ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ইতিহাসের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

অসীম সাহা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪১, ১৬ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইতিহাসের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস, একটি জাতিরাষ্ট্রের মহান স্রষ্টা। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিলো বাঙালি জাতিকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে নিয়োজিত, তিনি আজ পৃথিবীর কাছে এক অনিবার্য নাম, এক অবিস্মরণীয় নেতা।

এই উপমহাদেশে অনেক স্মরণীয় নেতার জন্ম হয়েছে। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো নেতা দ্বিতীয় কেউ জন্ম নেননি। কারণ, ঔপনিবেশিক শোষণে জর্জরিত একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দেয়া সহজ কথা নয়। সেই অসাধ্যসাধন করেছেন বঙ্গবন্ধু।

ইতিহাসে কখনো বাঙালির একক জাতিরাষ্ট্র ছিলো না। একাদশ শতকে যাদের হাতে ভারতের শাসনভার ছিলো, তারা কেউ বাঙালি ছিলেন না। সেন ও পালবংশের রাজারাও বাঙালি ছিলেন না। তারা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্ঠপোষক এবং হিন্দু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন-সৃষ্টিকারী ও বর্ণবাদী উচ্চবংশীয় হিন্দু রাজা। এমনকি মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব বলে যাকে গৌরবের সঙ্গে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তিনিও বাঙালি ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই হচ্ছেন সেই নেতা, যিনি প্রথম নিজেকে বাঙালি হিসেবে অধিষ্ঠিত করে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। হাজার বছরের ইতিহাসে এ-এক মহাকালীন অর্জন, যার স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু।

কাজটি সহজ ছিলো না। টুঙ্গিপাড়ার মতো একটি অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে একদিন এক ছোট্ট খোকাই যে একটি জাতিগোষ্ঠীর পিতা হয়ে উঠবেন, এ-ছিলো কল্পনার অতীত! কিন্তু নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে মুজিব ধীরে ধীরে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এবং ১৯৭০-৭১-এর দুঃসাধ্য পরম্পরাকে জাগ্রত রেখে অকুতোভয়ে সামনের দিকেই এগিয়ে গেছেন। সেই যাত্রাপথ তাঁর জন্যে অনুকূল ছিলো না। প্রতি পদে পদে পাকিস্তানি হায়েনারা তাঁর পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে, তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করে চলার পথ বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে। কিন্তু যে জীবন অথৈ সমুদ্রে ডিঙি নৌকায় পাড়ি দেয়ার শপথ নিয়ে পথে নেমেছে, তাকে প্রতিহত করতে পারে কে? পারেওনি। তাই জেল-জুলুম উপেক্ষা করে তিনি সগৌরবে মাথা উঁচু করে তাঁর বিজয় রথ ছুটিয়ে নিয়ে গেছেন এবং তাকে গন্তব্যে পৌঁছেই তিনি তাঁর নেতৃত্বের মহিমায় নিজেকে অভিষিক্ত করেছেন।

পৃথিবীতে অনেক নেতা তাঁদের নিজ নিজ দেশের স্বাধীনতালাভে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো এতো আত্মত্যাগ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার মতো আর কোনো নেতা আছেন কিনা সন্দেহ। একটি তর্জনী ও একটি অমোঘ কণ্ঠের স্বাধীনতার আহ্বান সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে এক মোহনায় মিলিত করে স্বাধীনতার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করার এই জাদুকরি সম্মোহন আর কোনো নেতার পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। তাই তিনি জাতির নেতা থেকে বিশ্বনেতা হয়ে উঠেছেন।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর যখন বিজয় অর্জিত হয়, তখন প্রিয় নেতা পাকিস্তানি কারাগারে। পাকিস্তানিরা বাঙালির এই অবিসংবাদিত নেতাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু জনগণের অব্যাহত আন্দোলন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক তৎপরতা এবং বিশ্বনেতাদের চাপে পাকিস্তান তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি তাঁর প্রিয় ভূমিতে ফিরে এসে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে একটি ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন আলোতে ভাস্বর করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে বঙ্গবন্ধু কাজ করে যেতে থাকেন। কিন্তু ’৭১-এর পরাজিত শক্তি, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করতে চেয়েছিলো, তারাই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, গুপ্তহত্যা এবং অবকাঠামো ধ্বংসের মাধ্যমে বাংলাদেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ব্যর্থ করে দেওয়ার সব ধরনের প্রয়াস তারা অব্যাহত রাখে। আর তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারা মরণকামড় দেয়। অবসরপ্রাপ্ত কিছু বিপথগামী সেনাবাহিনীর সদস্য খন্দকার মোশতাক ও তার দোসরদের প্ররোচনায় ৩২ নম্বর বাড়িতেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে সৃষ্টি হয় বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের নির্মম ইতিহাস। সূচনা হয় এক ঘৃণ্য কালো রাত্রির। তারপর থেকে দেশ চলে যায় পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের দখলে। সেই দুর্বিষহ সময়ের  ইতিহাস কেবলই বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করার ইতিহাস। জাতির পিতাহীন একটি এতিম রাষ্ট্রের অভিধা নিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বিশ্বাসঘাতক জাতি হিসেবে অবরুদ্ধ সময় অতিবাহিত করার ইতিহাস।

প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কুচক্রীরা নির্মমভাবে জাতির পিতাকে হত্যা না করলে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বিশ্বের বুকে সবচেয়ে উচ্চতায় নিজের মাথাটি তুলে রেখে গৌরবের সিংহাসনে আরোহণ করতে পারতো। কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য, এমন নেতাকে বাঙালি কিছু কুচক্রী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশের ষড়যন্ত্রে সপরিবারে নিহত হতে হলো। আবারও বলি, এই অপরিণামদর্শী খুনিরা নিশ্চিতভাবেই মীরজাফরের বংশধর খন্দকার মোশতাকের প্রেতাত্মা ছাড়া কিছু নয়।

বেদনাদায়ক হলেও সত্যি এই যে, আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ও কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা সৌভাগ্যক্রমে বিদেশে থাকায় ঘাতকদের বুলেট তাঁদের স্পর্শ করতে পারেনি। তাই আমরা বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে পারছি।

এ-বছর বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকীতে পালিত হচ্ছে মুজিববর্ষ। আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আমরা তাঁরই জীবদ্দশায় জাতি হিসেবে তাঁর রক্তঋণ কিছুটা হলেও শোধ করার সুযোগ পেতাম। জাতির স্রষ্টাকে জানাতে পারতাম জাতিগত শ্রদ্ধা। কিন্তু সে সৌভাগ্য আমাদের হলো না। আজ তাঁর জন্মদিনে তবু বলি :

যতোদিন এই দেশ, মাটি আছে
আছে নদী মধুমতী
ততোদিন জাতি শ্রদ্ধা জানাবে 
মুজিব তোমার প্রতি।

কাল থেকে মহাকাল চলে যাবে
বাড়বে কালের গতি
তখনও এ-জাতি শ্রদ্ধা জানাবে 
জনক তোমার প্রতি।


ঢাকা/তারা/নাসিম

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়