ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

স-তে সরকার সাহেদ সাবরিনা এবং স্বাস্থ্য

মোস্তফা কামাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৫, ১৮ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
স-তে সরকার সাহেদ সাবরিনা এবং স্বাস্থ্য

অনেক প্রতীক্ষার পর সাহেদ ধরা পড়েছে। ধরেছে র‌্যাব। ধরিয়েছে সরকার। এরপরও সমালোচনার ভাগীদার সরকার। সাহেদকে না ধরলে কারো কিছু করার ছিলো? কী হতো না ধরলে? সাহেদকে ধরা বা তার প্রতিষ্ঠানে র‌্যাবের অভিযানের আগ পর্যন্ত কেউ টুঁ শব্দ করেছেন? অন রেকর্ডে কোথাও তার সমালোচনা হয়েছে? তার কুকর্ম নিয়ে সংবাদ হয়েছে কোনো গণমাধ্যমে?

সযুক্ত আরেক নাম ডা. সাবরিনার ক্ষেত্রেও এই প্রশ্নগুলো তোলা যায়। এর আগে সম্রাট, খালেদ, পাপুল, পাপিয়ারাও ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত কোথাও এক লাইন সংবাদ হয়নি। সরকার বা কেউ কি মানা করেছিল? কোনো বারণ ছিল? একটা সময় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ পেলে তোলপাড় হতো। এরপর পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীকে ধরতো। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীকে পাকড়াও করার পর প্রেস ব্রিফিং না-করা পর্যন্ত মিডিয়া জানে না। দেশের গণমাধ্যম জগতে এ এক বিশাল পরিবর্তন!

করোনা মহামারি দেশের স্বাস্থ্যখাতের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছে। এই মহামারি না এলে হয়তো স্বাস্থ্যখাতে যা চলছিলো; নীরবে তাই চলতো। পুকুর চুরি চলতেই থাকতো। কোথাও সংবাদ হতো না। করোনার উসিলায় মানুষ স্বাস্থ্যখাতের চুরি, জোচ্চুরি, জালিয়াতির ঘটনা জানতে পারছে। সাহেদের রিজেন্টসহ বেসরকারি পাঁচটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে কেন করোনা টেস্টের অনুমোদন দেওয়া হলো? আবার কেনই-বা বাতিল করা হলো- এ প্রশ্নের নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। যদিও মানুষ যা বোঝার বুঝে ফেলেছে।  

করোনা টেস্ট নিয়ে দেশব্যাপী উদ্বেগ, হাহাকারের মধ্যে পাঁচটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরি পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হয়। মানুষ তখন আশায় বুক বেঁধেছিলো। অথচ আমরা সেই আশার প্রতিদানে কী পেলাম? রিজেন্ট-জেকেজির জালিয়াতি, সাহেদ-সাবরিনার কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে সেই অনুমোদন বাতিলও করা হলো। তাহলে কী দাঁড়ালো অর্থটা? বেসরকারি খাতে অনুমোদন দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান স্বাস্থ্যসেবা খাতে কোন পর্যায়ে- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরের অজানা নয়। করোনা টেস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে তাদের সামর্থ আছে কিনা- এ বিষয়টিও তাদের অজানা নয়। যদি তাই হয়, তাহলে সেটি দায়িত্বে আরো বড় অবহেলা!

ঘটনা পরম্পরায় সাহেদের গ্রেফতারের খবরের চেয়েও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মধ্যকার পারস্পরিক দোষারোপ আরো তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি যখন কোনো অপরাধের দায় সরাসরি তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় তখন তা শুধু ভাবনার নয়, উদ্বেগেরও। বিষয়টি কি নিতান্তই মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা? নাকি এর বাইরে আরো কিছু আছে?

