ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হাজার মাসের চেয়েও মহিমান্বিত রজনী

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ২০ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
হাজার মাসের চেয়েও মহিমান্বিত রজনী

আলহামদুলিল্লাহ। আমরা মাহে রমজানের শেষ ১০ দিনে অবস্থান করছি। নিঃসন্দেহে হিজরি বছরের ১২ মাসের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ও শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে রমজান। আর এই রমজানের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ, এই মাসেই রয়েছে লাইলাতুল কদর, মহিমান্বিত রজনী। রমজান মাসের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ যেমন লাইলাতুল কদর তেমনি এই লাইলাতুল কদরের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হচ্ছে আল-কুরআনুল কারিম। কুরআন নাযিল হয়েছে বলেই এই রাতকে আল্লাহ শ্রেষ্ঠ রাত হিসেবে ঘোষণা করেছেন। শুধু যেনতেন শ্রেষ্ঠত্বই নয় বরং এক হাজার রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ এ রাতের ফজিলত বা মর্যাদা এক হাজার রাতের ফজিলত বা মর্যাদার চেয়েও বেশি।

লাইলাতুল কদর আরবি শব্দ। বাংলায় আমরা বলি মহিমান্বিত রজনী বা মর্যাদাপূর্ণ রাত। উর্দু বা ফার্সি ভাষায় এর নাম শবে কদর। কদর অর্থ সম্মান আবার কদর অর্থ পরিমাণ। এই কদর থেকেই তাকদির অর্থাৎ আমাদের ভাগ্য ভালো-মন্দের পরিমাণ নির্ধারণ বুঝায়। এই দিক থেকে লাইলাতুল কদর মানে ভাগ্য নির্ধারণ রাত।

মানুষ হিসেবে আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি। তার মধ্যে মুসলিম হিসেবে আমরা সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন। আমাদের রয়েছেন শ্রেষ্ঠ মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। শ্রেষ্ঠ রাসুলের ওপর প্রেরিত হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। এই আল-কুরআন যারা আঁকড়ে ধরবে তারাই হচ্ছে কুরআনওয়ালা। আল-কুরআনকে আঁকড়ে ধরা মানে হচ্ছে এর তিলাওয়াত করা, একে হৃদয়ে স্থান করে দেওয়া, এই কুরআন নিয়ে গবেষণা করা, কুরআন ভালোভাবে বোঝা, কুরআনের আদেশ-নিষেধ মেনে চলা, কুরআনী জীবন পরিচালনা করা ইত্যাদি। এ কাজগুলো করতে পারলেই আমরা কুরআনওয়ালাদের মধ্যে পরিগণিত হব। তাই আমরা সার্বিকভাবে চেষ্টা করব কুরআনওয়ালাদের মধ্যে থাকতে। কুরআনওয়ালাদের সম্মান করতে।

লাইলাতুল কদর মহিমান্বিত একটি রাত যা চাইলেই পাওয়া যায়- এমন নয়। এর অবস্থান সুনির্দিষ্ট নয় বিধায় একটু কষ্ট করে একে পেতে হয়। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই রাতটি পাওয়ার জন্য কিছু পথ বলে দিয়েছেন। আমরা এই রাতটি রমজানের শেষ ১০ দিনে পেতে পারি। মনে রাখতে হবে রমজানের শেষ ১০ দিনে বি-জোড় রাতে এই রাত অন্বেষণ করার জন্য বলা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বাস করি, একেক দেশে একেক রাত লাইলাতুল কদর হবে না। সেইক্ষেত্রে আজকের রাত আমাদের কাছে হয়তো বি-জোড় কিন্তু দূরবর্তী কোনো পশ্চিমা দেশে সেটিই জোড় রাত। অতএব শেষ ১০ দিনের প্রতিটি মুহূর্তকে সম্মানিত মনে করে, প্রতিটি রাতকে আমরা লাইলাতুল কদর মনে করে ইবাদত বন্দেগি করলে আমরা ভাগ্যবানদের মধ্যে পড়তে পারি। আর এ জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করার জন্য মুসলিমদের উৎসাহিত করেছেন। ইতিকাফ মানে মসজিদে ইবাদতের উদ্দেশ্যে অবস্থান করা। স্বভাবতই একজন মানুষ যখন ১০ দিন ১০ রাত মসজিদে থাকেন, অজু অবস্থায় থাকেন, ঘুমানো, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি মসজিদকেন্দ্রিক করেন, তিনি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি ইবাদত করার সুযোগ পান এবং তার কাছ থেকে ওই ১০ রজনীর মধ্যে লাইলাতুল কদরের রজনী হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।

বিশ্বময় করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের জন্য ইতিকাফ করা সহজ নয়, যদিও সীমিতসংখ্যক মানুষের জন্য তার সুযোগ রয়েছে, তাহলে আমরা বাকিরা কী করব? আমরা চেষ্টা করব সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, নিজেকে এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রেখে আল্লাহর ইবাদতে সময় কাটাতে।

