ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ট্রাম্পের জয়ী হওয়া কতটা কঠিন?

শেখ আনোয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০১, ৩ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১১:৩১, ৩ নভেম্বর ২০২০
ট্রাম্পের জয়ী হওয়া কতটা কঠিন?

মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট। এবার রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেন। বিশ্ব শাসন করা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববাসীর কৌতূহলের অন্ত নেই। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে তাই বিশ্ববাসীর এত আগ্রহ, ট্রল, পোস্ট ও মন্তব্য আগে কখনো দেখা যায়নি। নির্বাচনে কে বিজয়ী হবেন? বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি জো বাইডেন? এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ক’দিন আগে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগে ভাগেই হুশিয়ার করেছেন, ‘ব্যালট ভোট মানেই কারচুপির রাস্তা স্পষ্ট। কোনোভাবেই ব্যালট পেপারে নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেওয়া হবে না।’ এমনো বলেন, পরাজিত হলে ‘সে রকম ভালো পরস্থিতি তার সামনে থাকবে না। তাই দেশ ছাড়তে বাধ্য হবেন তিনি।’ বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, এমন অবস্থায় ট্রাম্প দেশ ছেড়ে কোথায় যাবেন? চীনে? যেতেও পারেন! শোনা যায়, চীনের ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের।

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এখন পর্যন্ত যতগুলো জরিপ হয়েছে তাতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের দিকে ঝুলে রয়েছে জয়। প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে তিনি এগিয়ে রয়েছেন। গত নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে রাজ্যগুলোতে হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়েছিলেন এখন সেসব রাজ্যে জো বাইডেন ট্রাম্প থেকে অনেকটা এগিয়ে। এভাবে চলতে থাকলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়া কিছুটা কঠিন হয়ে যাবে। কারণ জো বাইডেনকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বয়সে যেমন প্রবীণ রাজনীতিতেও তেমন। বারাক ওবামা যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যদি তিনি নির্বাচিত হন তাহলে তিনিই হবেন আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রবীণ প্রেসিডেন্ট। চলতি সমীক্ষাগুলো বলে দিচ্ছে, এবারের নির্বাচন মোটেও সহজ হবে না। প্রশ্ন উঠেছে, ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা তবে কি কমে গেলো?

জী হ্যাঁ। কমেছে বৈকি! কারণ, করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতা তার পিছু নেয় আগে থেকেই। একেক সময় হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মিডিয়ার সামনে উল্টাপাল্টা কথা বলা। যার ফলে সবার কাছে হাসি-তামাশার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। ফলে জনমত সমীক্ষাতেও তার জনসমর্থন কিছুতেই ৪২ শতাংশের উপরে উঠছিল না। এবার সঙ্গে যোগ হয়েছে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার বোমা ফাটানো ঘটনা ও ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বি জো বাইডেনের সঙ্গে বিতর্কে গো-হার। এসব ছিল সেপ্টেম্বরের ঘটনা। অক্টোবরের প্রথম দিনেই জানা গেলো তিনি ও ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প করোনায় আক্রান্ত। সঙ্গে দুই ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা, তিন সিনেটরসহ আরো ডজন খানেক ছায়াসঙ্গী। ঘটনার আকস্মিকতা ট্রাম্পের সব নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ রীতিমতো ওলট-পালট করে দিয়েছে। সিএনএন-এর মতো মার্কিন মিডিয়াও বলতে বাধ্য হয়েছে, ‘ট্রাম্পের জনসমর্থন তলানিতে। সাময়িকভাবে হলেও তার প্রচার শিবির যেন নাবিকবিহীন জাহাজ।’

