ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

গান নিয়ে টানাটানি

সোহরাব শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৮, ২০ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ২০:২২, ২০ অক্টোবর ২০২০
গান নিয়ে টানাটানি

হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে আমার একলা নিতাই

(আমার) একলা নিতাই, একলা নিতাই, একলা নিতাই, একলা নিতাই।।   

আমার নিতাই যদি- ডাক রে নিতাই গৌর বলে
নিতাই যদি
যদি মনে করে, ও নিতাই গৌর দিলি দিতি পারে একলা নিতাই।।

আমার নিতাই নিদ গৌর- ডাক রে নিতাই গৌর বলে
নিতাই নিদ গৌর
নিত্য কল্পতরু, ও নিতাই প্রেমদাতা জগতের গুরু একলা নিতাই।।

উল্লেখিত গানটি শুনেছি পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় লোকসংগীত শিল্পী (জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়) প্রয়াত অমর পালের কণ্ঠে। প্রথমবার শুনে চমকে উঠেছিলাম, আরে এ তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ গানের নকল! পরে অবশ্য জেনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান নকল করে গাওয়া নয় বরং রবীন্দ্রনাথই ‘হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে’ গানটির সুর নকল করেছিলেন।

বাংলা উইকিপিডিয়াও সে সাক্ষী দিচ্ছে: ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’, যা ‘একলা চলো রে’ হিসেবে সাধারণভাবে পরিচিত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারা রচিত একটি বাংলা দেশাত্মবোধক গান। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ভাণ্ডার’ পত্রিকায় ‘একা’ শিরোনামে গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গানটি ‘হরিনাম দিয়ে জগত মাতালে আমার একলা নিতাই রে’, নামক একটি জনপ্রিয় মনোহরশাহী ঘরানার বাংলা ধাপকীর্তন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। অপরের সহায়তা না থাকলেও বা অপরের দ্বারা ত্যাজ্য হলেও শ্রোতা যাতে তার যাত্রা বন্ধ না করেন, তার অনুপ্রেরণা হিসেবে এই গান রচিত হয়। মহাত্মা গান্ধী এই গানের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং এটিকে তিনি তাঁর অন্যতম প্রিয় গান হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

‘হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে আমার একলা নিতাই’-এর সঙ্গে ‘একলা চলো রে’র কথা পাশাপাশি দেখলে/ শুনলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।

‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে॥

যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়-
তবে পরাণ খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে॥

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ১৯০৫ সালে রচিত আরও একটি বিখ্যাত গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, সেটিও অন্য একটি গানের সুর নকল করে গাওয়া হয়েছে। বাউল গায়ক গগণ হরকরার গান ‘আমি কোথায় পাব তারে’ থেকে এই গানের সুর ও সংগীত উদ্ভূত। ‘আমার সোনার বাংলা’ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর থেকে আমাদের জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।

বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে জনপ্রিয় আরেকটি গানের কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে একটি শব্দ বদলে দিয়ে কীভাবে গানটির ‘মুসলমানি’ করা হয়েছে! ‘আমার মুর্শিদ পরশমণি গো লোহারে বানাইলা কাঞ্চা সোনা’- গানটি গ্রামাঞ্চালে বিশেষত বাউলদের প্রায়ই গাইতে শোনা যায়। প্রয়াত জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে গানটি বহুল প্রচলিত। ফোক সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগমসহ লোকধারার অনেক শিল্পীই গানটি গেয়েছেন।

বছর তিনেক আগের ঘটনা। আমার পরিচিত এক হিন্দু কন্যাশিশুর ক্যানসারে মৃত্যুর পর গ্রামে ওঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে গিয়ে গানটি শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। সেখানে গাওয়া হচ্ছিল ‘আমার গৌর পরশমণি গো লোহারে বানাইলা কাঞ্চা সোনা’। পরবর্তীতে লোকসংগীত গবেষক প্রয়াত মাহবুব পিয়ালের কাছ থেকে জেনছি, গানটির আদি রূপে ‘গৌর পরশমণি’ কথাটিই পাওয়া যায়। পরবর্তীতে মুসলমান বাউলরা গৌরের স্থলে মুর্শিদ শব্দ বসিয়ে গেয়ে আসছেন।

পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ‘নিশিথে যাইও ফুল বনে রে ভ্রমরা’ গান নিয়েও অভিযোগ আছে প্রচলিত লোকগানের কথা পাল্টে দেওয়ার। শচীন দেব বর্মণের গাওয়া জনপ্রিয় গানটি আসলে বৃহত্তর সিলেটের (বর্তমান হবিগঞ্জ জেলা) বামৈ ইউনিয়নের ভাদিকারা গ্রামের প্রখ্যাত সূফী সাধক শেখ ভানুর (র.) গানের বিকৃত রূপ! শেখ ভানুর অসংখ্য গান বৃহত্তর সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ময়মনসিংহসহ সারা দেশে আজো প্রচলিত। গানের পার্থক্য বুঝতে আমরা প্রথমে পল্লীকবির লেখা গান ও পরে শেখ ভানু রচিত আদি গানটি দেখব।

ওরেও ভ্রমরা
নিশীথে যাইও ফুল বনেরে ভ্রমরা।।

জ্বালাইয়া চান্দের বাতি জেগে রব সারা রাতি গো
কব কথা শিশিরের সনেগো ভ্রমরা।।

যদি বা ঘুমায়ে পড়ি স্বপনের পথ ধরি গো
তুমি নীরব চরণে যাইওরে ভ্রমরা।।

শেখ ভানুর বাণী এরকম:

নিশাতে যাইও ফুল বনে রে ভ্রমরা
নিশাতে যাইও ফুল বনে।।

জ্বালাইয়া জ্ঞানের বাতি ফুল ফুঁটাইয়ো না নান জাতি ও
কত রঙে ধরে ফুলের কলি রে।।

নয় দরজা কইরা বন্ধ লইয়া ফুলের গন্ধ
অন্তরে লইয়ো বন্ধের নাম রে।।

গাছ বিরিক্ষের পাতা নাইয়ো এমন ফুল ফুটাইলেন সাইও
ভাবুক ছাড়া বুঝেনা পন্ডিতে রে।।

ভাবিয়া শেখ ভানু বলে ঢেউ খেলাইছে আপন দিলেও
গঙায় যেমন ভাসে পদ্ম ফুল রে।।

উল্লেখিত উদাহরণগুলো থেকে আমরা কোনোভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার বাউলদের, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন কিংবা শচীন দেব বর্মণকে দোষী বলতে পারি না। এমন বলা হবে মূর্খতা। আসলে হাজার নদীর পলিমিশ্রিত বাংলাদেশের মানুষের মন বড় নরম। এটা সুরেরও দেশ। এখানে নিজস্ব সৃজনশীলতায় যেমন মানুষ তার মনের আবেগ প্রকাশ করে, তেমনি আশ্রয় নেয় অন্যের সৃষ্টির। গানের সুর নকল বা কথার পরিবর্তন সেভাবেই হয়। লোকগানের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও স্বাভাবিক। খোঁজ নিলে দেখা যাবে একই সুরে অনেক গান রয়েছে।

বাংলা সিনেমায়ও দেখা মেলে বিদেশি; বিশেষত হিন্দি সিনেমার গানের নকল। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়’-এর সুর তুরস্কের একটি জনপ্রিয় গান দ্বারা প্রভাবিত (গানটির কথা আমি স্পষ্ট লিখতে পারব না, এ আমার অক্ষমতা)!  

যে কারণে গান বিষয়ক আলোচনা- সেটা বলা দরকার। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুরে একটি নিজস্ব সংগীত রচনা করে শিশু শিক্ষার্থীদের দিয়ে গাওয়ানোর অভিযোগে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার সিদ্ধেশ্বরী দারুল কুরআন আল আরাবিয়্যাহ মাদরাসা বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। রোববার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে উপজেলা প্রশাসন পুলিশ নিয়ে ওই মাদরাসায় গিয়ে সাময়িকভাবে মাদরাসাটি বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মুরাদনগর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা অভিষেক দাশ।

জানা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের আদলে ‘আমার দয়ার আল্লাহ’ শিরোনামে নিজস্ব সংগীত সুর করে শিক্ষার্থীদের দিয়ে গাওয়ানোর পর গত সপ্তাহে মাদরাসার মুহতামিম নাজিবুল্লাহ আফসারী তার ফেসবুক আইডিতে সেটি পোস্ট করেন। এ সংগীতের পুরো সুরটি জাতীয় সংগীতের আদলে। নিজের এই সংগীত তিনি ১৩ অক্টোবর ফেসবুক আইডিতে শেয়ার করেন। এরপর ১৫ অক্টোবর তার ইউটিউব চ্যানেল ‘নাজিবুল্লাহ টিভি’তে আপলোড করেন। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে গত শনিবার তিনি পোস্ট সরিয়ে নেন।

এদিকে সোমবার ওই মাদরাসা শিক্ষক তার ফেসবুকে পোস্টে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় বিষয়টির জন্য দুঃখ প্রকাশসহ দেশবাসী ও প্রশাসনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে জানান- ‘প্রচলিত আইনটির বিষয়ে তার অজ্ঞতার কারণেই তিনি জাতীয় সংগীতের সুরে একটি ইসলামিক গান তৈরি করেন। এ সংগীতটি ফেসবুকে ও ইউটিউবে পোস্ট করার পর অনেকেই এটাকে জাতীয় সংগীত বলে মন্তব্য করে, প্রকৃতপক্ষে তিনি কখনোই তা জাতীয় সংগীত বলে অবহিত করেননি।’ (সূত্র: জাগো নিউজ)

এই লেখার উদ্দেশ্য দুইটি। এক. প্রচলিত গানের সুরে প্যারোডি বা গান রচনা নতুন কিছু নয়। বিখ্যাত মানুষরাও এমনটি করেছেন এবং আমরা তা গ্রহণও করেছি। গানের সুর নকল করার ব্যক্তিগত ‘অপরাধে’ একটি মাদরাসা তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। দুই. জাতীয় সংগীত আমাদের শ্রদ্ধার বিষয়, ভালোবাসা ও আবেগের গান। এই গান নিয়ে দুষ্টুমি-ফাজলামো নিন্দনীয়। কথা পাল্টে দিয়ে নতুন কোনো গানকে ‘জাতীয় সংগীত’ ঘোষণা দেওয়ার স্পর্ধা কারও হওয়াও উচিত নয়। কুমিল্লার মাদ্রাসা শিক্ষক ইচ্ছাকৃত এমন করে থাকলে তদন্ত স্বাপেক্ষে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিচার হোক। যদিও ওই শিক্ষক ভিডিও বার্তায় দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনাসহ দাবি করেছেন, ভাইরাল হওয়া প্যারোডি গানটিকে কখনোই তিনি জাতীয় সংগীত বলে অবহিত করেননি।
   
লেখক: সাংবাদিক

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়