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, চুক্তিতে কী লেখা ছিলো সেটা তিনি পড়ে দেখেননি। এই চুক্তি নিয়ে মিডিয়ায় কথা বলেছেন, রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের সময় সেখানে উপস্থিত থাকা দুই সচিব। তাদের বক্তব্যে যতোটা না তাদের উপস্থিতির ব্যাখ্যা আছে, তার চেয়েও বেশি আছে স্বাস্থ্যের ডিজিকে সমর্থন দেওয়ার চেষ্টা। মন্ত্রীকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টারও কমতি ছিলো না। স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘অধিদপ্তরে করোনাসংক্রান্ত বৈঠকের পর মন্ত্রীর অনুরোধেই ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম।’ একই কথা বলেন জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘‘স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বৈঠকের পর মন্ত্রী আমাদের চা খাওয়ালেন। এরপর বললেন, ‘আপনারা যেহেতু উপস্থিত আছেন, আপনারাও দাঁড়ান।’’

এর আগে শামিম, পাপিয়া, সম্রাট, খালেদসহ অনেকে ধরা পড়েছে। তাদের নিয়ে গণমাধ্যমে খবরের ছড়াছড়ি হয়েছে; যদিও ধরা পড়ার পর। এদের ধরার কৃতিত্ব র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। সরকারেরও। আবার বদনামও সরকারেরই। কারণ, তাদের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে বেড়ে ওঠার দায়ও যে সরকারের!

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গোড়া থেকে টেস্ট টেস্ট অ্যান্ড টেস্ট অর্থাৎ বেশি বেশি পরীক্ষার ওপর জোর দিলেও আমরা  উল্টো পথে হাঁটছিলাম। সারা বিশ্ব নমুনা পরীক্ষা অবারিত রাখলেও আমাদের টেস্ট ব্যবস্থা কুক্ষিগত ছিলো সাহেদদের কব্জায়। ফল যা হবার তাই হয়েছে। করোনা থেকে বাঁচতে মানুষ হাসপাতালে না গিয়ে বাসায় বসে চিকিৎসা নেওয়াকে নিরাপদ মনে করছেন। এর মাধ্যমে মানুষকে হাসপাতাল বিমুখ করায় সাফল্য এসেছে। ধুরন্ধররা এ পরিস্থিতিকে ‘মওকা’ হিসেবে নিয়েছে। করোনা হাসপাতালগুলোর অধিকাংশ বেড খালি! কয়েকদিন আগেও আইসিইউ না-পেয়ে মানুষ মারা গেলেও এখন সেখানে রোগী কম। হিসাব খুব সহজ- রোগী নাই তো করোনাও নাই। একটি শ্রেণি স্যাম্পল সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই নেগেটিভ-পজিটিভের বাণিজ্য নিশ্চিত করেছে। অথচ বিশ্বের কোনো দেশে এমন কোনো ডাক্তার জন্ম নেননি, যিনি কিট এবং টেস্ট ছাড়াই নমুনা পরীক্ষার রেজাল্ট দিতে পারেন। আমাদের সাহেদরা তা অবলীলায় করেছে। দেশের কপালে লাগিয়েছে কলঙ্কের তীলক।

এর আগে ডা. সাবরিনা ও তার স্বামীর প্রতিষ্ঠান জেকেজি করোনা টেস্ট নিয়ে একই জালিয়াতি করেছে। এলান করপোরেশন ডাক্তারদের ব্যবহারের জন্য ৫০ হাজার ভুয়া মাস্ক সরবরাহ করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছে। এসবের দায়টা গিয়ে পড়েছে সরকারের কাঁধে। অথচ আমরা দেখেছি করোনা মোকাবিলায় সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি ছিলো না। উদ্যোগের কমতি ছিলো না। তাহলে কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তি সরকারের প্রচেষ্টায় কালিমা লেপন করতে চায় তাদের মুখোশ উন্মোচনের এখনই সময়। অনেক প্রশ্নের উত্তর দেশবাসীর জানা দরকার।

ডা. সাবরিনার স্বভাব-চরিত্র, পোশাক, নাচ-গানের চেয়ে এখন জরুরি তার গডফাদারদের বিচারের আওতায় আনা। বিশেষ করে মহামারিতে স্বাস্থ্যখাতে মহাব্যবসার ফাঁদ তৈরির কুশিলবদের শনাক্ত করা। না-হলে এই দেশে একের পর এক সাহেদ, সাবরিনা জন্ম নেবে। ঘটনাচক্রে তারা ধরা পড়বে। পুনরায় নতুন সাহেদ, সাবরিনার জন্ম হবে। এই জন্ম প্রক্রিয়া সমূলে বিনাশ করা প্রয়োজন।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়