ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

স্ট‌্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া: গৌরবের পদযাত্রা

ড. মতিন রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩৪, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৯:১৬, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
স্ট‌্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া: গৌরবের পদযাত্রা

গণমাধ্যম হিসেবে সিনেমা স্বীকৃত শিল্প। সিনেমা সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। সমাজ পাল্টে ভীত নাড়িয়ে দিতে পারে, আবার একটি নতুন রাষ্ট্রের সূচনা সংগীত প্রকাশেরও সামর্থ রাখে। আর এভাবেই এই গণমাধ্যম মোহিনী প্রভাব বিস্তার করে চলেছে বৃহত্তর দর্শকের কাছে। দর্শককে শুধু বিনোদন জাতীয় ভাবনার রসদ যোগাচ্ছে না, দার্শনিক চিন্তা উচ্চস্তরে পৌঁছে দিচ্ছে। বিপুল প্রভাব অথবা ক্ষমতাধর এই মাধ্যমটি এখন মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার। এর বাণিজ্যিক চাহিদা অস্বীকার করার উপায় নেই।

বিশ্বজুড়ে অন্যতম উৎপাদন দ্রব্যের মধ্যে সিনেমা একটি বিশেষ পণ্য উৎপাদন। এবং যার উৎপাদন যেকোনো দেশের বৃহৎ শিল্প কারখানা থেকেই হয়। ১২ হাজার সিনেমা হলের দেশ ভারতের প্রধান পাঁচটি রপ্তানি দ্রব্যের একটি সিনেমা। যখনই প্রোডাক্ট উৎপাদনের কথা আসে, তখনই প্রাসঙ্গিকভাবে আসে শিল্প কারখানার কথা। শুধু পণ্য উৎপাদনের জন্য নয়। শ্রম সুশৃঙ্খলভাবে কাজে লাগানোর প্রয়োজনে গড়ে ওঠে শিল্প প্রতিষ্ঠান। কিন্তু চাইলেই তো সিনেমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যায় না।

ভারতীয় হিন্দি ‘ব্ল্যাক’ সিনেমার গল্পের প্রধান নারী চরিত্র মিশেল একটি প্রশ্ন করেছিলেন। একজন ব্যক্তি অন্ধকারে কতক্ষণ থাকতে পারে? প্রশ্নটিতে ছিল আলোর প্রত্যাশা। তেমনি এদেশের সিনেমা শিক্ষানুরাগীরাও স্বপ্ন দেখেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সিনেমা শিক্ষার আলো কবে জ্বলবে? কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদ মানুষের বিচার, ধর্ম, মানবিকতা, স্বার্থ এমনকি স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করে। সেই ভোগবাদের পেক্ষাপটে স্বপ্ন দেখা সুলভ হলেও তা পূর্ণ হওয়া কঠিনই বটে। কিন্তু ইতিহাস সাহসী মানুষেরাই নির্মাণ করেন। সিনেমা প্রযোজকের কাছে tentpole একটি পরীক্ষামূলক ধারণা। সিনেমা নির্মাণ করতে তারা ধারণা করে নিতে পারেন এর দর্শক প্রাপ্তি কেমন হবে। এই দুরদর্শী ধারণায় সেই ‘ব্ল্যাক’ সিনেমার শিক্ষক দেবরাজের মতোই- একজন স্বপ্নবাজ সাহসী মানুষ সিনেমাকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করলেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম পড়ার বিষয় হিসেবে সিনেমা যাত্রা শুরু করলো।

সেই ২০০৪ সালে বাংলাদেশে কয়টি টেলিভিশন চ্যানেল ছিল? বছরে কয়টি সিনেমা নির্মাণ হতো? মিডিয়া শিল্পে কতই-বা শিক্ষিত জনবল প্রয়োজন হবে? এমন সংকট সম্ভাবনার প্রাচীরের এক পায়ে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ নিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এমএ হান্নান ফিরোজ। সমমানবীয় গঠন চিন্তার ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের ডিগ্রিধারী চিত্রগ্রাহক, নির্মাতা এম এ সামাদ প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে বিভাগটির দায়িত্ব নিলেন। উভয়ের যৌথ চিন্তায় সিনেমা ও মিডিয়া শিক্ষাকে আরো গঠনমূলক করার চিন্তায় এসএ টিভি, এসএ সংগীত স্টুডিও এবং দৈনিক আমাদের সময় প্রতিষ্ঠা হলো। নতুন বিভাগ, উৎসাহী নবীন-প্রবীণ ছাত্রদের চিন্তা-চেতনা জগতে ‘কিনো’ অর্থ সিনেমা, ল্যাটিন ‘কমিউনিকেয়ার’ অর্থ যোগাযোগ- শব্দ দুটির অপার প্রাণশক্তি মূল্য ধরা পড়ল৷ সেই যাত্রা থেকেই নিঃশব্দের মাঝে হারানো শব্দ, অন্ধকারের মাঝে হারানো আলো ফিরে এলো। সিনেমা ও গণমাধ্যমে ছাত্ররা শিখল চিন্তা অনুযায়ী নিজেকে প্রকাশ করার ভাষা।

তবে যাত্রাটি কঙ্করমুক্ত ছিল না। বাংলাদেশের মুসলমান সমাজ-ধারণায় সিনেমা, নিত্য অথবা ঐন্দ্রজালিক বিনোদন কখনো সমর্থন পায় না। আধুনিক চিন্তার ছাত্রছাত্রীরা পরিবারের সদস্যদের অমতে অথবা গোপন রেখে সিনেমা মিডিয়া নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকে।