হিজরি সন অনুসারে, আরবি মাস অনুসারে, অথবা চান্দ্রমাসের হিসাব অনুসারে রাত শুরু হয় সূর্যাস্তের সাথে সাথেই। সূর্যাস্ত থেকে পরের দিনের সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত একটি রাত। এ বছর আমাদের এ রাতের ব্যাপ্তি সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ ঘণ্টা থেকে ১০ ঘণ্টা।

এ রাতের মর্যাদা রক্ষা করে আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করার জন্য আমরা আর কী কী করতে পারি? আমরা প্রতি রাতে দু’রাকাত দু’রাকাত করে চার, আট বা বারো রাকাত পর্যন্ত লাইলাতুল কদরের নামাজ আদায় করতে পারি। আমরা যদি ভাগ্যক্রমে লাইলাতুল কদরের রাত পেয়ে যাই, তাহলে আল্লাহর কৃপায় প্রায় এক হাজার মাস বা প্রায় ৮৪ বছরের প্রতিটি রাতে এই ৪ থেকে ১২ রাকাত লাইলাতুল কদরের নামাজের ফজিলত পেয়ে যাব। আমরা প্রতিদিন সূরা ইখলাস এই আকিদা ও বিশ্বাস করে তিনবার করে পাঠ করব, যেন আমরা পবিত্র কুরআন খতম করছি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদিসে এই সূরা ইখলাসকে কুরআনের তৃতীয়াংশ বলা হয়েছে, অর্থাৎ আমরা এই সূরা তিনবার পাঠ করলে পুরো কুরআন তিলাওয়াতের সওয়াব আল্লাহ আমাদেরকে দিতে পারেন। তবে শর্ত হচ্ছে এই আকিদা ও বিশ্বাস রেখে আমাদেরকে তিলাওয়াত করতে হবে। আল্লাহ যদি এই তিলাওয়াত মহিমান্বিত লাইলাতুল কদরের রাতে আমাদের নসিবে লিখে থাকেন, তাহলে নিঃসন্দেহে এই তিনবার সূরা ইখলাস পাঠ বা পবিত্র কুরআন খতমের জন্য প্রায় ৮৪ বছর প্রতি রাতে কুরআন খতমের প্রতিদান আল্লাহ আমাদেরকে দিতে পারেন।

আমরা প্রতিরাতে একটাকা থেকে শুরু করে যার যতটুকু সামর্থ্য আছে সেই সামর্থ্য অনুযায়ী মসজিদে, মাদ্রাসায়, জনকল্যাণের কাজে, দুঃস্থদের জন্য, গরিব মিসকিনের জন্য দান করতে পারি। ধরে নেই আমরা যদি এক টাকা এই রাতে দান করি, আর তা মহিমান্বিত লাইলাতুল কদরের রাত হয়, তাহলে প্রায় ৮৪ বছর প্রতি রাতে, এক টাকা করে দানের সওয়াব বা প্রতিদান আল্লাহ আমাদেরকে দিতে পারেন। এমনিতেই হিসাবটা অন্যরকমের। সাধারণ দিনে যে দান, যে ইবাদত, যে তিলাওয়াত করা হয়, রমজানে সেই তিলাওয়াত, দান বা ইবাদতের প্রতিদান ৭০ থেকে ৭০০ গুণ বা তার চেয়েও বেশি আল্লাহ বাড়িয়ে দিতে পারেন। তার উপর আবার মহিমান্বিত লাইলাতুল কদরের মধ্যে যদি তা পড়ে, তাহলে সেটি হাজার মাস একই ইবাদত, দান বা তিলাওয়াত করার যে প্রতিদান সেই পরিমাণ প্রতিদান আমাদেরকে আল্লাহ বাড়িয়ে দিবেন।

তাই সব কিছু ঝেড়ে ফেলে হাতে যে ক'টি দিন বা রাত রয়েছে, আমাদের উচিত তা থেকে লাইলাতুল কদর খুঁজে বের করা এবং রমজানের শেষ দিন পর্যন্ত এই চেষ্টায় রত থাকা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানুষ ২৭ রমজানের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। এ কাজটি শুধুমাত্র ২৭ রমজানে নির্দিষ্ট না-রেখে শেষ ১০ দিনের প্রতিটি রাত যদি আমরা এভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে পারি তাহলে এ রাতের মহিমা থেকে আমরা বঞ্চিত হবো না। মহান আল্লাহ আমাদেরকে করোনার এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে, আর্ত মানবতার সেবা, আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা এবং মহান আল্লাহর রহমত, বরকত ও নাজাত পাওয়ার জন্য সার্বিক চেষ্টা চালানোর তাওফিক দিন। আমীন।

লেখখ: সম্পাদক, মাসিক সংস্কার

** পবিত্র শবে কদর আজ

 

ঢাকা/শাহেদ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়