ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পেঁয়াজ কাঁদায়, দায় কার

রনি রেজা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩৮, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১২:০৪, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০
পেঁয়াজ কাঁদায়, দায় কার

খুচরা বাজারে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম

এখন সেপ্টেম্বর মাস। শোকের মাস না হলেও বাঙালি এ মাসে কাঁদে। পেঁয়াজ কাঁদায়। গেল বছর সেপ্টেম্বর থেকেই শুরু হলো পেঁয়াজের দামের লাগামহীন দৌড়। কয়েক মাসের ব্যবধানে ৩০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা ছাড়িয়েছিল প্রতি কেজির মূল্য। দেশের নতুন পেঁয়াজ উৎপাদন হওয়ার পর একটু একটু করে কমে আবার সেই ৩০-এ ফিরেছিল বটে। কিন্তু তা আর স্থির হতে পারল না।

পেঁয়াজের মূল্য পুনরায় বাড়তে শুরু করেছে। গত ২০/২৫ দিনের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি মূল্য বেড়েছে। ৩০ থেকে ৭০/৮০ টাকায় পৌঁছে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতাদের মনে পুরনো শঙ্কা জাগ্রত হতে শুরু হয়েছে। এই শঙ্কাই সবচেয়ে ভয়ের। কারণ সবাই যখন বেশি করে পেঁয়াজ কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে, তখনই বেতাল হয়ে বাড়তে থাকবে পেঁয়াজের দাম। কোনো কারণ ছাড়াই তখন দাম দ্বিগুণ থেকে পাঁচগুণ হতে সময় লাগবে না।

বরাবরের মতোই পেঁয়াজের এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য ভারতের বাজারকে দায়ী করছেন দেশের বিক্রেতারা। তারা বলছেন, ‘ভারতে বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে বেঙ্গালুরে নতুন পেঁয়াজের আবাদ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। দেশে সেপ্টেম্বরে এ সময় ভারত থেকে যে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়, তা বেঙ্গালুরের এই নতুন পেঁয়াজ। নতুন পেঁয়াজ হওয়ায় দাম কম থাকে। দেশের বাজারেও কম দামে এ পেঁয়াজ পাওয়া যায়। কিন্তু বেঙ্গালুরের এ পেঁয়াজের আবাদ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভারতের অন্য এলাকার পুরোনো পেঁয়াজ এখন আমদানি করা হচ্ছে। আর পুরোনো পেঁয়াজের দাম বেশি। দেশের পেঁয়াজের বাজারে এসবের একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’

খুবই যৌক্তিক কথা। কিন্তু গত সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত রয়েছে, আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। পেঁয়াজের সংকট বা মূল্য বাড়ার কোনো সঙ্গত কারণ নেই।’ এই সংবাদে বিশ্বাস করে যারা পেঁয়াজ কিনে রাখেননি তারাই ঠকেছেন। ওই খবর প্রকাশের পরও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। হয়তো এসব কারণেই ক্রেতা শঙ্কিত হয়ে কারণে-অকারণে যে কোনো কিছু কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। লবণের দাম বৃদ্ধির গুজব এবং করোনার শুরুতেও আমরা এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি লক্ষ্য করেছি। গত সপ্তাহে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে এও বলা হয়েছিল- ‘পেঁয়াজের অবৈধ মজুত বা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে মূল্য বাড়ার চেষ্টা করা হলে সরকার আইন মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিম এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করা হয়েছে।’

কিন্তু এরপরও দাম বেড়েছে। হয়তো আরো বাড়বে। একটি দেশে পরপর দুই বছর একই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে অথচ কোনো প্রতিকার নেই! গেল বছর পেঁয়াজের এমন ঝঁঝালো রূপ দেখার পর কি সংশ্লিষ্টদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল না? যেন পরবর্তীতে এমন পরিস্থিতি আর তৈরি না হয় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল না? যে কোনো সাধারণ নাগরিকও এক বাক্যে বলবেন- নিশ্চয় ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা সেই উচিত কাজটি করেননি। অথবা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ তাদের সস্তা বক্তব্য তৈরি আছে। যা বলে দায় সারতে পারবেন অনায়াসে। সমীকরণ বলে দেশে দিনে দিনে পেঁয়াজের ফলন বাড়ছে। চাহিদাও বাড়ছে। তবে ফলন বৃদ্ধিও ভালো। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয় ৭.৩৫ লাখ মেট্রিক টন। ১০ বছরের ব্যবধানে উৎপাদন বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে হয় ১৭.৩৮ লাখ টন। এ হিসাবে ১০ বছরের ব্যবধানে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে ১৩৬ শতাংশ বা ২.৩৬ গুণ। এ সময়ে হেক্টরপ্রতি ফলন ৬.৮১ টন থেকে বেড়ে ৯.৭৬ টন হয়েছে। মূলত নতুন জাত ও উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। গত পাঁচ বছরে পেঁয়াজের উৎপাদন ১৭ থেকে ১৮ লাখ মেট্রিক টনে স্থিতিশীল রয়েছে। কিন্তু এই সময়ে আমদানির পরিমাণ বেড়েছে অনেক বেশি।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১.৩৪৭ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হলেও, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০.৬৪৩ লাখ টন। এ হিসাবে ১০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে ২.৩৬ গুণ আর আমদানি বেড়েছে ৭.৯ গুণ। আর এ আমদানি-নির্ভরতা বাড়ার কারণেই কোনো কারণে আমদানিতে ঘাটতি হলেই দেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে যায়। শুধু আমাদের দেশ নয়, প্রতিটি দেশই কোনো না কোনোভাবে অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকে। কোনো না কোনো পণ্য আমদানি করতে হয়। তাই বলে এভাবে নিশ্চিত অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করে না। গত বছরের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অবশ্যই এ বছর অন্য দেশের সঙ্গে আমদানি চুক্তি করে রাখা উচিত ছিল। যেটা গতবছর ভারতের রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর করতে হয়েছিল। সেটি না করে কিসের আশায় এ বছরও সংশ্লিষ্টরা নির্বিকার রয়েছেন বোধগম্য নয়।

যে কোনো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে অসৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজি। ধান, পাট, পেঁয়াজ, মসলা; যে পণ্যেরই দাম বাড়ুক শেষে জানা যায় অসৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে এসব হয়েছে। দেশে পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও চড়া দামে কিনতে হয় নাগরিকদের। কর্তৃপক্ষ মিডিয়ার সামনে সেগুলো বলেই পার। কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। গত বছরও দেখা গেল- ভারত অভ্যন্তরীণ সমস্যা দেখিয়ে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই দাম আকাশচুম্বী হতে শুরু করলো। আগে থেকে যা আমদানি করা ছিল সেগুলোও আটকে ফেললো ব্যবসায়ীরা। পরবর্তীতে সেসব পেঁয়াজ পঁচিয়ে ফেলে দেওয়ার খবরও গণমাধ্যমের কল্যাণে জেনেছি। তবু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বছরও একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চললেও ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে গৃহীত কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই যা হবার হবে। এ যেন নিয়তির খেলা!

লেখক: সাংবাদিক

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়