আবার ইতিহাসের কখনো পুনরাবৃত্তি ঘটে। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গণপরিষদের বিল পাশে প্রতিষ্ঠিত হলো সিনেমা সংস্কৃতির পীঠস্থান চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন। সংস্কৃতিকর্মী, অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা নির্দেশকেরা এসে সিনেমা নির্মাণে অংশগ্রহণ করলেন৷ ঠিক তেমনি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগে চেয়ারম্যান হিসেবে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব নিলেন টেলিভিশন নাট্যকার, নির্দেশক অভিনেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন, নাট্যাভিনেতা নাট্যশিক্ষক রহমতউল্লাহ, প্রামান্যকার মানজারে হাসিন মুরাদ, শিল্প নির্দেশক চিত্রনির্মাতা মহিউদ্দিন ফারুক প্রমুখ।

অতিথি শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হলেন চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ, নাট্যনির্দেশক বরকতউল্লাহ, সংগীত সাধক আজাদ রহমান, নাট্যাভিনেতা কেরামত আলী, চিত্র সম্পাদক সুজন মাহমুদ, মাইনুল হুদা, সাজ্জাদ জহির। চিত্রগ্রাহক পঙ্কজ পালিত, মোকসেদুল বারি, সাইফুল ইসলাম বাদল, শিল্প সমালোচক মইনুদ্দীন খালেদ, সাব্বির আহমেদ। চিত্রপরিচালক ও লেখক ড. সাজেদুল আউয়াল। চিত্রপরিচালক অনিকেত আলম, বাদল রহমান। শব্দ প্রকৌশলী কেরামত আলী, সংগীত পরিচালক সাইয়াম রানা, চিত্রপরিচালক আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলাম, সাইদুল আনাম টুটুল, জাহিদুর রহিম অঞ্জন, আবৃত্তিকার ড. ভাশ্বর ব্যাণার্জি, ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ, চিত্রশিল্পী রফিকুল আলম, ডা আফসার আহমেদ, মোহাম্মদ জেসি, ড. জিনাত হোসেন, সোহরাওয়ার্দী আলবার্ট খান, নাট্যকার আতোয়ার রহমান এবং সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, জিনাত ইমতিয়াজ। রাষ্ট্রব্যবস্থা শিক্ষা, শিল্প সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রতি বছরই রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান করে। হয়তো সেদিন দূরে নয়, সিনেমা শিক্ষা প্রসারে যাদের অবদান তাদের নামের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হবেন ডা. প্রফেসর এম এ হান্নান ফিরোজ।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হওয়া ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া শিক্ষার ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ পাঠ্যসূচি এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আংশিক পাঠ্যসূচি অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে যা সিনেমা শিক্ষা প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সেখানে ছাত্ররা শিখছে সিনেমা। নিজস্ব ভোকাবুলারি, শিল্প-সাহিত্যের ভাষা ও ইতিহাস, ফটোগ্রাফিক কৌশল, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ, সিনেমা নির্মাণ কলা, বাজারজাতকরণ পদ্ধতি, সিনেমা অনুধাবন, টিভি প্রযোজনা, শব্দ ধারণ, নিউ মিডিয়া, চিত্রনাট্য রচনার কৌশল, অভিনয় কলা, সম্পাদনার কৌশল এবং সৃজনী উদ্যমের জন্য থিসিস রচনা। এছাড়া শিক্ষার্থীদের চার বছর অর্জিত দক্ষতাকে বাস্তব প্রয়োগ করে গ্রাজুয়েশন সিনেমা নির্মাণ। ব্যবহারিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ আরো কর্মমুখী করার প্রয়াসে প্রত্যক্ষ জ্ঞান আহরণে সুযোগ বিভিন্ন টেলিভিশন প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ করা এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার ব্যবহারিক ক্লাসের সুবিধা। পাশাপাশি মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের পরিচালিত বিষয়ভিত্তিক কর্মশালা।

বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সনদকেন্দ্রিক শিক্ষাতন্ত্রে এ ধরনের আউটকাম বেইসড শিক্ষা ইন্সটিটিউট দেওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে স্ট্যামফোর্ডের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগ প্রশংসা পেতেই পারে। আরো মনে রাখতে হবে, এই বিভাগের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ‘মেহের নেগার’। আজকের দর্শনের সিদ্ধান্ত সত্য বলে মনে হলেও আগামী দিনে তা লাভ-লোকসানের হিসেবের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়৷ কিন্তু ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগ সজীব কর্মতৎপরতায় এবং বহুরৈখিক সাফল্যে ১৭ বছরে প্রমাণ করেছে ব্যক্তির মানবিকতার বিকাশ যোগাযোগীয় উপাদান তথা গণমাধ্যম ও সিনেমা শিক্ষা গণমাধ্যম কর্মীর দর্শন বিষয়ক স্নায়ুসমূহকে স্টিমুলেট করতে পারে। আজ এই বিভাগের ছাত্ররা তাদের জ্ঞান অর্জনে ও শৈল্পিক চিন্তার অবাচনিক যোগে সংগীতে অর্জন করেছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। দেখা না শোনা গল্পের চিত্রনাট্য লাভ করেছে জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদানের অর্থ। যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে রাখছে ভিন্ন রকম বিশুদ্ধতা। শিক্ষকরা অর্জন করেছে একুশে পদক ও জাতীয় সম্মান।

মানুষের জীবনে জ্যামিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন বোধ আসে, তেমনি প্রয়োজন তার সাংস্কৃতিক চেতনা। বোধ আর বেদ ধনাত্মক-ঋণাত্মক দৃষ্টিপাতে সিনেমা, টেলিভিশন অথবা গণমাধ্যমে শাখা-প্রশাখা দেখবার এখনই সময়। যে শিক্ষার সূত্রধর স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগ। কৃতিত্বের গৌরবে যার ১৭ বছরের পদযাত্রা৷

লেখক: চলচ্চিত্রকার  

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়