ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

শুভ জন্মদিন, গণঅভ্যুত্থানের নন্দিত নায়ক!

মো. আসলামুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ২২ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৯:৫৭, ২২ অক্টোবর ২০২০
শুভ জন্মদিন, গণঅভ্যুত্থানের নন্দিত নায়ক!

জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের যে রক্তঝরা পথ ধরে আজকের এই স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, সেসব কিছু অর্জনের ড্রেস রিহার্সাল ছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান; সেই গণঅভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদের আজ জন্মদিন (২২ অক্টোবর)।

বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের যে ঐতিহাসিক পরম্পরা তার বিশাল এক জায়গা জুড়ে আছে এই নন্দিত নায়কের অবস্থান। তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল তা বাঙালির ইতিহাসের এক অনন্য, অসাধারণ দিন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া এমন গণজোয়ার প্রত্যক্ষ করেনি জাতি। এই সফল গণজাগরণই মূলত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শক্ত ভিত তৈরি করে দিয়েছিল জাতিকে। এই গণআন্দোলন একদিকে বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যেমন মুক্ত করেছিল, আবার অন্যদিকে পতন ঘটিয়েছিল স্বৈরাচারী সেনাশাসক আইয়ুব খানের। এই অসাধারণ নেতৃত্বগুণে মুগ্ধ হয়েই বঙ্গবন্ধু তোফায়েল আহমেদকে খুব অল্প বয়সে আওয়ামী লীগে নিয়ে আসেন।

৬৯’এর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী নেতা তোফায়েল আহমেদ মাত্র এক বছরের মাথায় ১৯৭০ সালেই আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধুর সেই আস্থা ও বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে এখনো রাজনীতির ময়দানে সততা ও আদর্শের চর্চা করে যাচ্ছেন তোফায়েল আহমেদ। আর তাইতো দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেকবার কারা নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার সহ্য করেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রশ্নে তিনি কখনো মাথা নত করেননি।

বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের শুরু অনেক আগে থেকে হলেও, দেশভাগের পর তা এক নতুন মাত্রা পায়। নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে। ’৫২-এর রক্তধারা ’৬৯-এর রক্তস্রোতে মিশে ’৭১-এ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে এক নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।

এক্ষেত্রে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সৃষ্ট গণজোয়ার আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কতটুকু ত্বরান্বিত করেছিল, সে বিষয়টি জানতে ও বুঝতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহের দিকে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলেও বাঙালি তার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার লাভ করতে পারেনি। ভাষা আন্দোলন এবং ৫৪’র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বাঙালিকে সাময়িক সুযোগ সৃষ্টি করে দিলেও বাঙালির ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার কমেনি। ১৯৬৬ সালে এমনি এক উদ্ভুত পরিস্থিতির ওপর দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা রূপে আবির্ভূত হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির এই ক্রান্তিকালে বঙ্গপিতা ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা। কিন্তু ছয় দফাকে কোনোভাবেই মানতে রাজি ছিল না পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী।

এদিকে ছয় দফা ঘোষণার পর স্বাধিকার আন্দোলনের গতি তীব্রতা পায়। এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিতে ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সময়ের মধ্যে প্রায় ৩৩ মাস বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে আটক রাখে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল সময়টায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও আইয়ুব খানের পদত্যাগের দাবিতে তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বেই দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। এই সময়ের গণআন্দোলনের পুরোটা সময় জুড়ে তোফায়েল আহমেদের কথাই ইতিহাসে বার বার উঠে আসে।

১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ডাকসুর ভিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তোফায়েল আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও স্বাধিকার আন্দোলনকে বেগবান করতে তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ছয় দফাকে হুবহু ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে ’৬৯-এর মহান গণআন্দোলন শুরু করেন তারা। শিক্ষার্থীদের সমস্যা, শ্রমিকদের সমস্যা, জাতির পিতার প্রণীত ছয় দফাকে অন্তর্ভুক্ত, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার, রাজবন্দিদের মুক্তিসহ একটি সর্বাঙ্গীণ সব শ্রেণির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্র সমাজের ১১ দফা প্রণয়ন হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান তথা তৎকালীন স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে এই সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সব আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা শহর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলেও তাদের ঘোষিত কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বাধীনতাকামী বিভাগীয় শহর এবং জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ওইসব শহরগুলোর ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন। এর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রদের একাংশ ও কয়েকটি ছাত্র সংগঠন পরিষদের এগারো দফার সমর্থনে আন্দোলন করে। ছাত্রদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সাড়া পড়ে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতে ছাত্রদের আন্দোলন তথা সংগ্রাম পরিষদ এক প্রকার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। শিক্ষার্থীদের এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হিসেবে পরিচিতি পায়। এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে, স্থান করে নেয় বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে।

