ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কী আছে নতুন সড়ক পরিবহন আইনে?

সাঈদ আহসান খালিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৫, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কী আছে নতুন সড়ক পরিবহন আইনে?

০১ নভেম্বর, ২০১৯ হতে বাংলাদেশে কার্যকর হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮। বহুল আলোচিত এই আইন প্রণয়নের এক বছরেরও বেশি সময় পর এর বাস্তবায়ন শুরু হলো। নতুন এই আইনটি ১৯৮৩ সাল থেকে কার্যকর মোটরযান অধ্যাদেশ রহিত ও প্রতিস্থাপন করলো। নতুন সড়ক পরিবহন আইনে পুরাতন মোটরযান অধ্যাদেশ-এ বর্ণিত সব অপরাধের শাস্তি বাড়ানোর পাশাপাশি বেশকিছু উল্লেখযোগ্য নতুন বিষয় সংযোজিত হয়েছে। যেমন-

কোন অপরাধে কী শাস্তি?

নতুন সড়ক পরিবহ আইন-এ সড়ক নিরাপত্তা ও আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে অনধিক ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ৬ মাস কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রদান করা হবে। জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স-এর শাস্তি হবে ন্যূনতম ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা ন্যূনতম ১ লক্ষ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা। নিবন্ধনবিহীন গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। গাড়িতে অতিরিক্ত ওজন বহন করলে অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। ট্যাক্স টোকেন না থাকার শাস্তি হবে ১০ হাজার টাকা জরিমানা। হেলমেট না পরলে কিংবা ট্রাফিক সংকেত ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। সিটবেল্ট না বাঁধলে, চলন্ত অবস্থায় চালক মোবাইল ফোনে কথা বললে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। গাড়ি চালিয়ে ইচ্ছেকৃতভাবে কাউকে খুন করলে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০২ ধারানুযায়ী সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড প্রযোজ্য হবে, বেপরোয়া গাড়ি চালনা দ্বারা কাউকে আহত বা নিহত করলে অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান নতুন আইনে সন্নিবেশিত হয়েছে। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো, রাস্তার উল্টোদিকে গাড়ি চালানো, লেন ভঙ্গ, মোটরসাইকেলে একজনের বেশি সহযাত্রী বহন, গাড়ির ছাদে যাত্রী তোলা, ফুটপাতে গাড়ি চালানোর মতো অনিয়মগুলোকেও কঠিন শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া গাড়ির ওজন ও গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কের ব্যবহার, গাড়ির নিবন্ধন, রুটপারমিট ও ফিটনেস সার্টিফিকেট নেওয়া, মোটর ড্রাইভিং স্কুল প্রতিষ্ঠা ও প্রশিক্ষণ, গণ-পরিবহনের আসনসংখ্যা ও ভাড়া নির্ধারণ- নিয়ন্ত্রণ, নারী-শিশু-বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আসন সংরক্ষণের মতো বিষয়গুলোও এই আইনে গুরুত্ব পেয়েছে।

অপরাধের তদন্ত বিচার

সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর ধারা ১১৪ অনুসারে এই আইনের অধীন অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ইত্যাদির ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮ এর বিধানাবলী অনুসরণ করা হবে। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর বা সার্জেন্টের নিচে নন এমন কর্মকর্তা এই আইনের অধীনে জরিমানা আরোপ করতে পারবেন। এই আইনের অধীনে অপরাধসমূহ মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ এর অধীনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য হবে। নতুন সড়ক আইনের ১১৭ ধারানুসারে এই আইনে কৃত সব অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং আপোষযোগ্য করা হয়েছে।

সড়ক পরিবহন আইনের অভিনবত্ব

সড়ক আইনে কিছু নতুন ও বিশেষ বিধান যুক্ত করা হয়েছে যা পূর্বের আইনে অনুপস্থিত ছিলো।  ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে অষ্টম শ্রেণী। অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে চালকের  বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর এবং পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য চালকের বয়স কমপক্ষে ২১বছর হতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে ১২ পয়েন্ট বরাদ্দ রাখা হয়েছে, আইন ভঙ্গে জেল-জরিমানা ছাড়াও লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা যাবে। পুরো ১২ পয়েন্ট কাটা গেলে লাইসেন্স বাতিল হবে। চালকের সহকারীকে কমপক্ষে পঞ্চম শ্রেণী পাশ হতে হবে এবং ধারা ১৪ অনুযায়ী কন্ডাক্টর লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নতুন সড়ক আইনের ৭ ধারানুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত পদ্ধতিতে বিশেষ শারীরিক সামর্থ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে ‘প্রতিবন্ধীবান্ধব মোটরযান’ চালানোর লাইসেন্স প্রদানের সুযোগ রাখা হয়েছে। এছাড়াও সড়ক দূর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির চিকিৎসার দায়িত্ব মোটরযান চালক, কন্ডাক্টর বা তাঁদের প্রতিনিধির উপরে ন্যস্ত করা হয়েছে। এই সংক্রান্ত দায়িত্ব অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে সড়ক আইনের ৯৬ ধারানুসারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ১ মাস কারাদণ্ড অথবা ২০ হাজার টাকা জরিমানা আরোপ করা হতে পারে। একইসাথে দণ্ডিত ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্সের বরাদ্দকৃত পয়েন্ট কাটা যাবে।

