ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মাশরাফির বিদায় ও কর্তাদের ছুড়ে ফেলার নীতি

নাজমুল হক তপন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৯, ৫ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ২০:০৯, ৫ জানুয়ারি ২০২১
মাশরাফির বিদায় ও কর্তাদের ছুড়ে ফেলার নীতি

ম্যাচ খেলে মাঠ থেকে বিদায় নেওয়া- এমন একটি দৃষ্টান্তের জন্য আমাদের আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? এই প্রশ্নের বোধকরি কোনো জবাব হয় না। আমাদের ক্রীড়া কর্তাদের অভিধানে ‘বিদায় সংস্কৃতি’ শব্দটাই যে নেই!

আমাদের ক্রীড়া অধিকর্তারা প্রখর নীতিবান(!)। ছুড়ে ফেলার নীতি থেকে এক চুলও সরে আসার পক্ষপাতি নন তারা। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীতে এসে বৈশ্বিক রেসে বাংলাদেশ যেটুকু আলো ছড়িয়েছে তা ওই ক্রিকেটের সৌজন্যেই। আর এই জায়গাটিতে সবচেয়ে বড় নাম মাশরাফি মর্তুজা। ‘টিম বাংলাদেশ’ ধারণাটি মুখে বলেননি, কাজে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন মাশরাফি। কিন্তু প্রচণ্ড নীতিবাগিশদের(!) কল্যাণে যে ‘বিদায় সংস্কৃতি’ বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে সেটা অনুসরণ না করলে যে ঐতিহ্য ভাঙার পাপে পুড়তে হবে! তাই যে কোনো মূল্যে ‘ছুড়ে ফেলার’ বিশ্বাসে থাকতে হবে অটল! মাশরাফি কি এমন পুন্যি করেছে যে, তার বেলায় ‘বিদায় সংস্কৃতি’র ঐতিহ্য ভাঙা হবে?

নিজের ক্যারিয়ারের সেরা সময় ফেলে এসেছেন, এটা খুব ভালোভাবেই জানেন মাশরাফি। টেস্ট ও টি-২০ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন আগেই। ওয়ানডে ফরম্যাট মাশরাফির প্রিয় জায়গা। ম্যাচ খেলে মাঠ থেকে বিদায় নেবেন টিম বাংলাদেশের রূপকার- এ তো জনদাবী।

মাশরাফি তো এখনো ওয়ানডে থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেননি। আবারো ঘরোয়া ক্রিকেট চালিয়ে যাবেন, এমন কথা বলে আসছেন বারবারই। দলে জায়গা পান বা না-পান, ঘরোয়া ক্রিকেট চালিয়ে যাবেন গতকালও বলেছেন। তাহলে তো, ঘরোয়া আসরে পারফর্ম করে আবারো জাতীয় দলে ফেরার সুযোগ থাকছে মাশরাফির- এমন একটা কথাও উঠে আসছে। কিন্তু এটি যে হওয়ার নয়, তা মাশরাফিকে ছাড়াই দল ঘোষণার সময় স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বললেন, আমাদের বাস্তবতা মানতে হবে। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ২০২৩ বিশ্বকাপকে ফোকাস করে আমরা টিম ম্যানেজমেন্ট সবাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মাশরাফিকে বাদ দিতে হয়েছে।’

আমাদের ক্রিকেট অধিকর্তাদের মূল ফোকাসটা ২০২৩ বিশ্বকাপ। সময় যত এগুবে বিশ্বকাপও তত কাছাকাছি চলে আসবে। এর অর্থ বুঝতে কি বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন আছে? মাশরাফির ফেরার রাস্তাটা শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভব। মাশরাফিবিহীন দল, এর বাইরে ভাবার প্রয়োজন বোধ করছে না আমাদের ক্রিকেট ম্যানেজমেন্ট। মাঠের পারফরম্যান্সই যদি হিসাব কষা হয়, তাহলে মাত্র কদিন আগে শেষ হওয়া বঙ্গবন্ধু টি-২০ কাপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়ে দলকে ফাইনালে ওঠান মাশরাফি। সেরা সময়ে না থাকলেও, নিজের উপযোগিতা কিন্তু ঠিকই পূরণ করেছেন।

