ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

করোনা সংকটে শিক্ষকদের নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ ভাবনা

ড. মো. মাহমুদুল হাছান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৪, ৬ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৭:৩৫, ৬ অক্টোবর ২০২০
করোনা সংকটে শিক্ষকদের নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ ভাবনা

২০২০ সালের বিশ্ব শিক্ষক দিবস বিশ্ব ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও স্মরণীয় দিন। জাতিসংঘ কর্তৃক দিবসটি ঘোষণার পর এ পর্যন্ত  যে উৎসাহে দিনটি পালিত হয়েছে, এ বছর এটি হলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কোভিড-১৯ এর ভয়ানক প্রভাবে বিশ্বের কোনো দেশের পক্ষেই দিবসটি অন্যান্য বছরের মতো উদযাপন করা যায়নি। আর এ কারণেই হয়তো এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে: ‘শিক্ষক: সংকটে নেতৃত্ব, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা’। বিশ্বের এ সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে শিক্ষা ব্যবস্থার উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তাতে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবার এখন উপযুক্ত সময়। এ জন্য শিক্ষকদের আদর্শিক নেতৃত্বের বিকল্প নেই।

এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে এ কথা বলা মোটেই অত্যুক্তি হবে না যে, শিক্ষক সমাজ জাতি গঠনের কাণ্ডারি। তাদের মেধা, মনন ও প্রতিভার বাস্তব অনুশীলন করার সুযোগ পেলে সমাজ হয়ে ওঠে আলোকিত ও শিক্ষার ফল হয় অবশ্যাম্ভাবী। করোনার এ মহামারিতে বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রে শিক্ষা ধারা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রায় দেড় বিলিয়ন শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রায় ৬৩ মিলিয়ন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাকার্যক্রম হয়েছে চরমভাবে ব্যাহত। শিক্ষা ব্যবস্থার এমন নাজুক পরিস্থিতিতে শিক্ষক গোষ্ঠী যদি তাদের শক্ত নেতৃত্বের হাতকে বাড়িয়ে না দিতেন তাহলে শিক্ষার মেরুদণ্ড একেবারেই হয়তো ভেঙে পড়ত। কিন্তু শিক্ষকদের নিরলস পরিশ্রম, পেশাদারিত্বের সততা, কর্তব্যপরায়ণ বোধ, একনিষ্ঠ মনোভাব আমাদের শিক্ষা ধারাকে সচল রাখতে কার্যকরি ভূমিকা পালন করেছে।

কোভিড-১৯ মহামারির এ সংকটকালে শিক্ষকদের নেতৃত্ব শুধু সাময়িকই নয়, বরং এতটাই সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী যে শিক্ষকদের সম্পূর্ণ নব্য স্বাভাবিকতায় নিজেদের খাপ খাইয়ে শিক্ষার আধুনিক ধারা অব্যাহত রাখতে হয়েছে। অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাপ্রদান, ছাত্রছাত্রীদের পড়ার টেবিলে বসানো, অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখাসহ শিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল রাখা হলো শিক্ষকদের একটি বড় চ্যালেঞ্জ ও নেতৃত্বের সঠিক মান সমুন্নত রাখার অন্যতম প্রমান উপায়। সংকটকালীন এ মুহূর্তে বিশ্ব শিক্ষক দিবস এ কথারই সুস্বীকৃতি দেবে যে শিক্ষার স্থিতিস্থাপকতা, প্রাণোচ্ছলতা, গতিশীলতা এবং শিক্ষা পেশার ভবিষ্যৎ নিশ্চিতকরণে শিক্ষকদের নেতৃত্বই মোক্ষম।