ট্রাম্পের জন্য প্রধান সমস্যা বিশ্বাসযোগ্যতা। গত ক’মাস করোনাভাইরাসকে হালকা ফ্লু বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বারবার বলেন, ‘ম্যাজিকের মতো এই ভাইরাস উধাও হবে।’ এ প্রশ্নে দেশের সেরা বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করেন। তাদের লিখিত পরামর্শ তার চাপে বদলে যায়। করোনার ভয়াবহতা খাটো করে দেখানোর জন্য তিনি প্রতিরোধক মাস্ক পরার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেন। মাস্ক পরলে তাদের দুর্বল দেখা যাবে। এ যুক্তিতে ট্রাম্প শুধু নিজে নন, হোয়াইট হাউজের কর্মচারীদেরও মাস্ক পরতে নিরুৎসাহিত করেন। ট্রাম্প এমন কথাও বলেন, ‘বাইডেন যেভাবে নিজের মুখ কাপড়ে ঢেকে রাখেন, তাতে মনে হয় নিশ্চয় কোনো সমস্যা রয়েছে। তাকে একজন মনোবিশারদকে দিয়ে দেখানো উচিত।’ এখন অবশ্য সব পরিহাসের লক্ষ্য ট্রাম্প নিজেই। একজন রিপাবলিকান নির্বাচনী কৌশলবিদ তো বলেই ফেলেছেন, নজর যতো বেশি করোনার উপর পড়বে, ট্রাম্পের জন্য ততোই বিপদ। তিনি চান আলোচনা হোক আগামীকাল নিয়ে। কিন্তু করোনার ওপর নজর থাকা মানে সকলের দৃষ্টি থাকবে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতার ওপর।

ট্রাম্পপন্থী সংবাদ মাধ্যমগুলো ইতোমধ্যে ডাকযোগে ভোট দেওয়ার বিষয় নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার শুরু করে দিয়েছে এবং ট্রাম্প হারলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা অস্বীকার করার জন্য জনমত গঠনের কাজও তারা চালিয়ে যাচ্ছে। যদি ট্রাম্প একটা বড় সময় ধরে নির্বাচনী প্রচার করতে না পারেন এবং শেষে হেরে যান, তবে তিনি নির্বাচনের ফলাফলের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অজুহাত পাবেন। ভয়ের কথাটা শুনিয়ে রেখেছেন আমেরিকার লেইডেন ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক অ্যান্ড্রু গথোর্প। তিনি বলেছেন, ‘যে প্রেসিডেন্ট অতিমাত্রায় আত্মপ্রেমে মগ্ন এবং মিথ্যাচারে আসক্ত, তিনি প্রতিকূল অবস্থায় পড়লে কী করে বসবেন, তা হয়তো আমরা এমন এক সময়ে টের পাবো, যখন আর করার কিছুই থাকবে না।’

মার্কিন রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবির্ভাব হয়েছিল একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে। দেশের অর্থনীতিকে সঠিক পথে ফেরাতে নিজেকেই সবচেয়ে যোগ্য লোক হিসেবে প্রচার করেন। আগের নির্বাচনে তিনি স্লোগান তুলেছিলেন ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’। সে স্লোগানেই আটকে রয়েছেন এবারো। মার্কিন অর্থনীতির ক্ষত সারাতে তিনি যেসব রক্ষণশীল পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার ভরকেন্দ্র ছিল আয়করদাতাদের অর্থের সফল ব্যবহারের বিষয়টা। কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমসের সদ্য ফাঁস করা তথ্যে দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতি পুনর্গঠন ও ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে আমেরিকাকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ের স্বঘোষিত সেনাপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। আয়করদাতাদের অর্থের অপব্যয় বন্ধের দোহাই দিয়ে সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিসেবা প্রকল্প বা ওবামাকেয়ার ও তরুণ অভিবাসীদের জন্য থাকা ‘ড্রিমারস’ প্রকল্প বন্ধের কথা বলে গেছেন তিনি। আর সে প্রেসিডেন্টই আবার অবাধে আয়কর ফাঁকি দেন। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে? ভোটের আগে নিউইয়র্ক টাইমস নিঃসন্দেহে এক বড় অস্ত্র তুলে দিয়েছে ডেমোক্র্যাটদের হাতে। আয়কর ফাঁকি দিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে রাস্তায় হেঁটেছেন, তা চির পরিচিত। নিজের ব্যবসায়িক ক্ষতি দেখিয়ে তিনি আয়কর পরিশোধের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন বরাবর। এ অজুহাতকেই সত্যি হিসেবে মেনে নিলে বলতে হয়, সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের যে ভাবমূর্তি তিনি গড়েছিলেন, তা এক বড় ভাঁওতাবাজি। ফলে তার নিজেকে ‘গ্রেট ম্যানেজার’ দাবি করাটা ঠিক ধোপে টেকে না।

