা ভাসিয়ে রাখে দিবারাত্রী। এখানে একজন জেলে, কৃষক, দিনমজুর যে স্বপ্ন দেখেন একজন বিত্তশালী ব্যক্তিও একই স্বপ্ন দেখেন। ভালো থাকার স্বপ্ন, দিন শেষে সবার সঙ্গে মন খুলে হাসার স্বপ্ন।

কিন্তু সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে কয়েকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে শান্তির শহর বরগুনা। দিন শেষে সবার হাসির গল্পটা এখন আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। মানুষের মধ্যে সেই আগের মতো উচ্ছ্বাস নেই, নেই ভালো থাকার স্বপ্নটাও।

এর পিছনে রয়েছে মাদকের ভয়াবহতা। বরগুনা জেলার একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, প্যাথেডিনসহ নানা নেশাজাতীয় দ্রব্য। মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসনের কারণে অধিকাংশ পরিবারেই বিপর্যয় নেমে আসছে। দিন দিন বাড়ছে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা। দুঃখজনক হলেও সত্য, বরগুনা শহরে মাদক নিয়ে একের পর এক অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরেও মাদক নিয়ন্ত্রণকারীকে বের করা সম্ভব হয়নি। এই দোষ কার ওপর চাপাব? প্রশাসনের ওপর? রাজনৈতিক নেতাদের ওপর? নাকি সুশীল সমাজের ওপর?

আমাদের ধারণা ছিল একশ্রেণির ছাত্র, বখাটে তরুণ বা উচ্ছন্নে যাওয়া যুবকরাই মাদক সেবন করে। কিন্তু না। আমাদের এমন ধারণা একদমই ভুল। মাদক নামক মোহনীয় বস্তু একশ্রেণির সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে পুলিশ সদস্য, ডাক্তার, প্রফেসর, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। বরগুনার সব থেকে আলোচিত ঘটনা সম্প্রীতি রিফাত হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে জড়িত ছিল মাদক ব্যবসাসহ বেশ কিছু কারণ। কিন্তু প্রশাসন মাদক ব্যবসাটিকে আমলে না নিয়ে হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্য ইস্যুকে প্রধান করে দেখছে। সেজন্য প্রশাসনের বিরুদ্ধেও প্রশ্ন তুলেছে সাধারণ মানুষ।

অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতারা একে-অপরকে দোষারোপ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে অভিযোগ উঠছে বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাড. ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক সুনাম দেবনাথের নামে। কিন্তু সুনাম দেবনাথ বিষয়টি বারবার অস্বীকার করে প্রমাণ চেয়েছেন গণমাধ্যমের কাছে। এ বিষয়টি আমার কাছে বেশ খটকা লাগছে। একজন মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেই সে সঙ্গে সঙ্গে অপরাধী হয়ে যায় না। যতক্ষণ না তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়া যায়। সুনাম দেবনাথ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এটা তিনি স্বীকার করুন বা না করুন এ নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বরগুনায় নিঃসন্দেহে একজন মাদকসম্রাট আছে, তবে তিনি কে?

রাজনৈতিক নেতারা নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য একে-অপরকে দোষারোপ করে যাচ্ছেন। কিন্তু মূল বিষয় (মাদক) আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। আর এত ঘটনা ঘটার পরেও মাদক ব্যবসায়ীরা গোপনে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখছে। ফলে বরগুনার তরুণ প্রজন্ম তথা যুব সমাজ ক্রমেই অবনতি দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ নিয়ে আমার কাছে যা মনে হচ্ছে তা তুলে ধরছি...

(১) মাদক নির্মূলে বরগুনার রাজনৈতিক নেতাদের আগ্রহ জরুরি। তারা যদি কেউ এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত না থাকেন, তবে তাদের উচিত একে-অপরের প্রতি অভিযোগ বন্ধ করা এবং কোনো মাদকসেবনকারীকে নিজের দলে প্রশ্রয় না দেয়া। মাদকের কলঙ্ক থেকে বাঁচতে উভয় গ্রুপকে সম্মিলিতভাবে কাজ করা। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে সহযোগিতা করা। মনে রাখা উচিত রাজনীতি আপনাদের আদর্শ, রাজনীতির মাধ্যমেই আপনাদের পরিচয়। সুতরাং রাজনীতিকে কলঙ্কমুক্ত রাখা আপনাদের দায়িত্ব।

