ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সময়ের বর্ধিত পায়ে পিষ্ট বাংলাদেশ

মাশরুর শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১১, ২২ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সময়ের বর্ধিত পায়ে পিষ্ট বাংলাদেশ

রবিন দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এখন একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। পেশাগত প্রয়োজনের বাইরে বহুমাত্রিক পড়াশোনা তাকে মুক্তমনা মানুষে পরিণত করেছে। ধর্মের বিষয়ে শৈশব কৈশোরের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে এখন সে একজন আধুনিক মানুষ। প্রতিদিন বিচিত্র বই আর উন্নত মানুষের সংস্পর্শে তার চিন্তায় বিবর্তন ঘটায়। গত দেড়যুগ ধরে তার ঢাকায় বসবাস। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী রবিনের ধর্ম নিয়ে অনুসূয়া যেমন নেই, তেমনি বাড়াবাড়িও নেই। সম্প্রতি সে ভোরে হাঁটতে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। পার্কের প্রবেশপথে এক ডাব বিক্রেতা তাকে সালাম দেয়। রবিন লক্ষ্য করে ডাব বিক্রেতা মোবাইলে ইউটিউবে উচ্চস্বরে ওয়াজ শুনছে। ডাব বিক্রেতা রবিনের পূর্ব পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে তাকে চেনে। সে ডাব কিনে আলাপ জমায়। রবিন আলাপের এক পর্যায়ে গম্ভীরভাবে বলে, ‘আপনি কি সাম্প্রতিক একটা ফতোয়া শুনেছেন? সৌদি আরবের এক মুফতি বলেছে- এসব ফেইসবুক, ইউটিউব এগুলো ইহুদি নাসারাদের আবিষ্কার। এখানে ধর্মের কথা শোনাও পাপ। তুমি যে সোয়াবের আশায় ওয়াজ শুনছো তোমার তো গুনাহ হচ্ছে।’ রবিনের কথা শুনে লোকটি বিস্মিত হয়। পরদিন গিয়ে রবিন দেখে লোকটি ইউটিউবে ওয়াজ শুনছে না।

 

শামীম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। তার বন্ধু এহসান উইম্যান এন্ড জেন্ডার স্টাডিজে পড়ে। এটি তুলনামূলক আধুনিক বিষয়। এখানে নারীবাদী অনেক তথ্য পড়ানো হয়। এ বিষয় পড়ে একজন শিক্ষার্থীর আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার কথা। এহসানের উল্টো ফল হয়। সে পারিবারিকভাবে মানিকগঞ্জের এক পীরের ভক্ত হয়। শামীমকে একবার ঐ পীরের বার্ষিক ওরস মাহফিলে নিয়ে যায় এহসান। ঐ মাহফিলে আগত মানুষদের বেশিরভাগ ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলের খেটে খাওয়া নিন্মবিত্ত মানুষ। অল্প স্থানে অনেক মানুষের অবস্থান ও শৌচকর্মে বেশ দুর্গন্ধ ছড়ায়। প্রথম দিন নামাজে দাড়িয়ে শামীম লক্ষ্য করে কিছু লোক হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠছে। শামীম এহসানকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে ওরা অলৌকিক কিছু দেখতে পায়। শামীম পরদিনই বিরক্তি নিয়ে মানিকগঞ্জ ত্যাগ করে।

 

সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত এই দুটি ঘটনা ধর্ম নিয়ে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বোঝাপড়ার চালচিত্র। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে যখন ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় তখন চাঁদে সাঈদীকে দেখা নিয়ে তুলকালাম হয়েছিলো। ফেইসবুকের মাধ্যমে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে থানা, কোর্ট পুড়িয়ে দেয় ধর্মান্ধ মানুষেরা। একবিংশ শতাব্দিতেও চাঁদে মানুষ দেখার ঘটনা ঘটতে পারে এবং সেটি বিশ্বাস করার মতো মানুষ যে দেশে বিস্তর, সেখানে ধর্ম নিয়ে সত্যিই দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সাত বছর পূর্বে কক্সবাজারের রামুতে ফেইসবুকে ইসলামবিরোধী পোস্ট দেয়ার গুজব তুলে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো শত বছরের পুরোনো বৌদ্ধ মন্দির। একই ধরনের ঘটনায় এবার ভোলায় প্রাণ হারালো ৪ জন।

স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে- ধর্ম পালন নাকি প্রচার কোনটি বড়? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ধর্ম পালনের চেয়ে ধর্ম প্রচার যখন বড় হয়ে যায় তখন প্রকৃত ধর্ম সেখান থেকে পালিয়ে যায়। ইসলামে আছে, আল ফিতনাতু আসাদ্দু মিনাল কাতাল। অর্থাৎ ফিতনা বা ফ্যাসাদ তৈরি করা খুন করার চেয়েও ভয়ঙ্কর। কারণ খুনে একজন মারা যায়। ফিতনা ফ্যাসাদ তৈরি করলে অনেকে হতাহত হয়।

বিংশ শতকের মিডিয়া তাত্ত্বিক মার্শাল ম্যাকলুহান তার ‘এক্সটেনশন অব ম্যান’ বইয়ে প্রযুক্তিকে পায়ের বর্ধিত অংশ বা চাকা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পায়ে চাকা লাগালে গতি বাড়ে। কিন্তু খোদ পায়েই যদি সমস্যা থাকে তাহলে চাকা পথের বদলে বিপথে নিতে পারে। আমাদের দেশে অসমর্থ পায়ে ফেইসবুক ও স্যোশাল মিডিয়ার চাকা অকালে যুক্ত হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। ফলে নিয়মিত বিরতীতে বিভ্রান্তির দুর্ঘটনায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের কোনো আবিষ্কার নয়। সাংস্কৃতিক উন্নয়নের একটি পর্যায়ে উন্নত বিশ্বে তথ্য প্রযুক্তির এসব নিত্য নতুন কলাকৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতিটি সৃজনের সাথে সাংস্কৃতিক বিবর্তনের একটি যোগসূত্র থাকে। কিন্তু আমরা প্রযুক্তিটি পেয়েছি। প্রযুক্তির সংস্কৃতি পাইনি। ফলে শিশুর হাতে ছুরির মতো নিজের ছুরি দিয়ে নিজেকে আহত করছি। কখনো কখনো খুনও হচ্ছি। আমাদের দেশে তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে প্রযুক্তি ব্যবহারের সংস্কৃতি বা শিক্ষা যদি ছড়িয়ে দেয়া না যায় তবে প্রযুক্তি যেমন দিনদিন জড় মানুষ তৈরি করবে, তেমনি অনুভূতিহীনতা তাকে পরিণত করবে ভয়ঙ্কর প্রাণীতে। 

লেখক: সাংবাদিক, কমনওয়েলথ শিভনিং ফেলো, ২০১৯


ঢাকা/তারা   

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়