ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

নিশ্চিত হোক জিনিয়াদের নিরাপত্তা

ইবনুল কাইয়ুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৮, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৮:২৯, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০
নিশ্চিত হোক জিনিয়াদের নিরাপত্তা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বেশ কিছু উদ্বাস্তু মানুষের বাস। দীর্ঘদিন তারা টিএসসির আশপাশে বসবাস করে আসছেন। তাদের আয় রোজগারের উৎসও এই টিএসসি। টিএসসির পায়রা চত্ত্বর যেনো তাদের উঠোন- এতই আপন!

ঢাকা শহরের আর দশটি ভাসমান মানুষের চেয়ে এরা যেনো একটু আলাদা। চিন্তায়, মননে এমনকি মনুষ্যত্বের দিক থেকেও এরা ভিন্ন। ভাসমান মানুষের মধ্যে যেমনটা থাকে ঠিক তেমন নয়। অন্য অনেকের চেয়ে এরা সামাজিক, মিশুক এবং উদার। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, টিএসসির সাংস্কৃতিক বলয় এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার কারণে হয়তো এদের মনোজগতের এই পরিবর্তন। শুধু এরা নয়, এখানকার শিশুরাও এমন।

টিএসসিতে গিয়ে একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন ছিন্নমূল শিশুরা ছাত্রছাত্রীদের যেন পায়ে পায়ে হাঁটছে। কারও হাতে ফুল, মালা, ফুলের তৈরি মাথার ব্যান্ড, আবার কারও হাতে চকলেট। ছাত্রছাত্রীদের কাছে এদের আবদারের শেষ নেই। যেনো বড় ভাই বা বোনের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে আবদার জুড়েছে ছোটো ভাই বা বোন।

শিক্ষার্থীদের প্রচ্ছন্ন আদরও চোখে পড়ার মতো। বিরক্ত হওয়ার চেয়ে বরং এদের সঙ্গে নির্মল আড্ডা জুড়ে দিতে পছন্দ করেন অনেকে। আর এই আদর মাখা আড্ডার লোভে শিশুরা নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য (ফুল-চকলেট বিক্রি) ভুলে ভাইয়া-আপুদের সঙ্গে চলতেই বেশি পছন্দ করে।

এদেরই একজন জিনিয়া। নয় বছর বয়স। ক্যাম্পাসের সব শিক্ষার্থীই যেনো তার ভাইয়া-আপু। অন্যসব শিশুদের চেয়ে জিনিয়াকে সবাই একটু বেশি আদর-আহ্লাদ করে। নামের মতোই শিশুটি আক্ষরিক অর্থেই যেনো একটি ফুল।

২০১৮ সালের মাঝামাঝি। একদিন সন্ধ্যায় তরুণ অভিনেতা-নির্মাতা আহসান স্মরণ টিএসসিতে আড্ডা দিচ্ছিলেন। কোথা থেকে প্রায় ঝরতে বসা এক গোছা গোলাপ নিয়ে হাজির জিনিয়া। ‘ভাইয়া ফুল নাও’। স্মরণ বলেন, ‘টাকা নেই রে জিনিয়া। একটা সিনেমা বানাবো, বুঝলি? তাও টাকা নেই।’ এ কথা শুনে জিনিয়া তার জিন্সের প্যান্টের পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটি নোট বের করে স্মরণের হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘এটা দিয়ে সিনেমা বানাও।’

সেদিন সন্ধ্যায় স্মরণের চেহারা হয়েছিলো দেখার মতো। টিএসসির নিয়ন আলোয় টলটলে দিঘীর মতো চোখ নিয়ে জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলেন অনেক্ষণ। অব্যক্ত অনেক কথা তার অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠেছিলো। তিনি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। টাকাটা তিনি নিয়েছিলেন। যত্ন করে মানিব্যাগের গোপন কুঠুরিতে রেখেছিলেন।

সিনেমা বানাতে কত টাকা খরচ হয় সে সম্পর্কে শিশুটির বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে সে তার কাছে থাকা সব টাকা অন্যের হাতে তুলে দিলো। সেটা পরিমাণ দিয়ে বিচার্য নয়। এই দানে তার অভিব্যক্তিতে সামান্যতমও দ্বিধা ছিল না। ছিল না কোনো ভনিতা।

ওই বছরের শেষের দিকে শ্যুট হয় শর্ট ফিল্মটির। নাম দেওয়া হয় ‘আকাশে’। সেই সিনেমার প্রথম প্রোডিউসার হলো জিনিয়া। সিনেমার ক্রেডিট লাইনে ওর নামটি জ্বলজ্বল করে ভাসে।

এই জিনিয়ারা নিজেকে উজাড় করে দিতে জানে। তাই এদের পবিত্র ভালোবাসাকে পুঁজি করে এদেরকে নোংরা পথে ঠেলে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না তথাকথিত ভদ্র লোকেরা। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অপহরণ করা হলো মেয়েটিকে। নিষিদ্ধ পল্লিতে বিক্রির উদ্দেশ্যে বাচ্চাটিকে অপহরণ করা হয়। নির্ভয়ে যারা অপরকে বিশ্বাস করে তাদের বিশ্বাসকে বুঝি এভাবেই মেরে ফেলতে হয়!

জিনিয়াকে অপহরণের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ছিল প্রশংসনীয়। অপহরণের একদিন পরেই শিশুটিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্ধার করে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অপরাধীরাও ধরা পড়েছে। তাদের ঠাঁই হয়েছে কারাগারে।

তবে বিষয়টি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো- ভাসমান এই মানুষগুলোর ভালোবাসার প্রতিদানে কী দিচ্ছি আমরা? সেইসঙ্গে ভাসমান এই জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা বা পুনর্বাসন নিয়ে রাষ্ট্র কী ভাবছে সেটাও ভাববার বিষয়। এক জিনিয়া না হয় রক্ষা পেয়েছে, এরকম হাজারও জিনিয়া আছে- তাদের কপালে কী ঘটছে?

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়