স্বাধিকার আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে পাকিস্তান সরকার যে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে তাও ভেস্তে যায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। অবশেষে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র সব রাজবন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয় পাকিস্তান সরকার। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে এক জনসভার ডাক দেওয়া হয়। প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে এই জনসভার সভাপতি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আর ’৬৯-এর ২৫ মার্চের মধ্যে তথাকথিত লৌহমানব স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে গৌরবের যে ইতিহাস সৃষ্টি করেন, তা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সেল।

তোফায়েল আহমেদ কলেজ জীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তোফায়েল আহমেদ ব্রজমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক ও কলেজের হোস্টেল অশ্বিনী কুমার হলের সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হন ১৯৬২ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ১৯৬৪ সালে বর্তমান ইকবাল হলের ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক, ১৯৬৫-তে মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের সহসভাপতি ও ১৯৬৬-৬৭-তে ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন।

পরে ডাকসু’র ভিপি ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অসাধারণ নেতৃত্বগুণে অল্প ক’দিনের মধ্যেই সারাদেশে পরিচিত লাভ করেন তোফায়েল আহমেদ, দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও আস্থাও অর্জন করেন। স্বীয় কর্মগুণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সাহচর্যে আসেন তিনি। ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে ভোলার দৌলতখান-তজুমদ্দিন-মনপুরা আসন থেকে মাত্র ২৭ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ‘মুজিব বাহিনী’র অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত চার প্রধানের একজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তোফায়েল আহমেদ। ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম সংগঠকও তিনি। দেশ স্বাধীনের পর সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশ নেন তোফায়েল আহমেদ। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলে ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তোফায়েল আহমেদকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ করা হয়।

১৯৭৫ সালে দেশে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার ঘোষণার পর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় ‘রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী’ নিযুক্ত হন তোফায়েল আহমেদ। ১৯৭৫-এ দেশের সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ সংক্ষেপে ‘বাকশাল’ গঠিত হয়। বাকশালের যুব সংগঠন ‘জাতীয় যুবলীগ’-এর সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন তোফায়েল আহমেদ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, উল্টে যায় জাতির গতিপথ। জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর তোফায়েল আহমেদকে প্রথমে গৃহবন্দি ও পরে পুলিশ কন্ট্রোল রুম এবং রেডিও অফিসে নিয়ে খুনিরা অবর্ণনীয় শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করে। সেই সময়টাতে একের পর এক গ্রেফতারের মুখোমুখি হতে হয় তোফায়েল আহমেদকে। ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলার কারাগারে বন্দি অবস্থায় দীর্ঘ ৩৩ মাস তিনি কারান্তরালে ছিলেন।

১৯৭৮ সালে কুষ্টিয়া কারাগারে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন তোফায়েল আহমেদ। দীর্ঘ ১৪ বছর এই পদে থাকাকালীন সাফল্যের সঙ্গে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন মেয়াদে চারবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবেও তিনি দীর্ঘ ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন পর্যন্ত সাতবার সংসদ সদস্য ও নানা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এই নেতা।

দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপজেলা ভোলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের সন্তান তোফায়েল আহমেদ, যিনি তার নিজ কর্মগুণে এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসের এক জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের এক বড় অধ্যায়জুড়ে আজ তোফায়েল আহমেদ। যতদিন এই দেশ থাকবে, থাকবে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস; সেই ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন আমাদের প্রিয় নেতা তোফায়েল আহমেদ।

এই মহান মানুষটির জন্মদিনে আমাদের চাওয়া থাকবে এটুকুই; এমন দিন বা এমন নেতার জন্ম যেনো আরো প্রত্যক্ষ করে আমার এই সোনার বাংলা, তবেই সম্ভব বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক বাংলাদেশ গঠন, সম্ভব শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা গঠন।

লেখক: মো. আসলামুল হক, সংসদ সদস্য, ঢাকা-১৪

ঢাকা/জেডআর

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়