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ আর্থিক সহায়তা

১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ-এর ১২৮ ধারানুসারে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত/নিহত/ক্ষতিগ্রস্ত হলে আদালতে মামলা করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার একটি আইনি সুযোগ ছিল। ওই আইন অনুসারে বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলা জজের অধীনে একটি করে Claims Tribunal গঠন করার বিধান ছিল। বাংলাদেশের যে কোন জেলায় কেউ যদি অন্য কারো অবহেলার ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হতো- তাহলে সেই আইনের ১২৮ ধারানুযায়ী ক্লেইমস ট্রাইবুনালে আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারতো। এই ‘আর্থিক ক্ষতিপূরণ’ এর পরিমাণ ছিল- অনির্দিষ্ট অর্থাৎ, ক্ষতিপূরণের অংক কত হবে তা অবহেলাপ্রসূত প্রতিটি পৃথক দুর্ঘটনায় কৃত ক্ষয়- ক্ষতির ভিত্তিতে নির্ধারণ করার এখতিয়ার ছিল সংশ্লিষ্ট আদালতের। নতুন সড়ক পরিবহন কার্যকর হওয়ার ফলে মোটরযান অধ্যাদেশের অধীনে ক্লেইমস ট্রাইব্যুনালে ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলার সুযোগ এখন আর থাকছে না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নতুন সড়ক আইনের ধারা-৫৩ অনুসারে একটি ‘আর্থিক সহায়তা তহবিল’ গঠন করে সেই তহবিল হতে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা মৃত ব্যক্তির প্রতিনিধিকে আবেদন সাপেক্ষে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইনের ধারা- ৫৪ তে বলা হয়েছে ‘আর্থিক সহায়তা তহবিল’ পরিচালনার জন্য একটি ‘ট্রাস্টি বোর্ড’ থাকবে। এই ট্রাস্টি বোর্ডের হাতেই সড়ক দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত বা মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী কর্তৃক দাবিকৃত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত আবেদনকারী যদি মনে করেন যে ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক মঞ্জুর করা ক্ষতিপূরণ অপর্যাপ্ত তাহলে ধারা-৫৯ অনুযায়ী একই কর্তৃপক্ষ (ট্রাস্টি বোর্ড) এর কাছে পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবেন এবং পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না হলে সরকারের কাছে আপিল করতে পারবেন। আপিলের সিদ্ধান্তেও সন্তুষ্ট না হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ‘সালিশ নিষ্পত্তিকারী’ নিকট আবেদন করতে পারবেন এবং আরবিট্রেটর- এর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। নতুন সড়ক আইনের ধারা ৬১(৪) অনুযায়ী- এই আইনের অধীন ক্ষতিপূরণ দাবি সংক্রান্ত প্রশ্ন জড়িত আছে এমন কোন মামলা কোন দেওয়ানি আদালত বিচারের জন্য গ্রহণ করতে পারবে না, এমনকি সালিশ নিষ্পত্তিকারীর কোন সিদ্ধান্ত বা কার্যধারা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না; সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আদালতে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া যাবে না। আদালতে তথা ক্লেইমস ট্রাইবুনালে মামলা হলে দায়ী চালক ও সংশ্লিষ্ট যানবাহনের মালিককে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা ও তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করার পূর্বে যে সুযোগ ছিল তা নতুন আইনে নেই। ‘আর্থিক সহায়তা তহবিল’ হতে ট্রাস্টি বোর্ড ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ ও প্রদান করবে।

সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা

নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে এর বাস্তবায়নে বেশকিছু  অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যা মোটরযানের চালক, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছে এবং আইনটি সংশোধন করার দাবি উঠেছে। সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হলেও এখনো এই আইনের অধীনে বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি যার ফলে সড়ক আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়ছে, বিআরটিএর পর সড়ক আইন কার্যকরে বড় ভূমিকা পুলিশের। কিন্তু তাদের মামলা করার যন্ত্রের সফটওয়্যার হালনাগাদ করা হয়নি, এ কারণে সড়কে আইন অমান্যের জন্য তারা জরিমানা ও মামলা করতে পারছে না। অনেকে দাবি করছেন নতুন সড়ক আইনে প্রবর্তিত শাস্তি বেশি কঠোর হয়েছে, বড় মোটরযান ও হালকা মোটরযানের মধ্যে শাস্তির ক্ষেত্রে কোন শ্রেণীবিভাজন করা হয়নি। বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের জন্য সড়কে আলাদা লেনের ব্যবস্থা নেই, বেশিরভাগ ভবনে গাড়ি পার্কিং এর সুবিধা নেই, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা ও দুর্নীতির অভিযোগও পাওয়া যায়। এমন প্রেক্ষিতে নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়