এটা আর নতুন করে বলার প্রযোজন নেই যে, এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যতবার বাংলাদেশ সফর করেছে এর মধ্যে আসন্ন ঘোষিত দলটি সবচেয়ে দুর্বল। আগামী ২০২৩ বিশ্বকাপে এই ক্যারিবীয় দলটির (বাংলাদেশে যে দলটি আসছে) একজনকেও দেখা যাবে কি-না তা নিয়ে সংশয় আছে। এমন একটি দুর্বলতম দলের বিপক্ষে খেলার অভিজ্ঞতা ২০২৩ বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে কি এমন কাজে দেবে বলাবাহুল্য। মনে রাখতে হবে হাল আমলে, ওয়ানডে ক্রিকেটে পুরো শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের রেকর্ড বেশ উজ্জ্বল। যে সিরিজটা শুধুই আনুষ্ঠানিকতার সেই সিরিজ দিয়েই বিশ্বকাপ প্রস্তুতির শুরুর কথা ভাবছে আমাদের ক্রিকেট কর্তারা। দুরদর্শিতাও বটে!

শচীন টেন্ডুলকারের বিদায়ের কথা নিশ্চয়ই অনেকের স্মৃতিতে টাটকা। বিদায় পর্বকে কিভাবে মহিমান্বিত করা যায়, সেজন্য প্রাণান্ত করেছিল ভারত ত্রিকেট ম্যানেজমেন্ট। কয়েকটা দিন ধরে, পুরো বিশ্ব মিডিয়া দখল করে রেখেছিল শচীনের বিদায় সংবাদ। শুধু শচীন কেন, কিংবদন্তীদের বিদায় পর্ব স্মরণীয় করে রাখার জন্য   অন্য দেশগুলো সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করে। এমন উদাহরণ দিতে গেলে পাতার পর পাতা লিখেও শেষ করা যাবে না। শুধু একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। প্রায় তিন দশকের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার পুনর্জন্ম হয় ১৯৯১ সালে। প্রথমেই দলটি আসে ভারত সফরে। ওই সফরে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের নেতৃত্বে ছিলেন খ্যাতনামা অলরাউন্ডার ক্লাইভ রাইস। ওই সময় রাইসের বয়স ছিল ৪২ বছর। বর্ণবাদ-নীতির কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ থাকায় দেশের হয়ে খেলার সুযোগ পাননি রাইস। প্রথম সুযোগেই রাইসকে নেতা বানিয়ে ভারত সফরে পাঠায় দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট ম্যানেজমেন্ট।

গতকাল মাশরাফিকে বাদ দেওয়ার সংবাদ সম্মেলনটি অন্য একটি কারণে পায় ভিন্ন ব্যঞ্জনা। সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফিকে বাদ দেওয়ার পক্ষে অসংখ্য যুক্তি তুলে ধরেন এক সময়ের বাংলাদেশ ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। মাঠের পারফর্মেন্সে বাংলাদেশ ক্রিকেটে হাতে গোনা কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলে অনায়াসে চলে আসে নান্নুর নাম। চরম বাস্তবতা হচ্ছে, কখনোই টেস্ট ক্যাপ মাথায় ওঠেনি নান্নু ভাইয়ের। আর গতকাল মাশরাফিকে বাদ দেওয়ার কথা বলার সময় বাস্তবতার কথাই বলে গেলেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু।

ছুড়ে ফেলা নীতির যে ‘বিদায় সংস্কৃতি’ সেটা সবার জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। নামগুলো আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাসুদ পাইলট কিংবা মাশরাফি... তাতে কি যায় আসে! ঐতিহ্য বলে কথা!

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়