ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিদেশি ভাষা শিক্ষা নীতির প্রয়োজনীয়তা

ড. মোহাম্মদ আনছারুল আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৩১, ১ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১২:৫৮, ১ মার্চ ২০২১
বিদেশি ভাষা শিক্ষা নীতির প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশে যে বিদেশি ভাষাসমূহ নানান প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করা হয়, সেগুলোকে বড় দাগে ৩টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমেই আসবে ইংরেজির কথা। বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা এবং এর ব্যবহারের ব্যাপকতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।

অনেক ভাষাবিদ ইংরেজিকে ‘বিদেশি ভাষা’ না বলে ‘দ্বিতীয় ভাষা’ বলতে চান। যদিও এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইংরেজি এমন একটি ভাষা, যা শেখার এবং প্রয়োগের লক্ষ্য, উদ্দেশ্যের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। অন্য যে কোনো ভাষা শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজিকে তুলনা করা বেমানান। 

এরপর দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে আরবি, উর্দু, ফারসির মতো ভাষাসমূহ। এগুলো মূলত ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে যুগ যুগ ধরে এই দেশে চর্চা হয়ে আসছে। মূলত উল্লেখিত ভাষাসমূহ সংশ্লিষ্ট দেশ বা অঞ্চলের শিল্পসাহিত্য সম্পর্কে জানতে, ভাষা দক্ষতাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

তৃতীয় এবং শেষ ভাগে রয়েছে সেসব ভাষা, যেগুলো মূলত বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কারণে বিস্তার লাভ করেছে। এই ভাষাসমূহের মধ্যে জাপানি, ফরাসি, জার্মান, চীনা, স্প্যানিশ, কোরিয়ান, রুশ, তুর্কি, ইতালিয়ান ইত্যাদি অন্যতম। এসব ভাষার শিক্ষার্থীদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশে উচ্চশিক্ষা বা চাকুরির সুযোগ লাভ করা। এই প্রবন্ধে ‘বিদেশি ভাষা’ বলতে এই সর্বশেষ ভাগের ভাষাসমূহকে বোঝানো হয়েছে।

২০১০ সালে বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় সর্বশেষ ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ ঘোষণা করেছে। শিক্ষানীতির একাধিক অংশে ইংরেজি ভাষার ওপর গুরুত্ব প্রদান করলেও অন্যান্য বিদেশি ভাষা শিক্ষা বিষয়ক কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা চোখে পড়ে না। তবে শিক্ষার বিভিন্ন ধাপে বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো উপযুক্ত জনবল তৈরিতে জোর দেওয়া হয়েছে। যেমন প্রথম অধ্যায় ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’-র ১১ নম্বরে বলা আছে ‘বিশ্বপরিমণ্ডলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে ও বিষয়ে উচ্চমানের দক্ষতা সৃষ্টি করা।’ আবার পঞ্চম অধ্যায় ‘বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা’-র ২৩ নম্বর কৌশলে (পৃষ্ঠা: ১৭) উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘যে সকল দেশে আমাদের দেশের মানুষ কাজ করতে যায় সে সকল দেশের শ্রম বাজার বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়াদি কারিগরি শিক্ষার পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করা হবে এবং ঐ সকল দেশের ভাষার ন্যূনতম জ্ঞান লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে’।

জাতীয় শিক্ষানীতির ২০১০-এর এই অংশটুকুতে বিদেশি ভাষা শিক্ষার ওপর খুব হালকাভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। বিদেশের শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা আমাদের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ভূমিকা দেখলেই বোঝা যায়। জাতীয় শিক্ষানীতির এই কৌশলটিকে (ভাষার ন্যূনতম জ্ঞান লাভের সুযোগ সৃষ্টি) সূচনা হিসেবে ধরে একটি পূর্ণাঙ্গ ‘বিদেশি ভাষা শিক্ষা নীত’ প্রণয়ন করা যেতে পারে।

এরপর আমরা দেখব জরুরিভিত্তিতে ‘বিদেশি ভাষা শিক্ষা নীতি’ কেন প্রয়োজন? একসময় বাংলদেশিরা মোটা দাগে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যেত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যায় যে, নানান পেশার দক্ষ কর্মী যেমন নেওয়া হচ্ছে, একইভাবে উচ্চশিক্ষিত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদিও সরকারি এবং বেসরকারি উভয়ভাবেই বিদেশ যাচ্ছেন। যেসব দেশে দৈনন্দিন জীবনে এবং কর্মস্থলে ইংরেজি চলে না, সেখানে ভাষা দক্ষতা বাধ্যতামূলক। বলাবাহুল্য, ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়েও সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। এই বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্তপূর্বক পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে ‘বিদেশি ভাষা শিক্ষা নীতি’র বিকল্প নেই।

বাংলাদেশে বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের গবেষণা পত্রিকাসহ ভাষা বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা পত্রিকা (জার্নাল) পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, অধিকাংশ প্রবন্ধই ব্যাকরণের তুলনামূলক আলোচনা নিয়ে। বিশ্বায়ন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চাহিদা, শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য, বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা, আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়বস্তু নিয়ে গবেষণা প্রায় নেই বললেই চলে।

