ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বিশ্ব দারিদ্র্য দূরীকরণ গবেষণায় এলো অর্থনীতিতে নোবেল

রিমি মুৎসুদ্দি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৯, ২১ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্ব দারিদ্র্য দূরীকরণ গবেষণায় এলো অর্থনীতিতে নোবেল

অভিজিৎ ব্যানার্জী, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ

ক্ষুধা, দারিদ্র্য উন্নয়নশীল বিশ্বের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। প্রথম নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন লিখেছেন: ৯ বছর বয়সে তিনি দেশে দুর্ভিক্ষ দেখেছেন। সময়টা ছিল ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ। পরবর্তীকালে গবেষণার সময় সেই শৈশবে দেখা ও পরে পরিসংখ্যান বিষয়ে জানার পর, প্রায় ৩ লাখ মানুষের ক্ষুধার কারণে একসঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া তাঁকে চিন্তিত করেছিল, এবং এর কারণ অনুসন্ধানেই তাঁর গবেষণা। স্যারের আদর্শে অনুপ্রাণিত ২০১৯-এ নোবেলজয়ী অধ্যাপক অভিজিৎ ব্যানার্জী ও তাঁর স্ত্রী, একদা ছাত্রী ও সহ-গবেষক এস্থার ডাফলো একই পথে হেঁটেছেন। অর্থাৎ দারিদ্র্য তাঁদেরও সারাজীবনের গবেষণার বিষয়।

‘The poor are like that, the rich are like that. But the problems these cause manifest themselves in different ways based on how much money you have and the context you are in..’ , ভারতের ব্যাংগালুরুতে একটি প্রকল্প বিষয়ে বক্তৃতা দিতে এসে এবছরের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এস্থার ডাফলো একথা বলেছেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেছেন, একজন ধনী ব্যক্তি ব্যায়াম করেন না এই ভেবে যে, আজ তার কাছে সময়াভাব। সেই ধনী ব্যক্তিটি মনে মনে হয়ত ভাবছেন, আজ সময়াভাব, কাল নিশ্চয়ই সময় হবে এবং তিনি ব্যায়াম করবেন। ঠিক সেভাবেই একজন গরিব পরিবারও ভাবে, আজ অর্থাভাব, আজ ইমিউনাইজেশন বা ভ্যাক্সিনের বদলে পরে কখনও বাচ্চাকে ইমিউনাইজড করবেন অথবা ভ্যাকাসিন দেয়াবেন। এভাবে ভাবতে ভাবতে ধনী ব্যক্তিদের যেমন আর ব্যায়াম করা হয়ে ওঠে না ও তাঁরা রোগগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন, সেভাবেই গরির পরিবারটি ও সেই পরিবারের বাচ্চাটিও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। অদূর ভবিষ্যতে গরিবের যেমন অর্থাভাব থেকেই যায় এবং শেষপর্যন্ত রোগপ্রতিরোধ করা হয়ে ওঠে না সেরকমই বড় লোকেরও সমায়াভাবে ব্যায়াম করে নিজেকে সুস্থ রাখা হয়ে ওঠে না।

শুধু ভারত নয়, এস্থার ডাফলো, অভিজিৎ ব্যানার্জী ও মাইকেল ক্রেমারের গবেষণা সুদূর কেনিয়া থেকে আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চল, ব্রাজিল ও বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তের গরিব দেশেগুলোর প্রত্যন্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।    

২০১৯, অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন অভিজিৎ ব্যানার্জী, এস্থার ডুফলো, মাইকেল ক্রেমার। নোবেল কমিটি জানিয়েছে, গবেষকরা এবার নোবেল পেয়েছেন তাঁদের পরীক্ষামূলক গবেষণা আগামী দশকে বিশ্বের দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্যাপকভাবে সহায়ক হবে।

ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজির সম্মানিত অধ্যাপক অভিজিৎ ব্যানার্জী ও তাঁর স্ত্রী, একদা ছাত্রী, গবেষক অধ্যাপক এস্থার ডাফলো এবং হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভলপমেন্ট ইকনমিক্সের অধ্যাপক মাইকেল ক্রেমার তাঁদের গবেষণায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর দারিদ্র্য দূরীকরণে পরীক্ষামূলক পদ্ধতির পথ দেখিয়েছেন বিশ্বকে। এই পথের দিগদর্শন করেছিলেন অভিজিৎ ব্যানার্জীর অধ্যাপক এবং ভারতের প্রথম নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ (১৯৯৮ সালে) অমর্ত্য সেন। অধ্যাপক সেন তাঁর গবেষণায় সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত, সম্পদের বন্টন ইত্যাদি বিষয়ের ওপর কাজ করেছেন। দারিদ্র্য পরিমাপের পদ্ধতি বিষয়েও তিনি নতুন পথের দিশারী। Welfare Economics and Development Economics তাঁর কাজের বিষয়। দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ সম্পদের অভাবে নয় বন্টনের অব্যবস্থায়- সেকথাই অধ্যাপক সেন তাঁর গবেষণায় বলেছেন। ভারতবর্ষের প্রতিটা দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে তিনি বেকারত্ব, poor wage অর্থাৎ শ্রমিকদের নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং সম্পদের বন্টন ব্যবস্থায় ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন।