নিউইয়র্ক টাইমস যে তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে, তাতে আঁতকে উঠতে হয়। তারা জানিয়েছে, গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছর ও প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প মাত্র ৭৫০ ডলার করে আয়কর পরিশোধ করেছেন। পরের দু’বছরে তিনি কোনো আয়করই পরিশোধ করেননি। আইনের মারপ্যাঁচে এই আয়কর পরিশোধ না করার দায়টা হয়তো শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প এড়াতে পারবেন। কিন্তু এর মাধ্যমে সেই বড় প্রশ্নটা সামনে চলে এসেছে। তাহলো, আমেরিকার আয়কর পরিকাঠামোয় ধনীরাই সুবিধা পান বেশি। আর কাটা হচ্ছে পরিশ্রমী আমেরিকানদের পকেট। যার কথা বিরোধীরা বহুদিন ধরে বলে এসেছেন। ডেমোক্র্যাটরা এ ব্যবস্থার বদল চায়। শুনলে অবাক হতে হয়, এই আয়কর ব্যবস্থা পাল্টানোর কথা ডোনাল্ড ট্রাম্পও বলেছেন। এ বদলের কথা বলেই তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোটারদের নিজের দলে টেনেছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ধনীদের জন্য থাকা সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার কাজটাও করেছেন। আর সেসব খেটে খাওয়া মানুষের পকেট কেটেছেন, যাদের ভোটে আজ তার ঠিকানা হোয়াইট হাউজ। প্রশ্ন হচ্ছে, এই আয়কর ফাঁকি দেয়ার তথ্য আসন্ন নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে? কিন্তু এর আগেও তো কম কেলেঙ্কারির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম যুক্ত হয়নি। যৌন নির্যাতন, পর্নো তারকার সঙ্গে সম্পর্ক, গত নির্বাচনে রাশিয়ার নেপথ্য যোগ-সাজস ইত্যাদি বহু অভিযোগ উঠেছে। যার জন্য গত চার বছর কম পানি ঘোলা হয়নি। এক সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট হবে বলে শোরগোল উঠেছিল। কিন্তু এখনো তিনি বহাল তবিয়তেই রয়েছেন।

আয়কর এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ, আমেরিকার মতো দেশে অনেক বড় অপরাধ। কিন্তু মুশকিল হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা কট্টর সমর্থক হিসেবেই পরিচিত। যা কিছুই হোক, তারা ট্রাম্পের সঙ্গেই রয়েছেন। বিভিন্ন জনমত সমীক্ষাতেও ট্রাম্প সমর্থকদের এমন প্রবণতাই উঠে আসছে। সঙ্গে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের নিজের সঙ্গে লেপ্টে রাখতে এবং বিভিন্নভাবে তাদের উস্কে দিতে, যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমন অবস্থান তিনি স্পষ্ট রেছেন বিভিন্ন ঘটনায়। নির্বাচনে হেরে ধুরন্ধর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশ ছাড়ার ঘোষণা এক চুড়ান্ত ভাঁওতাবাজি ছাড়া কিছু নয়। তিনি তার চেনা পথেই হাঁটবেন, এতে সন্দেহ নেই।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা/মারুফ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়