ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মার্কিন রাজনীতির বেসামাল চিত্র

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৮, ১৩ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৭:২২, ১৩ জানুয়ারি ২০২১
মার্কিন রাজনীতির বেসামাল চিত্র

ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ভূমিকা, বিশ্বব্যাপী মোড়লগিরি পৃথিবীর অনেক মানুষ পছন্দ করেন না। কিন্তু মার্কিন সমাজের সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জনগণের প্রতি দেশের গণতান্ত্রিক আচরণ, পুলিশের ব্যবহার ও কাজ, জনগণের অধিকার, সুরক্ষা-নীতি পৃথিবীর সব দেশের মানুষকে বাধ্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভালোবাসতে। যে কারণে দেখা যায় বিশ্বব্যাপী মেধাবী এবং সমাজের এলিট সবারই একটি সাধারণ টার্গেট থাকে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ কিংবা সেখানে বাস করা।

বহু রাজনৈতিক নেতা, রাষ্ট্রপ্রধান, বিখ্যাত ব্যক্তি শেষ জীবনে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে কাটান। বহু বিতর্কিত রাজনীতিক আশ্রয় নেন আমেরিকায়। বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ব্যাতীত প্রায় সব দেশেই দ্বন্দ্ব, সংঘাত, রাজনৈতিক উত্তেজনা, কলহ লেগেই আছে। যে কারণে শান্তি নেই মানুষের মনে। তাদের সামনে দু’চারটি দেশ উদাহরণ হিসেবে রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় উদহারণ আমেরিকা। কাজেই আমেরিকায় রাজনৈতিক হানাহানি ঘটুক এটি কেউ চায় না। অথচ সে ধরনের একটি ঘটনা ঘটে গেল মার্কিনমুলুকে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির কংগ্রেসের আইনসভা বা ক্যাপিটল ভবনের সামনে ট্রাম্প সমর্থক ও পুলিশের মধ্যে সংষর্ষ হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের মারমুখী বিক্ষোভের মুখে ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল ভবন অবরুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে দেশটির পুলিশ। ওই ভবনে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের জয়ের স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিকতা চলছিল তখন। স্থানীয় সময় বুধবার (৬ জানুয়ারি) ক্যাপিটল ভবনের চারপাশে জড়ো হন কয়েক হাজার ট্রাম্প সমর্থক। তাদের মধ্যে ছিল মারমুখী ভাব। প্রথমে তারা ওই ভবনে ঢোকার চেষ্টা চালায়। এ সময় পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলি চালায় এবং কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। ট্রাম্প সমর্থকরা নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে  জড়িয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে বিক্ষোভ করে ক্যাপিটল ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ে।

ট্রাম্প সমর্থকদের এই বিক্ষোভের মধ্যেই প্রতিনিধি পরিষদ সদস্যদের পাহারা দিয়ে অধিবেশন কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে আসে পুলিশ। ক্যাপিটল ভবনের ভেতরে ও বাইরে তখন ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। ট্রাম্প সমর্থকরা সদ্য অনুষ্ঠিত ভোটের ফল বাতিলের দাবি জানান। বিশৃঙ্খল এই পরিস্থিতির মধ্যে এক পর্যায়ে অধিবেশনও মুলতবি ঘোষণা করা হয়। এই সংঘর্ষে একজন নারী নিহত হয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। হোয়াইট হাউজ এবং পেন্টাগনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ওয়াশিংটন এবং এর আশেপাশের রাজ্যে জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দুই হাজার সাতশ’র বেশি নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন করা হয়েছে।

নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই ঘটনাকে বিদ্রোহ আখ্যায়িত করেছেন। এ ছাড়া দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্পের সমর্থকদের প্রবেশকে অগ্রহণযোগ্য ও অসহনীয় বলে উল্লেখ করেছেন। এর আগে হোয়াইট হাউজের সামনে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ট্রাম্প অঙ্গীকার করেন, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হার তিনি কখনোই স্বীকার করবেন না। এটি আমেরিকার নির্বাচনের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। আমরা মার্কিন নির্বাচনে যা দেখে অভ্যস্ত তা হচ্ছে, নির্বাচনে যিনিই জয়লাভ করুন না কেন বিরোধীপ্রার্থী তাকে সব সময়  অভিনন্দন ও স্বাগত জানাতেন। কিন্তু এ বছর ঘটনা হলো উল্টো। এতো দেখছি তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনের ঘটনার মতো। এটি এশিয়া কিংবা আফ্রিকার যে কোনো দেশে অহরহ ঘটে। কিন্তু আমেরিকার মতো দেশে এটি বেমানান। এখানে উল্লেখ্য হোয়াইট হাউজের কাছে সমবেত কয়েক হাজার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ট্রাম্প বক্তব্য দেওয়ার পরই এই গোলযোগ দেখা দেয়। বক্তব্যে তার কাছ থেকে জয় ‘চুরি করে নেওয়া হয়েছে’ বলে তিনি অভিযোগ করেন।

অথচ ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দলের নির্বাচন কর্মকর্তা ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক সবাই ০৩ নভেম্বরের নির্বাচনে তেমন কোনো জালিয়াতি না হওয়ার কথা বলেছেন। ওই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চেয়ে ৭০ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েছেন ডেমোক্র্যাট  প্রার্থী জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের নির্ধারক ইলেকটোরাল ভোটের হিসাবে ট্রাম্পের ২৩২টির বিপরীতে বাইডেনের পক্ষে আসে ৩০৬টি। এরপর দেশের বিভিন্ন স্টেটে নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে আদালতে গিয়ে বিফল হতে হয় ট্রাম্পকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ বিষয়টিকে  শ্রদ্ধা করতে হয়। অর্থাৎ একজন রাষ্ট্রপতিও রাষ্ট্রীয় আদালতকে প্রভাবিত করতে পারেন না। এটি নিশ্চয়ই চমৎকার একটি বিষয়!

এশিয়া, আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকার কোনো দেশে নির্বাচনে হেরে যাওয়া মানে একটি রাজনৈতিক দলের ভরাডুবি। কারণ এসব দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি বা দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ যে দল ক্ষমতায় যাবে তারা বিরোধীদল বা দলগুলোকে গলা টিপে মেরে ফেলার সব ধরনের প্রচেষ্টাই করে। যে কারণে নির্বাচনে হেরে যাওয়া কোনো দলই মেনে নিতে চায় না। তারা দ্বন্দ্ব সংঘাত করে সেটিকে হয় বানচাল করতে চায়, নতুবা কালক্ষেপণ করে। ফলে জনগণের জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে নেমে আসে চরম অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা। তাতে অবশ্য রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী কিংবা বিজীত দল কারুরই কিছু আসে যায় না, তাদের প্রয়োজন ক্ষমতা। এই ক্ষমতার মধ্য দিয়ে তারা হাজার হাজার কোটি ডলার বিদেশে পাচার করতে পারে, বিদেশের মাটিতে সুরম্য অট্টালিকা বানাতে পারে, নিয়ন্ত্রণ করতে পারে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি। এই অবস্থার মধ্য দিয়েই চলেছে গোটা দুনিয়ার রাজনীতি। সেখানে দু’চরাটি দেশের শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া দুনিয়ার শান্তিকামী ও শিক্ষিত মানুষের প্রশংসা ও দৃষ্টি দুটোই কাড়ে। যুক্তরাষ্ট্র তেমনই একটি দেশ। কিন্তু কী  হলো সেখানে? কী দেখছি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে?

স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠেছে- যুক্তরাষ্ট্রের এতো দিনের সহনশীলের রাজনীতি কি এখন থেকে সংঘাতের পথেই চলতে থাকবে?

 

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়