করোনার এ সংকট এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে শিক্ষকদের নেতৃত্বের গুণাবলী,  সৃজনশীলতা, নতুনত্বের আবিষ্কার ও আধুনিকতার প্রতি আকর্ষণ শক্তি আরো বেড়ে গেছে। সমগ্র বিশ্বের মতই আমাদের দেশের শিক্ষকরা কখনও ব্যক্তিগতভাবে আবার কখনোবা সমষ্টিগতভাবে সমস্যার মোকাবিলা করেছেন এবং শিক্ষার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে শিক্ষা ধারা অব্যাহত রাখতে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাক-নোটিশ ছাড়া বা অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে শিক্ষার সকল সামগ্রী জোগাড় করে শিক্ষা কার্যক্রমকে সচল রেখেছেন। কখনো কারিকুলামের মধ্যে সামান্য পরিবর্তন এনে বা সিলেবাসকে পরিমার্জিত করে দ্রুত লেসন প্ল্যান প্রস্তুত করে শিক্ষার্থীদেরকে পড়াশোনায়  মনোনিবেশ করানো চ্যালেঞ্জিং হলেও তারা তা করতে সক্ষম হয়েছেন। উপযুক্ত পরিসরে ইনটারনেট সংযোগ স্থাপন করে মোবাইল বা কম্পিউটারের মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম চালানো, এমনকি কখনো কখনো রেডিও বা টিভিতেও তারা ক্লাস নিয়ে সম্প্রচার করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করে ছেড়ে দিচ্ছেন, ফলে শিক্ষার্থীরা সময়মত দেখে তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারছে। 

অনেক শিক্ষাবিদ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে চলমান রাখতে ভবিষ্যতের জন্য অল্প মেয়াদি, মধ্যম মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি শিক্ষার কর্ম পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়বের পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে করে করোনার অভিশাপ দূর হলে শিক্ষার্থীরা আবার শ্রেণী কক্ষে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। অতীতে দেখা গেছে দেশের যে কোনো দুর্যোগের মুহূর্তে শিক্ষক সমাজ তাদের কর্মকাণ্ডে অবিরাম সংগ্রাম করেছেন এবং জাতিকে ভবিষ্যত সম্পর্কে আশা জাগিয়েছেন। এবারও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটছে না। দেশের অনেক মফস্বল এরিয়াতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের যথাযথ ইন্টারনেট সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা, প্রযুক্তিগত ডিভাইসের অভাব, আর্থিক সমস্যার কারণে ডাটা সমস্যা ইত্যাদি নানাবিধ অসুবিধা থাকার পরেও আমাদের শিক্ষকেরা অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি বাড়ি গিয়েও পাঠ প্রদানে ব্যস্ত থেকেছেন।

আমরা জানি করোনার এ সমস্যা চিরকাল থাকবে না, কিন্তু দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষা ব্যবস্থার যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং আবার ঘুরে দাঁড়াতে শিক্ষকদের যোগ্য নেতৃত্ব অনেক বেশি প্রয়োজন। আর এ জন্য শিক্ষকদের মোটিভেশন ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও অন্যান্য শিক্ষাকর্মীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংকটকালীন শিক্ষকদের মেধা, পরিশ্রম ও সঠিক নেতৃত্বকে পৃষ্ঠপোষণ না করলে আগামী প্রজন্ম তাদের প্রকৃত দিক নির্দেশনা সংকটে পড়বে। জাতীয়ভাবে দেশ অনেক ক্ষতির মধ্যে নিমিজ্জিত হবে। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে শিক্ষক শুধু শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ও শিখন ফল লাভের জন্যই অবদান রাখে না, বরং  শিক্ষকদের নেতৃত্ব ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গঠন, কারিকুলাম উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি, মনিটরিং ক্ষমতা, ও মূল্যায়ন পদ্ধতির মান বৃদ্ধিতে অনেক বেশি অবদান রাখেন। এমনকি যারা পৃথিবীতে অনেক বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত আছেন, তারা তাদের শিক্ষকদের আমৃত্যু একজন পথপ্রদর্শক ও মেনটর হিসেবে ধারণ করেন। এটি শিক্ষকদের গর্ব। বৈশ্বিক  মহামারি অতিক্রান্ত হলেও দেশ ভবিষ্যতে যে মহা সংকটে পড়তে পারে এবং শিক্ষকদের নেতৃত্ব হতে পারে তখনকার একমাত্র অবলম্বন বিষয়টি সকলের কাছে স্পষ্ট। সুতরাং দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিম্নের পদক্ষেপগুলি গুরুত্বপূর্ণ:

কমিউনিটি লেভেলের নেতৃত্ব

পোস্ট প্যান্ডেমিক সময়ে আমাদের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে কারিকুলাম প্রণয়ন, সিলেবাস সংকোচন, বিষয়বস্তুতে করোনায় সংক্রান্ত তথ্যাদি ও তার প্রভাব, পাঠ্যপুস্তক মূল্যায়ন পদ্ধতি বিশ্লেষণসহ অন্যান্য  বিষয়ের প্রতি সংগতি স্থাপন করা জরুরি হতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধান তিনটি সংগতি নির্ণয় করা যেতে পারে; ক. আভ্যন্তরীণ সাধারণ শিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষার বিভিন্ন বিভাগ উপ-বিভাগের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি; খ. শিক্ষার বিভিন্ন স্তর যেমন শিশুশিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা এবং জীবনমুখী শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি; গ. সাধারণ, উপ-আনুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাঝে সঙ্গতি স্থাপন। কমিউনিটি লেভেলে শিক্ষকদের নেতৃত্ব বলতে তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিক্ষাদান ও শিক্ষক শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন পদ্ধতির মাঝে সমন্বয় সাধন করা। কারণ, করোনা পরবর্তী কালে আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হওয়ায় শিক্ষকদের নেতৃত্বকেও আপডেটেড করতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক লেভেলের নেতৃত্ব

প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ পর্যায়ের নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জাতীয় নেতৃত্বে শিক্ষককে নিজের পাঠদান কার্যক্রম ছাড়াও আভ্যন্তরীণ অনেক প্রশাসনিক কাজে যুক্ত হতে হবে। যেমন ভর্তি সংক্রান্ত কাজ, আউটডোরের কাজ, উন্নয়নধর্মী বিভিন্ন কমিটি, যেমন ক্লাব কার্যক্রম, শিক্ষকদের প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট কমিটি ইত্যাদিসহ প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ ভেতর বাহিরের কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে সবকিছু সম্পন্ন করা। এছাড়াও শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করা, অনলাইন শিক্ষা সামগ্রী সংগ্রহ করা, ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদানে দক্ষতা অর্জন, পেশাদারি নিষ্ঠতা অবলম্বন, গার্ডিয়ানদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাসহ অন্যান্য নানাবিধ কাজে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মাঝেমধ্যে শিক্ষার্থীদের বাসা বা বাড়িতে গিয়ে তাদেরকে মোটিভেশন দেওয়া ও তাদের পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা শিক্ষকদের নেতৃত্ব প্রদানের বড় একটি উদাহরণ।

ক্লাসরুম লেভেলের নেতৃত্ব

ক্লাসরুম বা শ্রণিকক্ষের নেতৃত্ব বলতে শুধু কাঠামোবদ্ধ শ্রেণিকক্ষের নেতৃত্ব বোঝায় না বরং এটি অনলাইন বা ভার্চুয়াল বা ডিজিটাল ক্লসরুমের নেতৃত্বও বোঝায়। বর্তমানে বিশেষ করে প্যান্ডেমিক বা তৎপরবর্তীকালের ক্লাসরুমের নেতৃত্ব প্রদানে শিক্ষকদের অনেক বেশি দক্ষতা অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। এখানে শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অংশগ্রহণ করে, আর শিক্ষক যে কোনো এক জায়গা থেকে পাঠদান করে থাকেন এবং তা নিয়ন্ত্রণ করেন। এটি স্বভাবতই চ্যালেঞ্জিং এবং প্রযুক্তি সমৃদ্ধ। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা এলএমএস-এর মাধ্যমে পাঠদান, তথ্য প্রযুক্তির যাবতীয় টুলস ব্যবহার, ব্লেন্ডেড লার্নিং পদ্ধতিতে পাঠদানসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় পারদর্শী হতে হয় এবং এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নেতৃত্ব গঠনে সহায়ক ভুমিকা পালন করে।                  

বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় আমাদের শিক্ষকদের প্রবল নেতৃত্ব আমাদের আগামী সমাজকে করে তুলবে আলোকিত ও টেকসই এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: অধ্যক্ষ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়