ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রোসলিং-এর ‘বাংলাদেশ মিরাকল’ আজ বাস্তব

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৬, ২৯ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৩:৩৮, ২৯ জানুয়ারি ২০২১
রোসলিং-এর ‘বাংলাদেশ মিরাকল’ আজ বাস্তব

হ্যান্স রোসলিং। বিখ্যাত পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট। সুইডেনের কেরোলিন্সকা ইউনিভার্সিটির পাবলিক হেলথের অধ্যাপক ছিলেন। তার একটি ভিডিও আছে ইউটিউবে; ২০০৩ সালে করা। শিরোনাম: ‘বাংলাদেশ মিরাকল’।

তিনি বাংলাদেশের অবস্থান জানিয়ে বলেন, ধরুন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে যদি ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে নিয়ে আসা হয় তাহলে যে জনঘনত্ব হবে, সেরকম ঘনত্বে লোকজন এখানে বাস করে। এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯৫০ জন মানুষ থাকে। ছোট্ট একটা দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি।

তিনি কৈশোরের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, স্কুলের শিক্ষকরা বলতেন, এখানকার (বাংলাদেশ) জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এতো বেশি যে কোনোভাবেই তা থামানো সম্ভব নয়। এখানকার ধর্ম ও সংস্কৃতি বৃদ্ধি রোধের বিপরীতে। এখানে একজন নারী গড়ে ৭টি সন্তান প্রসব করে।

এরপর তিনি দেখাচ্ছেন একসময় উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশকে জনস্বাস্থ্যের নিরিখে দুভাগে ভাগ করা হতো। যেসব দেশে নারী প্রতি শিশু জন্মের হার ৪-এর কম এবং শিশু মৃত্যুর হার শতে ১০-এর কম, সেসব দেশ দেখা গেছে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত। এরা শিল্পপ্রধান দেশ। প্রকারন্তরে এর অধিক নারী প্রতি শিশু জন্ম ও শিশু মৃত্যুর হার যেসব দেশে, সেসব উন্নয়নশীল দেশ। অর্থনীতি ও শিল্পে এরা পিছিয়ে।

১৯৬২ সালে বাংলাদেশে নারী প্রতি শিশুর সংখ্যা ছিল ৬.৭। শতে ২৪.৬টি শিশু মারা যেত। মানে ৪টি শিশু জন্ম নিলে ১টি শিশু ৫ বছর হওয়ার আগে মারা যেত। রোসলিং দেখাচ্ছেন ২০০৩ সালে সেই হার নাটকীয়ভাবে কমে এসেছে। বাংলাদেশ চলে গেছে উন্নত বিশ্বের কাতারে। নারী প্রতি শিশু ৬.৭ থেকে কমে ২.৯ এবং শিশু মৃত্যুর হার ২৪.৬ থেকে কমে ৬.৯-এ চলে এসেছে। তিনি আরো জানান, ৭১-এ দেশ স্বাধীনের পর থেকে এই নাটকীয় অভিযাত্রা শুরু হয়।

তিনি অবাক হয়েছেন নদী-নালায় বিচ্ছিন্ন এই গ্রামপ্রধান দেশে কিভাবে এ সাফল্য অর্জিত হলো! রোসলিং-এর তথ্য ১৩ বছরের পুরনো। এখন নারী প্রতি শিশু ২.০৪। শিশু মৃত্যুর হার ২.৮-এ নেমে এসেছে। বাংলাদেশের এ উত্থান শুধু জনস্বাস্থ্যেই আবদ্ধ নয়, সব ক্ষেত্রেই হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতি ক্ষেত্রে অভাবিত সাফল্য অর্জন করেছে। গত ৫ বছর আগেও প্রতিবেশী দেশ ভারতের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি ছিল। অথচ ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড বা আইএমএফের ২০২০-এর রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ে ভারতকে অতিক্রম করে ফেলেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য বোঝানোর জন্য আরেকটি তথ্য দেওয়া যায়। 