অর্থাৎ বিদেশি ভাষা শিক্ষা রাষ্ট্রের নজর কাড়তে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, তেমনিভাবে আমরা শিক্ষক/গবেষকরাও এই ক্ষেত্রটিকে যথাযথ গুরুত্ব বা স্বীকৃতি দেইনি। ইতোমধ্যেই শুধুমাত্র ভাষা দক্ষতা না থাকার জন্য অনেক উন্নত দেশে আমাদের তরুণরা উচ্চশিক্ষা ও চাকুরির বাজারে পিছিয়ে রয়েছে। আমার নিজের পিএইচডি গবেষণার সময় কয়েক‘শ প্রবাসীর ওপর ভাষা ব্যবহারের জরিপ চালানো হয়েছিল। তাঁদের বক্তব্য এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য অনুযায়ী শুধুমাত্র ভাষা দক্ষতার জন্য একজন কর্মীর বেতন ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশ যদি যুতসই ‘বিদেশি ভাষা শিক্ষা নীতি’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সও অনেক বেড়ে যাবে। পাশাপাশি ইংরেজি রাষ্ট্রভাষা নয় এমন দেশের জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাথে সরাসরি এবং আরো কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত হওয়া যাবে।

এখন বিদেশি ভাষাশিক্ষা নীতি প্রণয়নে বিবেচ্য বিষয়সমূহ কী, সে বিষয়ে আলোকপাত করা যাক।

ভাষাবিজ্ঞান, প্রায়োগিক ভাষাবিজ্ঞান, ভাষা শিক্ষা, দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষণ, বিদেশি ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়সমূহ একটি আরেকটির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। অনেক ক্ষেত্রেই একটি থেকে আরেকটিকে আলাদা করাই কষ্টকর। যাহোক, যখন ‘ভাষা শিক্ষা’ পরিভাষাটি ব্যবহার করা হবে, তখন বুঝতে হবে যে, এটা শুধু পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু বা পাঠদান পদ্ধতি সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়। বরং ঐ ভাষা শিক্ষাদানের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ অর্থাৎ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র, সর্বোপরি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল ইত্যাদির অবস্থান, স্থান-কাল-পাত্রভেদে এর গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন, পারস্পরিক সম্পর্ক, প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ও বিবেচনায় আনতে হবে।

বিদেশি ভাষাশিক্ষা নীতি প্রণয়ন বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এর ব্যপকতা আরো বেড়ে যাবে। লক্ষ্য ভাষার দেশের সাথে নিজ দেশের সম্পর্ক, বৃত্তিসহ উচ্চশিক্ষার সুযোগ, চাকুরি ইত্যাদির সুযোগ সুবিধাও আমলে নিতে হবে। পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু, পাঠদান পদ্ধতি থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি আমলে নিয়ে যুগোপযোগী ও টেকসই ‘বিদেশি ভাষা শিক্ষা নীতি’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।

তবে এই ‘বিদেশি ভাষা শিক্ষা নীতি’ প্রণয়নের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, জ্ঞানের এই ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক/গবেষক অত্যন্ত সীমিত। আবার দেখা যায় যে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কমিটিসমূহতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তি থাকলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নামমাত্র থাকে এবং আমলারাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ‘ভাষা’ বিষয়ক যেকোন বিষয়ে আমরা সচেতন বা অসচেতনভাবে ‘ভাষাবিজ্ঞান’ নিয়ে পড়াশুনা/গবেষণা করেছেন তাঁদের শরনাপন্ন হই। আবার বিদেশি ভাষা বললে ইংরেজির বাইরে অন্য ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার মতো মানসিকতাই আমাদের অনেকের নেই। ‘ভাষাবিজ্ঞান’, ‘ভাষাশিক্ষা’ এবং ‘বিদেশি ভাষা শিক্ষা’ প্রত্যেকটির বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। সরকারকে অত্যন্ত সচেতনভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষকদের নিয়ে একটি ‘বিদেশি ভাষা শিক্ষা নীতি’ প্রণয়নের কাজ দ্রুত শুরু করে দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে ভাষা বিষয়ক আবেগের চেয়েও, জাতীয় স্বার্থ এবং অর্থনৈতিক দিককে প্রাধান্য দিতে হবে।

আশার কথা হচ্ছে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউতে ‘ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি’ এবং ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ‘জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি’ ও ‘চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি’ বিষয়ে ৪ বছর মেয়াদী অনার্স কোর্স চালু হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে ‘বিদেশি ভাষা শিক্ষা’-য় বিশেষজ্ঞ তরুণ দেশের অভ্যন্তরেই পাবো। তবে এই তরুণরা যাতে বিদেশি ভাষা শিক্ষাকে কার্যকরভাবে এগিয়ে নিতে পারে, তার জন্য তাদের সামনে একটি দিক-নির্দেশনা থাকতে হবে।

‘বিদেশি ভাষা শিক্ষা’ বিষয়ক গবেষণা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে রাষ্ট্র বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করবে। কারণ, বিদেশি ভাষা শিক্ষা নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা না থাকলে এবং এই বিষয়ে গবেষক তৈরি না হলে, সরকার আন্তরিক হলেও ‘বিদেশি ভাষা শিক্ষা নীতি’ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। ফলে, নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন উভয়দিক বিবেচনায় রেখে সরকারকে কার্যকরী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমিনুল/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়