ডাফলো ও ব্যানার্জী দারিদ্র্য দূরীকরণের পদ্ধতি ও তার প্রয়োগ বিষয়ক গবেষণা করেছেন। হাভার্ডের ডেভলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক মাইকেল ক্রেমারও তাঁদের সহায়ক গবেষক ছিলেন। ডাফলো ও ব্যানার্জী যৌথভাবে এমআইটি-তে ‘আব্দুল লতিফ জমিলা পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’ গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এমআইটি-র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এই গবেষণা কেন্দ্র ল্যাবরেটরির মতোই হাতে-কলমে অর্থাৎ সোশ্যাল সায়েন্সের ক্ষেত্রে মাঠে ঘাটে, দূর দূরান্তে গ্রামাঞ্চলে ও অনুন্নত সমস্ত অঞ্চল থেকে প্রত্যক্ষ তথ্য সংগ্রহ করে সেই তথ্যের ওপর বিভিন্ন পরীক্ষামূলক পদ্ধতি প্রয়োগ করে গবেষণা করতেন। 

কাজের ক্ষেত্র হিসাবে তাঁরা উন্নয়নের তিনটি মৌলিক ক্ষেত্র নির্বাচন করেছেন। কৃষিক্ষেত্র, শিশুশিক্ষা ও স্বাস্থ্য। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন শিশুদের ভ্যাকসিন বিষয়ক প্রকল্পে গ্রামাঞ্চলে ও শহরে গরিব শিশুদের বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন ও ডিওয়ার্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং কিছু ক্ষেত্রে সাবসিডিরও ব্যবস্থা থাকে। ডুফলো, ক্রেমার ও ব্যানার্জীর প্রত্যক্ষ গবেষণা, ফিল্ড ওয়ার্ক প্রমাণ করে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বিনা পয়সার জন্য অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতার অভাবে তারা বাচ্চাদের ডিওয়ার্ম বা ভ্যাকসিনে ইচ্ছুক নন। সেক্ষেত্রে প্রচলিত অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, তাহলে সাবসিডাইজড একটা মূল্য নেয়া হোক। কিন্তু ডাফলো তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন কেনিয়াসহ আফ্রিকার বহুদেশে মানুষ অত্যন্ত price sensitive, বিশেষ করে ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে তাঁদের প্রেসক্রিপশন, বাচ্চারা ভ্যাকসিন নিতে বা ডিওয়ার্মের জন্য এলে তাদের বাবা মা-কে বোনাস হিসেবে কিছুটা শাকসবজি অথবা শস্য দেওয়া হোক।

উন্নয়নের তিন মূল কাঠামোর ওপর জোর দিলেই বিশ্বের দারিদ্র্য দূরীকরণ হবে তা রাজনীতিবিদরা মুখে বললেও পরিকল্পনা ও পদ্ধতি নিয়ে যে প্রশ্নগুলো থেকে যায় তার উত্তর এই অমূল্য গবেষণাগুলো দিতে পারবে বলেই বিশ্বাস বিশ্বের অর্থনীতিবিদদের। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। ভারতে এই ধরনের গবেষণায় যে তথ্য পাওয়া যায় তা মাঝারি মানের, তবে তুলনায় চীনে একেবারেই কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। একটি সাক্ষাৎকারে এই কথা বলেছেন নোবলজয়ী অধ্যাপক অভিজিৎ ব্যানার্জী। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ও তাঁর সুযোগ্য ছাত্র অভিজিৎ ব্যানার্জী দুজনেই দারিদ্র্য দূরীকরণে মাইক্রো লেভেলের কাজকেই গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এই কাজগুলো অবশ্যই বৃহৎ অর্থাৎ ম্যাক্রো লেভেল প্রতিষ্ঠানগুলোরও সম্পূর্ণ সহায়তার একটা সহাবস্থান প্রয়োজন। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে দুর্নীতি ও নানাবিধ প্রশাসনিক জটিলতায় গরিব মানুষের সঙ্গে প্রশাসনিক সাফল্য ও উন্নয়নের পরিকল্পনার সুফলের বিশাল ফারাক, সেখানে এই প্রশ্নটা পৌঁছাবে তো- তারা কেমন আছে?

প্রশ্ন থেকে যায় আরও- অতএব গরিব কি বড়োলোক হইবে? গরিব মানুষের হাতে টাকা আসবে? তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা কি বাড়বে? জীবনের নূন্যতম অধিকার- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষা কি ধনীদের জন্মগত অধিকার ছাড়াও গরিব মেহনতি মানুষের নায্যপ্রাপ্য হিসেবে স্বীকৃত হবে?

লেখক: অর্থনীতির শিক্ষক, কবি ও গল্পকার


দিল্লি/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়