২০০৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ১০২ বিলিয়ন ডলার। দশ বছরের মাথায় তা প্রায় তিনগুণ বেড়ে ৩০২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এসময় সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ ৭০০ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৬১৩ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বিদেশী বিনিয়োগ প্রাপ্তিতে এখন দ্বিতীয়।

বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে সারা পৃথিবীতে দ্বিতীয়। তার উপরে আছে কেবল চীন। বলা হয়, বাংলাদেশ চীনের পথ ধরেই অর্থনৈতিক সাফল্যের দিকে এগুচ্ছে। চীন যেভাবে শ্রমঘন শিল্পে অধিক মনোযোগ দিয়েছিল, বিশাল বিশাল প্রকল্প করে যোগাযোগ ও অবকাঠামোতে এনেছিল বৈপ্লিক পরিবর্তন, বাংলাদেশও তাই করছে। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, কক্সবাজার রেল লাইন যেমন সড়ক ও রেল যোগাযোগে বিরাট পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি শ্রমঘন শিল্প বিস্তারের জন্য ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন স্থাপন করছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১৪৭ কিলোমিটার স্থলভাগ সমুদ্রগর্ভ থেকে উদ্ধার করে তৈরি করা মীরসরাই ইকোনমিক জোন ইতোমধ্যে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব আসছে।

ভৌগোলিক সুবিধাকে কাজে লাগাতে নৌ ও বিমান খাতে বাংলাদেশ বিশাল বিনিয়োগ করছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনাল স্থাপন করছে। যাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিমান যোগাযোগের ‘হাব’ হতে পারে দেশটি। দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন করে প্রতিবেশী ৪টি দেশকে ট্রানজিট দিয়ে বিপুল অর্থ আয়ের দুয়ার খুলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে বিপুলসংখ্যক যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ। প্রতিবছর ৬৫ হাজারের অধিক যুবক আইসিটি বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট হচ্ছে। এছাড়া কয়েক লক্ষ যুবক আইসিটির উপর বিভিন্ন মেয়াদের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আইসিটির সাহায্যে সরকারি সেবাদান সহজতর করা হয়েছে। সরকার ৮০০০ হাজার ডিজিটাল সেন্টার করেছে স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে। সেখান থেকে লোকজন সহজেই সরকারি সেবা পাচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে একসময় অনেক দেশই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে কিনা সে প্রশ্ন অনেকেই তুলেছিল। ২০২০ সালে বৈশ্বিক দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশ ধনাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তার প্রবৃদ্ধিই সর্বোচ্চ। এতেই বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্ত বুনিয়াদ বোঝা যায়।

লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্সের (সিইবিআর) ২০১৯ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়- বাংলাদেশ ৪১তম অর্থনীতির দেশ। তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম ২৫টি অর্থনীতির দেশের তালিকায় স্থান করে নেবে।

ধারণা করা হয়, আমেরিকা চীন বাণিজ্য যুদ্ধে যে কয়টি দেশ সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ইতোমধ্যে চীন থেকে অনেক জাপানী বিনিয়োগ সরে বাংলাদেশে চলে এসেছে। জাপান সরকারও এদের প্রণোদনা দিচ্ছে। চীনের প্রভাব কমাতে জাপান মেগা প্রজেক্টগুলোতে সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো চীনের বদলে বাংলাদেশের পোশাক নিতে অধিক আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ এখন ভূ-রাজনৈতিতে খুবই সুবিধাজনক অবস্থায় আছে।
এককালের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ এখন সাফল্যে ভরিয়ে তুলছে তার ঝুড়ি। রোসলিং ২০১৭ সালে মারা যান। বেঁচে থাকলে এই বিস্ময় আজ তাকে নিশ্চিতভাবেই আরো ভাবনায় ফেলে দিতো। 


তথ্যসূত্র: দ্য ডেইলি স্টার, দ্য ডিপ্লোম্যাট, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের একাধিক রিপোর্ট
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়