(২) এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের গুরুত্ব অনেক। প্রশাসন ইচ্ছা করলে সব রাঘব-বোয়ালকে যে কোনো মুহূর্তে আইনের আওতায় আনতে পারে। বরগুনার পরিবেশকে শান্ত ও মাদকমুক্ত বরগুনা গড়তে প্রশাসনের উচিত মাদকের বিরুদ্ধে আরো জোড়ালোভাবে অভিযানে নামা এবং মাদক গডফাদারদের মুখোশ উন্মোচিত করা। 

(৩) সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে সংগঠনগুলোর চ্যালেঞ্জ নেয়া দরকার। এ জন্য তাদের প্রথমত সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত। পাশাপাশি মাদকসংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য থাকলে তা প্রশাসনকে দিয়ে সহযোগিতা করা।

(৪) মাদকের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে পরিবারকে সচেতন হতে হবে সবার আগে। পরিবারের কেউ যাতে মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবহারে জড়িয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক বা সজাগ থাকতে হবে। পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী করা, কাজের ফাঁকে ফাঁকে সন্তানদের সময় দেয়া, নিয়মিত খোঁজখবর নেয়া। তাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়তে উৎসাহিত করা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করা এবং খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে না দেয়া। সন্তানের সামনে স্বামী-স্ত্রী বিরোধ না করা, নিজেরা সংযত জীবনযাপন এবং সন্তানকে ছোটবেলা থেকে সংযত জীবনযাপনের শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা দেয়া।

(৫) সমাজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মাদকাসক্ত হলেই একজন মানুষ তার মানবাধিকার ও মানুষ হিসেবে মর্যাদা লাভের অধিকার হারিয়ে ফেলে না। সব মাদকাসক্ত ব্যক্তির বৈষম্যহীন, গ্রেপ্তার ও শাস্তিমুক্ত জীবন ধারণের অধিকার রয়েছে। তাই আসুন আমরা সবাই সমাজে এ অন্ধকার পথে এগিয়ে চলা মানুষদের প্রতি যতœবান ও দায়িত্ববান হই। তাদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই। সবাই মাদকমুক্ত থাকি এবং মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যুবসমাজকে মাদকাসক্তির প্রভাব থেকে রক্ষা করি।

আমরা আবার আমাদের সেই আগের শান্তিপ্রিয় বরগুনায় ফিরে পেতে চাই। যেখানে ছিল না মানুষের কোনো ভেদাভেদ, ছিল না রাজনৈতিক কোনো প্রতিহিংসা বা সহিংসতা। সন্ধ্যার পরে ধর্মতলায় সবার একত্রে চা খাওয়ার গল্প-আড্ডাটা আবার জমে উঠুক। সার্কিট হাউস মাঠে কিংবা স্টেডিয়ামে আবার জমে উঠুক খেলাধুলা। শিল্পকলা একাডেমি অথবা বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্সে হোক সাপ্তাহিক সাংস্কৃতিক আয়োজন। মনে রাখতে হবে, দুই একটি বিশৃঙ্খলা ঘটনা মানেই আমাদের বরগুনার ঐতিহ্যগুলো নষ্ট হয়ে যায়নি। দুই-একজন মানুষ খারাপ হওয়া মানে পুরো বরগুনাবাসী খারাপ হয়ে যায়নি। সুতরাং পেছনের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সবাই সম্মিলিতভাবে বরগুনার সুনাম অর্জনে এগিয়ে আসতে হবে।  আমাদের আরও মনে রাখা উচিত উন্নত সমাজের মানুষ অতি লোভে অন্যের ক্ষতি করে না, উন্নত মন নিয়ে নিজের জীবনের মতই অন্যের জীবনকেও ভালোবাসে, সময়কে কাজে লাগায়। অর্থের জন্য জীবন নয়, বরং জীবনে জন্য অর্থ প্রয়োজন বলে মনে করে। সুতরাং বরগুনার সব রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনকে অনুরোধ করব, ব্যক্তি স্বার্থ বাদ দিয়ে বরগুনার সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে আপনারাই পারেন অন্য একটি জীবনকে আলোকিত করতে। আমরা চাই না বরগুনার কোনো রাজনৈতিক নেতা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ুক। কারণ তারা এই ভয়াবহ কর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে আর কোনোভাবেই বরগুনাকে মাদকমুক্ত করা সম্ভব হবে না। আমাদের প্রত্যাশা তারা বরগুনার সুনামকে ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট ভূমিকা পালন করবে। একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন বরগুনা গড়তে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। আসুন আমরা মাদককে না বলি, দুর্নীতিকে না বলি, আমরা আমাদের মেধা ও মননের সর্বোচ্চ বিকাশ সাধন করি। আগামী দিনের সুন্দর নেতৃত্ব প্রদানের সক্ষমতা অর্জন করি।

লেখক: সাংবাদিক


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়